ড. মাহবুব হাসান
রোজার দিনগুলোতে আমরা বেশি পেঁয়াজ খাই। এটি প্রচলিত ধারণা। ধারণা বলছি এ কারণে যে গ্রামের মানুষ বেশি পেঁয়াজ খায় না বা খাওয়ার যে নাগরিক বা শহুরে সংস্কৃতি তা তাদের নেই। বলবেন, গ্রামেও তো শহরের প্যান্ট পরে সাধারণ যুবকরা। কিন্তু ক্ষেতে যারা কাজ করেন তারা কিন্তু লুঙ্গি পরেন। বিষয়টি তলিয়ে দেখার বোধ ও বুদ্ধি নাগরিককুলের নেই। তারা চলতি ফ্যাশনকেই মনে করে নগরের ও গ্রামের ফ্যাশন। যাদের পাছায় লুঙ্গি জোগারের আর্থিক শক্তি নেই তারা নাগরিক জীবনের চাকচিক্য নেবে কেমন করে?
ভাসমান বাজারেও পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা। এর চেয়ে কমে তারা বেচবেন না, জানালেন। তারা কি কম দামে কিনে এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন টু-পাইস কামাতে? অসম্ভব। এরা এতটাই ক্ষুদ্র ভাসমান দোকানি যে তারা পণ্য বিক্রি করে পেট চালায়। তারা অতি লোভী নয়। কৃষকরাও লোভী নয়। তারা যা ব্যয় করে ফসল ফলানোর জন্য সেই টাকাটা ফেরত এলেই খুশি।
তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক পরেন। ঠিক একই রকম বিষয় খাবার গ্রহণের বেলায়ও। তাদের প্রধান পুষ্টির নাম ভাত। তার সঙ্গে শাক-সবজি আর ডাল থাকলেই তারা খুশি। মাছ থাকলে তারা মহাখুশি। তবে, কালেভদ্রে মাছ খায় তারা। বিল-ঝিলে মাছ ধরার যে উৎসব আমাদের ছেলেবেলায় ৫০/৬০/৭০ বছর আগে ছিল তা আজ কমে গেছে। কারণ বিলগুলো মজে গেছে আর বাড়িঘর উঠেছে ধানী জমিতে। চাষের জমিই তো কমেছে। ফলে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। কম জায়গায় বেশি উৎপাদন, বেশি লাভ। মাছ যে চাষ করা যায়, এই বিদ্যা তো আমাদের ছেলেবেলায় ছিল না। এখন মাছ চাষ একটি বড় ব্যবসা।
আর পেঁয়াজের কথা কি বলবো? যা উৎপাদন হয়, তার একটি অংশ খায় আর বাকিটুকু বিক্রি করে। আর দশটা কৃষিপণ্যের মতোই কম-বেশি বিক্রি করে তারা সংসার খরচ চালায়। তারা কিন্তু নগরের মানুষের মতো কাড়ি কাড়ি পেঁয়াজ কেনেও না, খায়ও না। তার পরও সরকারি তরফে বলা হয়, জনপ্রতি পেঁয়াজের হিসাব। সেখানে দেখানো হয়। সেই হিসাবে দেশে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় ৩৬ লাখ টন। আর খেতে সারা বছরে খরচ হয় ২৫ লাখ টন।
একটি পরিসংখ্যান দেখি, তাহলেই বুঝতে পারবো বাড়তি ১০-১১ লাখ টন পেঁয়াজ থাকে, তারপরও কেন আমদানি করতে হয়? আমদানি হয় শহুরে মানুষের অতিরিক্ত চাহিদার লালসা পুঁজি করে, আর ভয়কে জয় করে তা স্তিমিত করার জন্য। আর সেই ফাঁকে আমদানি বাণিজ্য করে টাকা পাচার ও লুটের আয়োজনের ব্যবস্থা হয়। আমদানি করা পেঁয়াজ ও অন্য পণ্যের ইনভয়েসে ওভার/আন্ডার রেট বসিয়ে লুটপাট করা হয়। এ বিষয়টা ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা ভালো বোঝেন।
পেঁয়াজ নিয়ে সব অতি উৎসাহী জ্ঞান পাপি লেখকদের উদ্দেশ্যে বলছি। আমাদের দেশে মাসে ২ লাখ টনের কিছু বেশি পেঁয়াজ লাগে। সেই হিসাবে দৈনিক লাগে ৭ হাজার টন। বাংলাদেশের কৃষক বছরে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করে। আর আমাদের চাহিদা ২৫ লাখ টন। কাজেই বাংলাদেশের কোন অবস্থায় পেঁয়াজ আমদানি করা লাগে না। কোনো সাংবাদিক কোনো দিন তো এই পেঁয়াজ উৎপাদনকারী কৃষকদের নিয়ে লিখলেন না। তাদের এক মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করতে কত খরচ হয়। আর কৃষকরা ২ হাজার টাকা মণ পেঁয়াজ বিক্রি করলে সেটা আপনাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । দুদিন পর পর খবর দেন ভারত থেকে হাজার হাজার লাখ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এসব নিউজ করে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। লজ্জা করে না আপনাদের?
এটা তো লেখেন না এত পেঁয়াজ উৎপাদন সত্ত্বেও কেন আমদানি করতে হবে । (জ্যাক হোসা/ফেসবুকার/০৪/০৪/২৪) এই তথ্য যাচাই করে নিতে পারেন আপনারা। সরকারের কৃষি অফিসের হিসাব তো আর আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাহলে কেন পেঁয়াজ আমদানি হয় এবং তা তড়িঘড়ি করে, বেশি দামে কিনে?
আজ ৪ এপ্রিল, ভাসমান বাজারেও পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা। এর চেয়ে কমে তারা বেচবেন না, জানালেন। তারা কি কম দামে কিনে এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন টু-পাইস কামাতে? অসম্ভব। এরা এতটাই ক্ষুদ্র ভাসমান দোকানি যে তারা পণ্য বিক্রি করে পেট চালায়। তারা অতি লোভী নয়। কৃষকরাও লোভী নয়। তারা যা ব্যয় করে ফসল ফলানোর জন্য সেই টাকাটা ফেরত এলেই খুশি। তারা নিজেদের শ্রমের দামটাও ধরে না। এরা আসলে বোকা, জাতির বোকা রাজনৈতিক শক্তি।
এই বোকা রাজনৈতিক শক্তিকেই ব্যবহার করেন আমাদের মাননীয় রাজনীতিকরা। কিছু কিছু রাজনীতিক বলেন, কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে, আমার কৃষক ভাইয়েরা তদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। এই মিথ্যাচার আমরা শুনে আসছি ৫৩ বছর ধরে। মাঠ থেকে ঢাকার কৃষিবাজার পর্যন্ত একটি ফসল আসতে যে কতবার তা ফড়িয়াদের হাতে হাতবদল হয়, তা যদি তারা উল্লেখ করতেন, তাহলে ওই মধ্যস্বত্বভোগীরাই যে কৃষকের জায়গায় লাভটা তুলে নিচ্ছে, তা রাজনীতিকরা জানেন, কিন্তু সেই সত্য তারা বলেন না। আমাদের রাজনীতি এভাবেই মিথ্যার মিথে বাস করছে।
সরকারের বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তারা বুঝতেই পারে না যে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। যে সরকার খোলাবাজারে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করে গরিবদের সাহায্য করছেন, তার বোঝা উচিত যে ব্যবসায়ীরা সরকারের শত্রু। তারা সরকারের সুনামকে হরণ করেছে। আর সরকার তাতেই খুশি এই ভেবে যে আমি তো গরিবদের কম দামে খাদ্য দিচ্ছি। হ্যাঁ, সরকার গরিবের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেন, কিন্তু খোলাবাজারের অবস্থা সামাল দিতে পারছে না। মজুতদারদের আটক করতে পারছেন না। আড়তদারদের কাছে সরকারই জিম্মি হয়ে আছে।
ব্যবসায়ীরা যে সরকারকে জিম্মি করে রেখে জনগণের পকেট কেটে টাকা লুটে নিচ্ছে এই সহজ সত্য বোঝার মতো কি কেউ নেই? আজ এই সত্য বুঝতে হবে যে সরকার ক্যাপটিভ হয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতি আর ঋণখেলাপিদের নগ্নহাতে। তারা ঘাপটি মেরে বসে আছে, কখন হামলা চালবে চিতার মতো। আমরা কি খুব বেশি দূরে বাস করছি? কাঁচাপণ্যের দাম কমাতে পারলেও, তা প্রকৃত দামে নিয়ে আসতে পারছেন না সরকার। তাকে অবশ্যই গ্রামের কৃষকের কথা মনে রাখতে হবে। তাকে অবশ্যই কৃষকের কেনার সামর্থ্যের কথা মনে রাখতে হবে। সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী নগর অধিপতিরা সরকারের কোনো উপকারে আসবে না।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।