ডা: সেলিনা সুলতানা
তীব্র তাপপ্রবাহে সব শিশুর জন্য দরকার বাড়তি যত্ন। কেননা এ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বছরের উষ্ণতম মাস এপ্রিল, এসময় শিশুরা সাধারণত ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ, ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এখন বাইরের তাপমাত্রা অনেক বেশি। খাবার ও পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এসময়।
মানবদেহের একটি নিয়ন্ত্রিত অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা থাকে, যা শরীরে রক্ত প্রবাহিত করে, অঙ্গগুলো সুস্থ রাখে। শরীরের ভেতরের যে তাপমাত্রা, যাকে বলে ‘অন্তর্নিহিত তাপমাত্রা বা কোর টেম্পারেচার’, এ সময় তা বেড়ে যায়। শরীরের ভেতরে যে থার্মো রেগুলেশন বা যে নিজস্ব তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে, তার মাধ্যমে এ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাস আছে, যা একাজ করে। তবে হঠাৎ বাইরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নাজুক হয়ে যায়।
এ অনিয়ন্ত্রিত অন্তর্নিহিত তাপমাত্রার কারণে আক্রান্ত শিশুর শরীরে পর্যায়ক্রমে সমস্যা হয়। প্রথম স্তরটি হলো হিপ ক্র্যাম্প। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শরীর থেকে বেশি মাত্রায় ঘাম বেরিয়ে যায়। তার সঙ্গে লবণ বেরিয়ে যায় ফলে পেশিতে ব্যথা হয় বা টানটান হয়ে যায়, পায়ের, হাতের, পেটের পেশি খুব ব্যথা করে। দ্বিতীয় স্তরটি ‘হিট এক্সরসন’।
আগের স্তরে যে ব্যথা থাকে, এর সঙ্গে এ পর্যায়ে যুক্ত হতে থাকে ক্লান্তি, অবসাদ। শিশু এ অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে যায়, ঘাম বেড়ে যায়। পরের স্তরটি হলো ‘হিটস্ট্রোক’, যা খারাপ। শিশুর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে লিভার, কিডনি, ফুসফুসের ওপর। ফলে অঙ্গের কার্যকারিতা কমে যেতে শুরু করে। এমনকি শিশু অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। এটি একটি জটিল অবস্থা। গরমে এসব লক্ষণ শিশুর মধ্যে দেখা দিলে প্রথমেই শিশুদের প্রচুর পানি পান করাতে হবে।
খাবার স্যালাইন বা পানি বেশি আছে, এমন ফল দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশু রোদে থাকলে, দ্রুত ছায়ায় নিয়ে আসতে হবে, ফ্যানের নিচে আনতে হবে, শরীরের আঁটসাঁট কাপড় ঢিলে করে দিতে হবে। শরীরে ঘাম শুকানোর পর পানি দিয়ে গা মুছে দিতে হবে। এর মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এ সময় চিনিজাতীয় খাবার না দেওয়াই ভালো। কারণ, চিনিতে শরীরে দ্রুততার সঙ্গে তাপ ও এনার্জি তৈরি হয়। জাঙ্ক ফুড ও বেশি প্রোটিনজাতীয় খাবার না দেওয়াই ভালো। মাংসজাতীয় বা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে যাওয়া ভালো। সর্বোপরি শিশুর প্রস্রাব ভালোভাবে হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় তাদের একটু একটু করে পানি বা খাবার স্যালাইন দেয়া ভালো। খেয়াল রাখতে হবে, শিশুদের অতিরিক্ত ঘাম যেন না হয়। এনার্জি ড্রিংক, সুগার ওয়াটার এগুলো দেওয়া যাবে না এ সময়ে।
এ প্রচণ্ড গরমে রাস্তাঘাটে নানা ধরনের শরবত, আখের রস বা পানীয় বিক্রি হয়। শিশুদের পিপাসা লাগে, তারা এসব পান করতে চায়। এসব পানীয়ের মান মোটেও ভালো নয়। এসব পানীয় পান করলে শিশুদের ঠান্ডা ও গলা ব্যথা এবং জ্বর হতে পারে। শিশুরা যেন এসব না পান করে বা খায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এর মাধ্যমে দ্রুত ডায়রিয়াও জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাস্তার খাবার তো আছেই। শিশুদের এ সময় ঘরের টাটকা ও বিশুদ্ধ খাবার খেতে দিতে হবে। কারণ, বাইরের জুস, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবারে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে। গরমের সময় শিশুদের সর্দি-কাশি হতে পারে।
আইসক্রিম ও ফ্রিজের ঠান্ডা পানি এবং অত্যধিক ঘাম থেকে এসব হয়। ঘাম এড়াতে শিশুকে হালকা সুতির পোশাক পরানো দরকার। রোদে বের হলে মাথায় ক্যাপ এবং ছাতা ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন গোসল করানো দরকার, খুব ছোট শিশুদের এক দিন পরপর করানো যেতে পারে। নিয়মিত গোসল করালে ঘামাচি কম হয়। তেল দেওয়া একেবারে উচিত নয়। এ সময় শিশুর চুল ছোট রাখা ভালো। ছোট্ট মেয়েদের চুলে বেণি বা ঝুঁটি বেঁধে রাখতে হবে, এতে গরমে তারা স্বস্তি পাবে। ঘামে চুল ভিজে গেলে মুছিয়ে দিতে হবে, গোসলের পর যেন ভালোভাবে চুল শুকানো হয় খেয়াল রাখতে হবে।
গরমে পানিশূন্যতাও হতে পারে শিশুদের। বিশেষ করে স্কুলে বা খেলাধুলার সময়। ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়, চোখ ভেতরে দেবে যাওয়া, অস্থিরতা, প্রস্রাব কমে যাওয়া পানিশূন্যতার লক্ষণ। শিশুকে পর্যাপ্ত পানি, লেবুর শরবত, ডাবের পানি বা পানিসমৃদ্ধ ফল (যেমন তরমুজ, নাশপাতি, বাঙ্গি, কমলা, মালটা ) খাওয়াতে হবে। বাসায় ফোটানো পানিই দিতে হবে শিশুকে, নিয়ম মেনে বারবার দিতে হবে। দেখতে হবে শিশু যেন পানিশূন্যতায় না ভোগে। শিশু ক্লান্ত বা নিস্তেজ হচ্ছে কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
শিশুরা ঘরের বাইরে যেতে বা খেলাধুলা করতে পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তীব্র গরমের সময় শিশুদেরকে নিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ালে তাদের খুব সহজেই হিটস্ট্রোক বা ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। “শিশুদের জন্য ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা” করা ভালো। সকাল ১০টার পর থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ঘরের ভেতরেই খেলা করে সেভাবে ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুদের তাপের সরাসরি সংস্পর্শে যত কম নেওয়া যায় তত ভালো। ছাতা, ফুল স্লিভ বা সুতি ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরে বাইরে নিতে হবে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না নেয়া, গেলেও প্রখর রোদ এড়িয়ে যাওয়া উচিত। দুপুর শিফটের স্কুলগুলোকে সম্ভব হলে মর্নিং শিফটে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। বাইরে থেকে এসে প্রথমে ঘাম মুছে শরীরকে কক্ষ তাপমাত্রায় আনা প্রয়োজন। তারপর ফ্যান চালিয়ে শরীর ঠান্ডা করানো, গোসল বা গা মুছে ফেলতে হবে, পর্যাপ্ত তরল ও পানি পান করতে হবে।
এটা বিভিন্ন বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম, যেমন এক বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে বুকের দুধেই প্রয়োজনীয় পানি থাকে। ১-৩ বছরের শিশুদের সব খাবারের সাথে আলাদা পানি দিতে হবে। ৩ বছরের পর থেকে আলাদাভাবে হিসেব করে পানি দিতে হবে। তাজা রসালো ফল এবং চিনিবিহীন তাজা ফলের রস, দই থেকে তৈরি বিভিন্ন উপকরণ যেমন লাচ্ছি, ফ্রুট সালাদ, ফালুদা এসবের কোনো একটা দিতে হবে। সবকিছুই ঘরে তৈরি করতে হবে। সাধারণত শিশুরা একেবারে অনেকটা খেতে পারে না। তাই তাদেরকে অল্প করে বারবার দিতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশু যদি ঠান্ডা, অ্যালার্জি বা অ্যাজমায় আক্রান্ত না হয় অথবা এয়ার কণ্ডিশনারের প্রতি সংবেদনশীল না হয় তাহলে অবশ্যই এসি চালানো যাবে। কিন্তু তা যেন সার্বক্ষণিক না হয়।
লক্ষ্য রাখতে হবে যে শিশুর প্রস্রাবের মাত্রা ও পরিমাণ যেন ঠিক থাকে। শিশুর স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে কিনা, চামড়ায় কোনো দানা বা ফুসকুড়ি হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। পানিশূন্যতা বা তাপদাহের জন্য গা গরম হতে পারে, যা জ্বর নয়। এর পরেও যদি তাপমাত্রা না কমে, তবে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক: কনসালটেন্ট: নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।