সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সূতিকাগার এফডিসি। চলচ্চিত্রের বহুমাত্রিক উন্নয়নের জন্যই স্থাপিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এফডিসিতে এখন কারা যায়? কারা নিয়ন্ত্রণ করে এ চত্বর? প্রশ্নগুলো উঠছে কারণ এখান থেকে ভালো কোনো খবর আসছে না ইদানীং।
সর্বশেষ যেটি এসেছে সেটাও এক কথায় জঘন্য এবং কদর্য। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নবনির্বাচিত কমিটির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান কভার করতে গিয়ে সহিংস হামলার শিকার হয়েছেন বিনোদন সাংবাদিকরা। চলচ্চিত্র শিল্পীরা হিংস্রভাবে হামলে পড়ে ১০ সংবাদকর্মীকে রক্তাক্ত করেছেন। অনেকে বলছেন, এর মধ্যে অনেক ইউটিউবার ছিলেন যাদের কারণেই ঘটনা ঘটেছে।
এফডিসিতে উৎপাদিত বাংলা ছবি চালিয়ে আর হলগুলো জিইয়ে রাখা যাচ্ছে না। সেগুলো এখন দোকান, বাজার বা মাদ্রাসায় পরিণত হচ্ছে। ভাবা যায় কতটা বাজে অবস্থা? উপায়হীন হয়ে হল মালিকরা বাঁচামরার হিসেব করছিলেন দুই একটি ভারতীয় বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি চালাবেন। সেটার বিরোধিতাও হয়েছে শক্তভাবে।
কেন এ হামলা হলো, তা নিয়ে কথা বলেছেন সংবাদকর্মী ও শিল্পীরা। ঘটনাস্থলে থাকা এক সাংবাদিক বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের আলোচিত-সমালোচিত নায়িকা ময়ূরীর মেয়েকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনার মায়ের সিনেমা দেখে কেমন লাগে?’ এমন প্রশ্নে ক্ষেপে যান পাশে থাকা খলনায়ক শিবা শানু। সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
সাংবাদিকদের অনেকের মাঝে এমন ব্যক্তিগত ও অবমাননাকর প্রশ্ন করার বা উত্ত্যক্ত করার বাতিক আছে। এটা যে একটা গর্হিত কাজ, সাংবাদিকতা নয় সেটা তারা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। এর আগে অভিনেত্রী তানজিন তিশাকে একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেছিলেন এক বিনোদন সাংবাদিক; যার জেরে বিনোদন সাংবাদিকদের রাস্তায় হাস্যকর বিক্ষোভ করতেও দেখেছিলাম।
কিন্তু যেটাই হোক, এফডিসিতে যা হয়েছে সেটা এই চলচ্চিত্র জগতের চরিত্রের সাথেই যায়। প্রশ্ন পছন্দ না হলে এড়িয়ে যেতে পারেন, প্রয়োজনে অভিযোগ বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, কিন্তু তাই বলে এরকম করে হামলে পড়া? সহিংসতা, হিংস্রতা, অপেশাদার আচরণই এই এফডিসি দখলদারদের অভ্যাস।
আমাদের চলচ্চিত্র একটি ক্ষুদ্র, পরিচিত এবং অভ্যস্ত বৃত্তের মধ্যে সীমিত হয়ে ক্রমেই লুপ্তপ্রায়। অথচ এটা নিয়েই আমাদের সাংবাদিকদের কত না আগ্রহ! দিনের পর দিন শিল্পী সমিতিসহ ফিল্মের নানা সমিতির নির্বাচন নিয়ে কলতলার ঝগড়া এই সাংবাদিকরা কভার করেও শিল্পীদের দিক থেকে এমন একটা আক্রমণের শিকার হলেন।
এফডিসিতে উৎপাদিত বাংলা ছবি চালিয়ে আর হলগুলো জিইয়ে রাখা যাচ্ছে না। সেগুলো এখন দোকান, বাজার বা মাদরাসায় পরিণত হচ্ছে। ভাবা যায় কতটা বাজে অবস্থা? উপায়হীন হয়ে হল মালিকরা বাঁচামরার হিসাব করছিলেন দু-একটি ভারতীয় বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি চালাবেন। সেটার বিরোধিতাও হয়েছে শক্তভাবে।
বস্তাপচা কাহিনি, দুর্বল নির্মাণ, সম্পাদনা সব মিলিয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অনেক দিন আগেই ভদ্রলোক পাবলিক হলে যাওয়া ছেড়েছে। ফ্যামিলি নিয়ে কেউ আর যায় না সিনেমা দেখতে। ঘাম-চিটচিট শরীরে সিনেমা দেখবে মানুষ, এমন ভাবনাই এ শিল্পের কর্ণধারদের মনোজগতে।
আসলে আমাদের গোটা চলচ্চিত্রটা একটা পাড়া এবং পাড়ার মতোই সেটার সংস্কৃতি। এখানে সংলাপ নেই, আছে খিস্তি খেউড়, অভিনয় নেই, আছে মারামারি। শিল্প কাকে বলে, সিনেমা কাকে বলে এই উদ্ভট ভাবনার লোকগুলোই ঠিক করছে। তাই কোনো সুস্থতা নেই কোথাও।
যেনতেন সিনেমা চালিয়ে পুরো ইমেজটাই সেরকম হয়ে গেছে। সময় এসেছে ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনার। চলচ্চিত্র হলো একটি জাতির সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। এখন যারা এফডিসিতে ছবি নির্মাণ করছেন সেখানে সংস্কৃতি আছে কি না দেখতে হবে। বলা হয় ভালো গল্পের অভাব। কিন্তু গল্প আসবে কোথা থেকে? সংস্কৃতি চর্চা যারা করেন তাদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই এফডিসিকেন্দ্রিক চক্রের। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ওঠাবসা নেই প্রযুক্তির সাথেও। বলা হয় চলচ্চিত্র এখন দাঁড়িয়ে নেই, একেবারে শুয়ে পড়েছে। এখন হিরো-হিরোইন উভয়ই প্রযোজক ধরে আনেন। প্রযোজক নিয়ে আসেন এবং প্রযোজক তার সম্পূর্ণ প্রভাব পরিচালকদের ওপর চাপান। প্রযোজক যাকে নিতে বলছে তাকেই নিতে হচ্ছে, ছবির ধরনও বলে দিচ্ছেন প্রযোজক।
কিন্তু আমাদের সিনেমা ও চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হবে। প্রথম কাজ হলো বাঁচানো। শুধু শুনতে হয় একের পর এক হল বন্ধের খবর। ঢালিউড বলা হয় ঢাকাই ফিল্ম জগৎকে। কিন্তু সিনেমার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। আছে কেবল নোংরা রাজনীতি। কে কাকে বহিষ্কার করছে, কে কাকে হুমকি দিচ্ছে, এসব ছাড়া কোনো গল্প নেই এই পাড়াটার। সেই পাড়ায় যে দু-একজন যোগ্য আছেন, প্রচেষ্টা হলো তাদের বেকায়দায় ফেলা, প্রয়োজনে ঝেটিয়ে বিদায় করা।
ভালো যে এবার ঈদে বেশ কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়। প্রযুক্তির প্রসার ও উপযুক্ত ব্যবহার বাংলা সিনেমায় কেউ কি দেখছে? যেসব প্রিন্টের ছবি এদেশের দর্শকদের দেখানো হয় সেগুলো নোংরা লাগে এ যুগের ঝাঁ-চকচকে সিনেমার ডিজিটাল প্রিন্টের সাথে তুলনা করলে।
বিদেশের বাজার তো অনেক দূরের ব্যাপার, দেশের বাজারেই ‘প্রোডাক্ট’ হিসেবে এফডিসি’র সিনেমা এখনো সেই ঘুলিঘুপচির জায়গায়ই পড়ে রয়েছে। অথচ পাশের পশ্চিমবঙ্গের টালিগঞ্জের ছবি লাফিয়ে লাফিয়ে কয়েকশ গুণ এগিয়ে গেছে। তফাৎটা শুধুই অর্থনৈতিক নয়। অনেক বেশি শিক্ষা আর রুচির।
ভালো ছায়াছবির চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। আমরাই জোগান দিতে বিমুখ। প্রত্যক্ষ ক্ষতি হলো হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরোক্ষ ক্ষতিও কম নেই। যারা ভালো পরিচালক আছেন, যারা মানসম্মত কিছু করতে চান, তারা আর প্রবেশাধিকার পান না অসুস্থ পরিবেশে প্রতিদিন অনেক সম্ভাবনা গলা টিপে ধরছে একটা অপশক্তি।
ছোট পুকুর থেকে বড় পুকুরে পৌঁছতে না পারলে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সবার ভালোলাগার মতো ছবি তো চাই। সঙ্গে পুরোনো সিনেমা হলের স্বাস্থ্য না-ফেরালে শিল্প বাঁচবে কি করে? সময় এসে গেছে বদলে যাওয়ার। সিনেমা কাকে বলে ঠিক করবে কে? মানুষ। যুগে যুগে শিল্প ভালো না মন্দ ঠিক করেছে কে? পাবলিক। জনগোষ্ঠীই শিল্পের সবচেয়ে বড় বিচারক। সিনেমা মানুষের। সিনেমার উৎসব মানুষের, অসাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।