প্রতিদিনের ডেস্ক:
নেয়ামদ্দি মোড়লের মুখে নিজের পূর্বপুরুষ কর্তৃক ডাকাত দলকে বশে আনার গল্প শুনে রিহিল আনন্দ অনুভব করে। তবে তার বুঝতে বাকি থাকে না যে—নেয়ামদ্দি মোড়ল নিজ বংশের গৌরবগাঁথা বর্ণনায় অতিরঞ্জন করছে। নেয়ামদ্দি মোড়ল জিরাকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। এটি তার বিরাট অভিজ্ঞতা। মানুষ চড়াতে গিয়ে রাজনীতির ভাষা সে খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। নির্বাচনী মাঠে সে এ ধরনের গালগপ্প করে অভ্যস্ত। পূর্ব পুরুষের বীরত্ব মানুষকে জানালে তার নিজের গৌরব বাড়ে। নিজেকে সে যে হায়দার মোড়লের মোড়লির উত্তরাধিকার ভাবতে চায়—তা নেয়ামদ্দি মোড়লের ঠাটবাট দেখে বোঝা যায়। রিহিল তাকে জিজ্ঞেস করে— চাচা, বাড়িতে ডাকাত পড়ল কীভাবে? তাছাড়া দাদা কীভাবে ডাকাতদের বশে আনলেন? রিহিলের প্রশ্ন শুনে নেয়ামদ্দি মোড়ল অবাক হল না। এ ধরনের প্রশ্নে সে বহুবার উত্তর দিয়েছে। হাটে-ঘাটে বহু লোক তাকে এই প্রশ্ন করেছে। নেয়ামদ্দি মোড়ল বললো— বাবা, তুমি শিক্ষিত পোলা। বিদেশের মাটিতে বড় অইছো। মেলা লেখাপড়া করছো। তুমি তো জানো, মানুষ যেইহানে চাপে পড়ে ঠিক সেইহানেই তৎক্ষণাৎ সম্ভাবনা উদয় অয়। লোকের মুহেও চালু আছে—দেওয়ালে পিঠ ঠেইকা গেলে মানুষ ঘুইরা দাঁড়ায়। লগে এইডাও তো ঠিক যে—সাহসে কুলাইলে সময় বিশ্বাসে মানুষ রুইখাও দাঁড়ায়। হেই বিবেচনায় চাপে পড়ার সম্ভাবনা অইলো দুইডা। প্রথমডা অইলো—বিপদের মুহে মানুষের নতি স্বীকার। আর দ্বিতীয়ডা ঠিক এর উল্ডা। এইহানে নিজেরে প্রত্যাহার কইরা নতুন বলয় গইড়া তোলা। নতি স্বীকারের পরিণতি আপাতত স্থিতিশীল মনে অইলেও তা বেশি সম্মানজনক অয় না। নতির কাছে আত্মসমর্পণ করা লোকটারে শেষপর্যন্ত মেলা অপদস্থ অইতে অয়। তুচ্ছ অইয়া বাকি সময়ডা পাড় করতে অয়। তবে প্রয়োজনে নিজেরে সরায়ে নেওয়া বা বিদ্রোহের ফল খুব আরামদায়ক না অইলেও এই প্রক্রিয়ার লগে সম্মানের একটা সমঝোতা আছে। কথাগুলো যেন একনিশ্বাসে বলে গেল নেয়ামদ্দি মোড়ল। যেন সে ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছে এ সকল নীতিকথা। স্মৃতি এতটুকুও ক্ষয় হয়নি তার।নেয়ামদ্দি মোড়লের কথা শুনে রিহিলের ভ্রম টুটে গেল। সে হয়ত নেয়ামদ্দি মোড়লের মত একজন গ্রাম্য মেম্বারের কাছে এমন দার্শনিক বক্তব্য আশা করেনি। সে বলল— চাচা, এই উঠে দাঁড়ানো বা রুখে দাঁড়ানোর গল্পটা কেমন? নেয়ামদ্দি মোড়ল কথার মানুষ। কথা বলা তার শখ। কেউ তাকে বলতে বললে সে সানন্দে বলতে থাকে। তবে কেউ যদি মন দিয়ে তার কথা শোনে তবে নেয়ামদ্দি মোড়লের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। রিহিলের মত শিক্ষিত তরুণ আগ্রহ নিয়ে তার কাছে এটা-ওটা জানতে চাওয়ায় নেয়ামদ্দি মোড়লের কথা বলার তাগিদ আরো বেড়ে গেল। সে রিহিলের প্রশ্নে সরাসরি উত্তর না দিয়ে ফের বলতে শুরু করল— যেহানে সম্মান-সমঝোতা নাই সেইহান থেইকে নিজেরে সরায়ে নেওয়া মানুষটা নিগৃহীতদের লেইগা আশার আলো হয়া দিনকে দিন জ্বলতে থাহে। চারপাশের লোকেরা তহন তারে মেলা সাহসের অধিকারী মনে কইরা ফুলের মালা আইনা গলায় তুইলা দেয়। অন্যদেরকে পাশে পাইয়া এতদিন দেয়ালে ঠেইকা যাওয়া-সমাজে এতদিন ঠইকা যাওয়া লোকটা উচ্চকণ্ঠ হইয়া ওডে। হে যেমন নিজের জন্য আওয়াজ তোলে, চাইলে এবার হে অন্য মানুষের লেইগাও কথা কওয়ার শক্তি অর্জন করবার পারে। তোমার দাদা হায়দার মোড়লের হেই শক্তি আছিল। হে মানুষের লেইগা কতা কইতো। মানুষ আছিল তার আসল শক্তি। এই শক্তির সামনে ঢাল কও, তলোয়ার কও—সব অসহায়। ডাকাইতের আর শক্তি কত! মানুষের সামনে ডাকাইত দাঁড়াইতে পারে হুনছনি কোনোদিন?নিজের পূর্বপুরুষ হায়দার মোড়ল সম্পর্কে নেয়ামদ্দি মোড়লের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা শুনে রিহিল এবার শিশুসুলভ প্রশ্ন করল— গ্রামের লোকেরা দাদাকে খুব ভালোবাসত? যেন সে এতক্ষণ নেয়ামদ্দি মোড়লের বয়ান অর্ধেক বুঝেছে, বাকি অর্ধেক তার কাছে সহজ মনে হয়নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে ফের নেয়ামদ্দি মোড়লের কাছে প্রশ্ন তুলল— মানুষ তাকে এতো ভালোবাসলো কেন? নেয়ামদ্দি মোড়ল এবার বলল— মানুষের জন্য সে সারাজীবন কাজ করছে। মানুষ তারে ভালবাসপে না বাসপে কারে? মানুষের সঙ্গে একজন সাবেক জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধির সুসম্পর্কের কথা শুনে রিহিল বলল— তাহলে গ্রামের লোকেরদের উপরই তিনি সারাজীবন নির্ভর করেছেন? রিহিলের এবারের প্রশ্নটি নেয়ামদ্দি মোড়লের মনঃপূত হল না। যেন তিনি নিজে যা বুঝছেন এবং রিহিলকে যা বুঝাতে চাইছেন রিহিল তা বুঝেও বুঝতে পারছে না। শহুরে ছেলে রিহিল বিদেশ-বিভুঁইয়ে বেড়ে উঠেছে। বাঙালি রাজনীতির জটিল তত্ত্ব তার জন্য সহজবোধ্য নয়। নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল— মানুষ চিরকাল নির্দিষ্ট কোনো কিছুতেই নির্ভর করবার পারে না। চিরকালীন নির্ভরতা বইলা কিচ্ছু নাই। সময়ের সঙ্গে সবকিছু তামাদি হয়া যায়। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথা শুনে রিহিল এবার চমকে যায়। সে বুঝতে পারে রাজনীতি কত নির্মমভাবে ভাবতে শেখায়। কত জটিল বিষয় কত অনায়াসে বলতে শেখায়। এই আজ যে বিষয়টিকে অনিবার্য বলে স্বীকার করা হচ্ছে, কাল সেই বিষয়টিই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে নির্মমভাবে। নেয়ামদ্দির কথার পিঠে সে পালটা প্রশ্ন করে, বলে— যে মানুষের জন্য তিনি কাজ করলেন, যাদের উপর নির্ভর করলেন—তাদের ছেড়ে যাবার কথা বলছেন? নেয়ামদ্দি মোড়ল রিহিলের কথা শুনে এবার হেসে ওঠে। হেসে বলে— দেখ বাবা, বৃদ্ধ যে মানুষ নিজের হাতের লাঠিতে ভর করে হাটে সেই লাঠিটারেও একসময় ওই বৃদ্ধ মানুষটা বহন করে। লাঠি উপরে না তুলতে পারলে তাতে ফের ভর দেওন যায় না। সব সম্পর্কে যত্নআত্তি প্রয়োজন অয়। আদর-স্নেহের পারস্পরিক চেনাজানা ও সম্পর্ক শক্তি পায় বাবা। যত্ন করলে তিতা নিমবৃক্ষও বাহারি ফুল ফোটায়। আর অবহেলা কেবল সামনে চলার পথরে কঠিন কইরা তোলে।রিহিলের কাছে এবার পরিষ্কার হয় যে, নেয়মদ্দি মোড়ল যত্নের কথা বলে মূলত সেবার বিনিময়ে নেতৃত্ব—এই সনাতন ধারণাকে সামনে টেনে এনেছে। কিন্তু আধুনিককালে রাজনীতি ও ক্ষমতাকাঠামো যে কেবল সেবার বিনিময়ে আসে না—একথা রিহিল আর নেয়ামদ্দি মোড়লকে বলতে চায় না। নেয়ামদ্দি মোড়ল প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, তত্ত্ব-টত্ত্ব তার মস্তিস্কে নাও ঢুকতে পারে। তাহলে অহেতুক কথা বাড়বে। মোড়লের শানে বসে তারা দুজন কথা বলছে। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া এসে বসন ভেদ করে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। এতদিন বাদে আজ যেন প্রকৃতি বৃষ্টির কবল থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছে। রিহিল ফের বলে— চাচা, আমি কেবল বুঝতে চাই যে—দাদা কীভাবে এতকিছুর সমন্বয় করলেন। আপনার কথায় কিছুটা বুঝতে পারছি, তবু আরো জানতে ইচ্ছে করছে যে—তিনি মানুষকে ভালোবাসলেন, মানুষের শক্তির উপর ভর করলেন আবার সময়মতো মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেন—কীভাবে একহাতে সবকিছু সম্ভব হল? রিহিলের প্রশ্ন শুনে এবার নেয়ামদ্দি মোড়ল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সে এতক্ষণ যেন একটি প্রাচীন বাড়ির গুপ্তধনের গল্প বলছিল। কিন্তু যাকে গল্পটি বলা হচ্ছিল তাকে যেন কোনোভাবেই গুপ্তধন গচ্ছিত সিন্দুকের কাছাকাছি নেওয়া যাচ্ছিল না। অথচ এবার সে নিজেই চাবি খুঁজে এনে সিন্ধুক খোলার কলাকৌশল রপ্ত করছে। নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল— অর্থ হলে পুরুষের বুদ্ধি বাড়ে। আর বুদ্ধিমান পুরুষের যদি অর্থ-বিত্ত হয় তবে সে দুনিয়ার শাহেনশাহ হয়ে ওঠে।রিহিল বুঝতে পারল হায়দার মোড়লের জীবনে বুদ্ধি-প্রজ্ঞার সঙ্গে বিত্তের সমন্বয় ঘটেছিল। এই জাদুবলে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চড়তে পেরেছিলেন। ফের নিশ্চয়ই বুদ্ধির ক্ষয়ে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে ছিটকে নিঃস্ব হতে হয়েছিল তাকে। একজীবনে হায়দার মোড়ল সফল ও বিফল দুই-ই হয়েছিলেন। নেয়ামদ্দি মোড়লের কথায় এবার রিহিলের ভাবনায় ছেদ পড়ল। নেয়ামদ্দি মোড়ল বলল— সারা গ্রাম যখন ডাকাইতের ভয়ে থরথর করছিল তখন তোমার দাদা হেগো পঞ্চাশ মন চাইল দিছিল। গ্রামের অনেকে তো এই কতা হুইনা প্রথমে মোড়ল চাচার উপর ক্ষেইপা আটখান। কেউ কেউ তো তারে দস্যু দলের দোসর কইয়াও গাইল দিছে। হে হেইসব কতা আমলে নেওনের মানুষ আছিল না। যদিও হগলে পরে বুঝছে—হে আসলে ডাকাইতদের হাতে রাইখা গ্রাম সামলাইলেন। হে আইজকা যা চিন্তা করতো, গ্রামের মানুষ তা দুই বছর পরও ভাবতে পারত না। হোনো, এইবার তোমারে একটা হক কতা কই, হায়দার মোড়ল এমন একজন মানুষ আছিল—যে আসলে অর্ধেক ভালো মানুষ, আর অর্ধেক রহস্যময়। জীবদ্দশায় হেরে কেউ পুরাপুরি বুঝবার পারে নাই।
চলবে