৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

লাউয়াছড়া: মানুষের আঁচড়ে প্রকৃতি ক্ষত-বিক্ষত

মোস্তফা হোসেইন
মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেখতে গিয়েছিলাম ঈদের পর। লাইন ধরে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়েছিলো পর্যটকের ভিড়ে। অনেকের হাতেই চিপস জাতীয় খাদ্যের প্যাকেট, পানির বোতল ও কারো কারো হাতে ক্যামেরা, মোবাইল সবার হাতে। ২০/৩০ মিটার যাওয়ার পর মনে হলো পর্যটকরা ধারালো কিছু নিয়েও ঢুকে থাকেন। সুন্দর সুন্দর গাছের গায়ে আঁকা নামের হাজারো আদ্যাক্ষর দেখে তাই প্রমাণ হয়। মুক্তি পায়নি ডেওয়া গাছ থেকে বাঁশ গাছ দর্শণীয় কোনো গাছই।
হাঁটাপথের দুই পাশে পানির বোতল, চিপস এর প্যাকেট এর মতো পরিত্যক্ত জিনিসের ছড়াছড়ি। এসব দেখে স্পষ্টই বোঝা যায়, আসলে এই বনের কোনো রক্ষক নেই, তদারকিরও কেউ নেই। প্রবেশমুখ থেকে সামান্য ভিতরে বন বিভাগের কার্যালয় আছে একটি। কোথাও কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিনিধি আছে বলে মনে হলো না।
দেখা গেলো, চকচকে সুদৃশ্য দুটি গাড়ি ওই কার্যালয়ের কাছাকাছি এসে থেমেছে। আরও সুদৃশ্য কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে দিব্বি হেঁটে বেড়াচ্ছেন। বনের ভিতরে গাড়ির প্রবেশাধিকার পায় কিভাবে? কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন। তবে একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বলতে পারি, এটা বনের রাজ্যে দানবীয় আগ্রাসন ছাড়া কিছু নয়। কিশোরদের হৈহুল্লুর, চিৎকার, গান গাওয়া দেখে মনেই হলো না জায়গাটা পশুপাখিদের আবাস-নাট্যমঞ্চ নয় কিংবা খেলার মাঠ নয়।
আনুমানিক ১ কিলোমিটার হাঁটার পরও বনের কোনো গাছে একটি পাখিও দেখা গেলো না। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া। এর আগে ভিতরে ঢোকার সময় রেললাইনে গেটম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো-তাদের সামনের বিশাল সেগুন গাছে নাকি কখনো কখনো প্রচুর ময়না আসে। মাঝে মাঝে অন্য পাখিও দেখা যায়। বানরও আসে। তার কথা অনুযায়ী রেললাইন পেরিয়ে বানর ইত্যাদি প্রাণি বনরক্ষকদের অফিসের কাছেও যায়। কাঁঠাল, গোলাপজাম, জাম, আম ইত্যাদি খেতে ওরা রেললাইন পাড়ি দেয়। মারাও পড়ে রেলের নিচে পড়ে। ধাওয়া খায় পর্যটকদের হাতে।
অথচ ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী উদ্যানটিতে বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বাসস্থান হওয়ার কথা। পরবর্তীকালে লাউয়াছড়া সাতছড়ি ও বর্ষিজোড়া উদ্যান এলাকাকে বন্যপ্রাণীর উত্তম আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে বনায়ন ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন’ নামে সরকার ২০২২ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ৪৭ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ২০২৭ সালের মে মাস পর্যন্ত। সেই হিসেবে প্রকল্পের ২ বছরকাল অতীত হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ছিলো প্রাণীর মৃত্যুরোধে উদ্যান এলাকার সড়কে গাড়ির গতিসীমা ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ,স্পিড ট্র্যাকার স্থাপন,সড়ক ও রেললাইনের ওপর বন্য প্রাণী (উল্লুক, হনুমান ইত্যাদি) চলাচলে কেনোপিওয়ে নির্মাণ, বাটারফ্লাই পার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, উদ্যানের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, বন্য প্রাণীর জন্য জলাধার নির্মাণ, প্রাকৃতিক লেক, ছড়ার পুনঃখনন ও উন্নয়ন করার কথা বলা আছে প্রকল্পে। লাউয়াছড়ায় গিয়ে এর সামান্যই বাস্তবায়ন হতে দেখা গেছে। হাঁটাপথ দিয়ে লোকালয়ে গিয়ে চা খাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার।
২০২২ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়-ও সময় এক বছরে প্রায় ১শত বন্যাপ্রাণী প্রাণ হারিয়েছে ট্রেনের নিচে পড়ে, গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এবং বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে। প্রাণহানীর সেই কারণ দূরিকরণে প্রকল্পগ্রহণের দুই বছরেও এর কিয়দংশও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই মনে করা যায়-এই অঞ্চলে প্রাণহানী ঘটছে এবং অদূরভবিষ্যতেও বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সীমানা প্রাচীর হয়নি, রেললাইন চলে গেছে উদ্যানের ভিতর দিয়ে। রেলগাড়ির নিচে প্রাণ দেয় ওরা।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। বিশেষ করে এতসংখ্যক মানুষের প্রবেশাধিকার কোনোভাবেই বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ নয়। ঈদের ছুটিতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে যায় মানুষ। টিকিট কাটলেই প্রবেশাধিকার মিলে। অপ্রতুল বিনোদনের ব্যবস্থার কারণে মানুষ সেখানে যায়। বর্ষিজোড়া ও সাতছড়িকে পর্যটক বান্ধব করতে পারলে লাউয়াছড়ার ওপর চাপ কমবে। নতুন বনায়ন, বৃক্ষে আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা অতি জরুরী বলে মনে করি। বন সংরক্ষণের মাধ্যমে বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা, বন্য প্রাণীসহ স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে চিত্তবিনোদনের জন্য পরিবেশবান্ধব সুযোগ সৃষ্টি অতি জরুরি বলে মনে করি ।
