খুলনা প্রতিনিধি
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর সমুদ্র বন্দর হলেও প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৭৩ বছর পরও রেল সংযোগ ছিল না, বন্দর প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছরে এসে খুলনা তথা সারাদেশের সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হচ্ছে মোংলা। ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় এই রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো। ট্র্যাক সংযোগ করছে আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে গত বছরের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ রেলপথের উদ্বোধন করেন। নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হলেও কারিগরি জটিলতা ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় এই পথ তখনও রেল চলাচলের উপযোগী ছিল না। যার ফলে উদ্বোধনের ৬ মাস পরেও ট্রেন চলাচল শুরু করা যায়নি। গত পয়লা মে খুলনা-মোংলা রুটের চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। রেলপথ চালু করতে এখন এ কেবল প্রয়োজন জনবল নিয়োগ। এরমধ্যে ৫৭৬ জন জনবলের অর্গানোগ্রাম তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও জনবল পাওয়ার বিষয়টি সহজ নয়, কারণ রেলওয়েতে এখন কর্মীর স্বল্পতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এজন্য এ পথে জনবল নিয়োগ করতে গেলে অন্য স্টেশনগুলো থেকে কর্মীদের এখানে বদলি করে আনতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ যত তাড়াতাড়ি রেলওয়ে উৎরাতে পারবে তত তাড়াতাড়ি চালু হবে এ রুটের ট্রেন। এ বিষয়ে খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, রেললাইন এখন প্রস্তুত রয়েছে। কবে রেল চলাচল করবে এটা প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবে না, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাজ ছিল লাইন প্রস্তুত করে দেওয়া। তবে যেকোনো সময় ট্রেন চলতে পারে বলেও মনে করছেন এই প্রকল্প পরিচালক। আর জনবল সংকট নিয়ে তিনি বলেন, এই রেলপথ পরিচালনা করার জন্য যে জনবল দরকার সেটি এখনো অনুমোদন হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যে আবেদন পাঠানো হয়েছিল সেটি এখনো প্রক্রিয়াধীন। এখনও তারিখ নির্ধারণ হয়নি জানিয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, এই মাস থেকেই চালু করার সম্ভাবনা রয়েছে। রেলপথ চালু করতে এখন স্টেশন মাস্টার ও অন্যান্য কর্মীর কেউ স্থায়ী নিয়োগ হয়নি। বিভিন্ন ভাবে তাদের জোগাড় করা হচ্ছে। রেলের একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত না হলেও চলতি মাসের যে কোনো দিন ট্রেন চলাচল শুরু করতে চায় রেলওয়ে। যার জন্য স্টেশনের আসবাবপত্র, রেলক্রসিংগুলোতে অস্থায়ী জনবল নিযুক্ত, ট্রেনের সময়সূচি, ভাড়া ও অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। রেল সূত্রে আরও জানা যায়, খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্প ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্যাকেজ-১ রেললাইন নির্মাণ, প্যাকেজ-২ রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু ও প্যাকেজ-৩ টেলিযোগাযোগ ও সিগন্যালিং সিস্টেম। এসব প্রকল্পের আওতায় মূল লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ। আর রূপসা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রেলসেতু। জমি অধিগ্রহণ, রেললাইন, রেলসেতু নির্মাণসহ প্রকল্পের প্রথমবার ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর ২০২১ সালে তৃতীয় দফায় আবারও বাড়ে প্রকল্পের সময় ও ব্যয়। তখন প্রাথমিক ব্যয়ের তিনগুণ বেড়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় চার হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। কিন্তু তৃতীয় দফায়ও শেষ না হলে চতুর্থ ও শেষবারের মতো ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হলেও সংশোধন করে সেটা আরও বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ধরা হয়। যদিও এ সময়ের মধ্যেও শেষ হয়নি প্রকল্পের সার্বিক কাজ। এর আগে গত রোববার রেলসচিব হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, এই লাইনে কারিগরি তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। এটা হস্তান্তরের একটি বিষয় থাকে, যখন একটি নতুন রেল লাইন হয় তখন রেলপথ পরিদর্শনের (জিআইবিআর) বিষয় থাকে। সেটি এপ্রিলের ