উদিসা ইসলাম
প্রতিবাদের ভাষা শক্ত হবে, কঠিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় হবে, এটাই স্বাভাবিক। যখন দাবি আদায় হচ্ছে না তখন সর্বোচ্চ কর্মসূচি দিয়ে কর্তৃপক্ষকে কাবু করতে হবে, এটাই মূলমন্ত্র। কিন্তু যখন আপনি সেবাদানের শপথ নেবেন, যখন আপনার হাতে কারও প্রাণভোমরা আছে, যখন আপনি একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন তখনও কি আন্দোলনের ভাষা একই হবে? সেখানেও কি শক্ত কর্মসূচি দিয়ে সব স্তব্ধ করে দেবেন, নাকি ‘শো মাস্ট গো অন’?
বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষকেও এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। সংবেদনশীল পেশার মানুষ যেন ভালো থাকে, নিজেকে নিয়ে অস্থিরতায় না ভোগেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাকে যেন সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে না হয়। দুই পক্ষের ম্যাচুরিটি পারে মানুষকে রক্ষা করতে এবং চিকিৎসা দেওয়া থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই। শো মাস্ট গো অন। একইসঙ্গে চিকিৎসা সুরক্ষা আইন করে চিকিৎসক, রোগী ও চিকিৎসাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও দায় নির্ধারণ জরুরি বলেও মত দেন তারা।
গত ১০ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়া জেনারেল হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত এক রোগীকে চিকিৎসা দিতে দেরি হওয়ার অভিযোগ তুলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রক্তিম দাশকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ ঘটনার পর গত ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালের এনআইসিইউতে থাকা নিউমোনিয়া আক্রান্ত এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্তব্যরত চিকিৎসক রিয়াজ উদ্দিন শিবলুর ওপর হামলা চালানো হয়। এর প্রতিবাদে ২৩ এপ্রিল সারা দিন সেবা দেবেন না বলে জানান চিকিৎসকরা। সেসময় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, দুই চিকিৎসকের ওপর হামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই চিকিৎসা বিরতির কর্মসূচি নেওয়া হয়।
এর আগে ভাতা বাড়ানো, ৯ মাসের বকেয়া ভাতা পরিশোধ, ১২টি প্রতিষ্ঠানের ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার এবং চিকিৎসক সুরক্ষা আইন বলবৎ করা—এই চার দাবিতে টানা চারদিন ধরে দ্বিতীয় দফায় কর্মবিরতি পালন করছিলেন বাংলাদেশের প্রাইভেট পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। যদিও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম শামীম আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েক দিন ধরে মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন ও ট্রেইনি চিকিৎসকরা ধর্মঘট করায় লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু এর মাঝেও ডাক্তাররা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। “এখানে ইন্টার্নরা, কোর্স স্টুডেন্টরা ধর্মঘট করছে। ফলে আমাদের চিকিৎসকদের ওপর চাপ বেড়ে গেছে।
চিকিৎসকদের দাবির সঙ্গে শুধু মন্ত্রী নন, অনেকেই একাত্মতা প্রকাশ করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই প্রশ্নও সামনে আসে যে নৈতিকতার জায়গা থেকে তারা সব সেবা বন্ধ করে এটি করতে পারেন কিনা।
যেকোনও ঘটনাতে কর্মবিরতি শুরুর কর্মসূচির যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, সাংগঠনিকভাবে আমরা কর্মবিরতি কর্মসূচিকে সমর্থন করি না। যখন আর কোনও পথই থাকে না তখন আপনি চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসেবে কর্মবিরতিতে যেতে পারেন। কিন্তু কারও এক-দুজনের জন্য লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা যায় না। তরুণ চিকিৎসক যারা আছেন তাদের ওপর যেহেতু স্থানীয় নেতৃত্বের প্রভাব থাকে, সেহেতু তারা পারেন এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনতে।
আইনি সুরক্ষা না থাকার কারণে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে থাকে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের এখানে একেবারেই মনোযোগ দেওয়া হয় না যে বিষয়টিতে, সেটা হলো চিকিৎসাব্যবস্থা। রোগী ক্ষিপ্ত হয়ে চিকিৎসককে শারীরিকভাবে আঘাত করে ফেলে, চিকিৎসকরা সম্মিলিতভাবে চরমপন্থা কর্মবিরতিতে চলে যান, এর ফলে চিকিৎসকদের প্রকৃত অর্থে যারা নিগ্রহ করে তারা ভোগেন না, ভোগেন সেবা নিতে যারা চান তারা। তিনি বলেন, চিকিৎসা সুরক্ষা আইন করা খুব জরুরি, যাতে যিনি চিকিৎসা নেবেন, যিনি চিকিৎসা দেবেন এবং যে প্রতিষ্ঠান আয়োজন করবে—তিন পক্ষের দায়িত্ব, অধিকার, দায় লিপিবদ্ধ থাকবে। যদি আইনি প্রতিকারের জায়গাটা দ্রুততার সঙ্গে করা যেতো তাহলে এই অনভিপ্রেত ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে না।
চিকিৎসকরা ইথিক্যাল জায়গা থেকে ধর্মঘট ডাকতে পারেন কিনা বা একজন চিকিৎসক এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি করবেন না, যাতে তা রোগীর প্রাণ সংকটে ফেলে—এসব পড়ানো হয় কিনা প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ইথিক্যাল জায়গা থেকে কোনোদিনই ধর্মঘট করা যায় না। আমি কখনোই চাই না আমার চিকিৎসকরা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় যাক কিংবা ধর্মঘট করুক। তাদের যাতে ভালো রাখা যায় সেই লক্ষ্যে আমি কাজ করছি। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের শপথের মধ্যে ধর্মঘটে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ নেই। কারণ এটা অনেক আগে ঠিক করা।