বাইরের পর্যটকদের জন্য শ্রীমঙ্গল এলাকায় প্রচুর রিসোর্ট কটেজ তৈরি হয়েছে। রিসোর্ট কটেজ বাড়ানো প্রয়োজন শ্রীমঙ্গলের বাইরে। বিশেষ করে কমলগঞ্জ ও আশেপাশে জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকায় পরিবেশ রক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে রিসোর্ট কটেজ বাড়ানো যেতে পারে। ছোট শহর শ্রীমঙ্গলকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ থেকে রক্ষার কথাও ভাবতে হবে। এটা করা গেলে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে সেখানে গিয়ে থাকতে পারে।
শুধু বনই নয়, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এর বাইরের কথাও ভাবতে হবে। মৌলভীবাজার সংলগ্ন বিলও হতে পারে দর্শণীয় স্থান। সামান্য কিছু উদ্যোগ নিলেই তা সম্ভব। কটেজ হতে পারে বিল ঘেষে। সেখানে হতে পারে আধুনিক বিনোদন কেন্দ্র। বনরক্ষা করে পাহাড়ে হতে পারে তেমনি বিনোদন কেন্দ্র। বৃহত্তর সিলেটের লোকসংস্কৃতি কেন্দ্রিক বিনোদন ব্যবস্থা করতে পারলে সেখানে মানুষ ভিন্ন স্বাদ নিতেও যাবে। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, তার শতভাগ হয়তো এসব এলাকায় করা যাবে না সামাজিক কারণে। কিন্তু বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিনির্ভর ব্যবস্থা অসম্ভব কিছু নয়। শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টর কিংবা বড় হোটেলেও এমন ব্যবস্থা নেই। হোটেল-রিসোর্টগুলো যদি মাসের প্রথম সপ্তাহেও একটি করে কালচারাল প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে তাহলে পর্যটকরা অতিরিক্ত বিনোদন পেতে পারে।
উল্লেখ্য, সেখানে বৃহত্তর সিলেট এলাকার সংস্কৃতিকে তোলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা সজল দাসের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি তার রিসোর্টে বইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। একটি রিসোর্ট এর পরিচালক লোকমান হোসেন অপু তার ওখানে থাকা বইয়ের ব্যবহার বিষয়ে বললেন,মানুষের হাতে বই পৌঁছে দিতে পারলে তারা গ্রহণ করে। তিনি বললেন, রিসিপশনে বসে বই পড়ে কেউ কেউ, আবার কেউ কেউ সুইমিং পুলের কাছে কিংবা পেছনে ছড়ার পাড়ের সিঁড়িতে বসেও বই পড়ে। আর এটা তারা করে বাইরে দেখা শেষ করে। গ্র্যান্ড সুলতানের একজন কর্মকর্তাও বললেন, তাদের ওখানেও বইয়ের ব্যবস্থা আছে।
বইয়ের ব্যবস্থা আছে এমন হোটেল রিসোর্ট খুবই কম। প্রতি রুমে ২০/৩০টা বই রাখা খুব একটা ব্যয়বহুল নয়। সবাই ব্যবস্থা করতে পারে। ওখানে যারা যায়, তাদের একটি আকর্ষণ থাকে মনিপুরিদের তাঁতশিল্পের প্রতি। তাদের খুব কমই আছেন যারা তাঁত বুনতে দেখেছেন। রিসোর্টগুলো যদি একটি কিংবা দুটি তাঁত চালানোর সুযোগ করে দেয়, তাহলে মনিপুরী সম্প্রদায় ব্যবসায়র প্রয়োজনে সুযোগটি গ্রহণ করবে। রিসোর্টগুলো নামমাত্র ভাড়ায় কিংবা বিনাভাড়ায় সেই সুযোগটি করে দিতে পারে।
এখন ভিজুয়েল সুবিধা বিস্তৃত এবং স্বল্পব্যয়ে সম্ভব। শ্রীমঙ্গলের কোনো হোটেল রেস্টুরেন্টে ভিজুয়েল টুরিস্ট গাইড এর ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। হোটেল রিসোর্টগুলোতে স্বল্পব্যয়ের এই ব্যবস্থা সেবাখাতকে সম্প্রসারিত করবে। সেক্ষেত্রে পর্যটন করপোরেশন তাদের সহযোগিতা করতে পারে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বিঘ্ন না ঘটিয়ে ছড়াগুলো আরও বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে। এদিকটি সরকারি উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। শ্রীমঙ্গল কমলগঞ্জ এলাকার প্রাকৃতিক বনপাহাড়ের ওপর এককভাবে পর্যটকদের যে চাপ তা কমিয়ে আনতে পারলে বনরক্ষায় সহায়তা করবে।
লাউয়াছড়া বিষয়ে লিখতে গিয়ে হোটেল রিসোর্ট প্রসঙ্গ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে-পর্যটকদের বিনোদন সুবিধা শুধু লাউয়াছড়ায় না রেখে আবাসনস্থলেও সম্প্রসারিত করা। মোট কথা হচ্ছে, এককেন্দ্রিক বিনোদন থেকে সরিয়ে আনতে হবে। এতে করে পর্যটন এর বিকাশ যেমন হবে তেমনি প্রকৃতিও মানুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক: সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়