১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

হিটশকের ঝুঁকিতে বোরো ধান

প্রতিদিনের ডেস্ক
দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। জনজীবনের পাশাপাশি যা আক্রান্ত করছে ফসলও। চলতি বোরো মৌসুমে ভাবাচ্ছে ধানের হিটস্ট্রোক বা হিটশক। সবশেষ ২০২১ সালে দেশে বড় ধরনের হিটশক হয়। এতে প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির ধান তাপে চিটা হয়ে যায়। ক্ষতির পরিমাণ ছিল কয়েকশ কোটি টাকা। চলমান তাপপ্রবাহ শিগগির না কমলে এবছরও এমন ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
২০২১ সালের এপ্রিলেও একবার তাপপ্রবাহ দাপট দেখায়। তখন সারাদেশে বোরো ধানের ফুল ফোটার সময় (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) চলছিল। ওই সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশ ওপরে। এতে বোরো ধানের ফোটা ফুলগুলো শুকিয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল।
এবছরও একই ধরনের বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়েছে দেশ। বরং ওই সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা এবার আরও বেশি। হাওরাঞ্চল ছাড়া সারাদেশে বোরো ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জমির ধান এ সময় পার করছে। যে কারণে আবারও হিটশকের বড় ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা—দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। এই মুহূর্তে দেশের ৪০টির বেশি জেলার বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দেশে এখন তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। যে কারণে দেশে ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করা রয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগ) ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘এমন বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বোরো ধান নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। হাওরাঞ্চল ছাড়া সারা দেশে এখন ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে, যা ধানের জন্য খুব নাজুক অবস্থা। পরাগায়নের সময়কাল ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে স্বাভাবিক পরাগায়ন হয়, তখন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপর চলে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সরেজমিনেও মাঠে গিয়েছি। তাপমাত্রার কারণে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে। ধানের দানা গঠন ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ ধানগাছ দিনে খাদ্য তৈরি করে, যা রাতে ভেঙে ধানের দানা তৈরি করে। এটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ রাতের তাপমাত্রাও বেশি। যার কারণে ধানের পুষ্টতা (গ্রেইন ফিলিং) কম হচ্ছে। অর্থাৎ, ধানের খোসার ভেতরের কার্বোহাইড্রেড বীজ ছোট হচ্ছে। তাতে সামগ্রিক উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ, কমে যাবে।’
কৃষিতে এ ধরনের হিটশককে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ধান গবেষকরা। দেশে নতুন এ ঝুঁকি সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। আবার এ অবস্থা থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থাও নেই তাপমাত্রা কমা ছাড়া। বোরো মৌসুম নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হলেও শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। গত কয়েক বছর এসময় তীব্র তাপপ্রবাহ হচ্ছে। ফুল ফোটার সময় তীব্র তাপপ্রবাহ এক-দুই ঘণ্টা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায় ধান। আবার তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না তখনই ধানের জন্য হিটশক ঘটে। অর্থাৎ, বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়।
সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। ২০০৭ সালে একবার হিটশক হয়। এছাড়া কিছু এলাকায় কয়েক বছর ছোট পরিসরে হিটশক হয়েছে। এ পর্যন্ত যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে এর আগে হিটশক হয়েছে। তবে তা কখনো গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে। বড় হিটশক ২০২১ সালেই প্রথম হয়।’ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী বলেন, ‘বৃষ্টি না হলে আমরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবো। সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থায় আছি। কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতিতে কৃষকের করণীয় কম।’
নাজমুল বারী বলেন, ‘কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এত তাপমাত্রায় হিটশক ছাড়াও রোগবালাই বেড়ে যাচ্ছে। ব্লাস্ট, বিএলবি ও বিএলএস রোগ দেখা যাচ্ছে।’
ব্রির সতর্কবার্তা
সম্প্রতি এ তাপপ্রবাহে কৃষকদের সতর্কবার্তা দিয়েছে ব্রি। এতে বলা হয়, ধানের ফুল ফোটা ও পরাগায়নের সময় ধানের যে শীষগুলোয় ফুল ফুটতে থাকে, তা খুবই সক্রিয় অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় ধানের শীষকে তপ্ত হাওয়ার (লু হাওয়া) ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য গাছ প্রচুর পরিমাণে পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বের করে দেয়। এ প্রস্বেদন অনেকটা গাছের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার কুলিং সিস্টেমের (শীতলীকরণ ব্যবস্থা) মতো কাজ করে।
কাজেই এসময় তীব্র দাবদাহের হিটশকের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার উপায় হচ্ছে বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবে এবং ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। এছাড়া কিছু রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহার এই প্রতিকূল অবস্থা থেকে ধানগাছকে রক্ষা করতে পারে।
তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষার জন্য জমিতে পানি ধরে রাখার বিকল্প কোনো উপায় নেই। এসময় জমিতে যেন পানির ঘাটতি না হয়। সব সময় ধানক্ষেতে অন্তত দুই-তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না।
এছাড়া এ অবস্থায় শীষ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হতে পারে। তাই রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই প্রিভেনটিভ হিসেবে বিকেলে ট্রুপার ৮ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে অথবা নেটিভো ৬ গ্রাম ১০ লিটার পানিসহ প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে পাঁচদিন ব্যবধানে দুবার স্প্রে করতে হবে।
পাশাপাশি ধানে বিএলবি ও বিএলএস রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ৬০ গ্রাম থিওভিট, ৬০ গ্রাম পটাশ ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে সমানভাবে মিশিয়ে পাঁচ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি ২২ লাখ ৫৬৪ টন। এখন পর্যন্ত বোরো কর্তন করা হয়েছে শুধু হাওরাঞ্চলে। সেখানে তিনদিন ধরে ধানকাটা চলছে। প্রথম দুদিনে ৭৭ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়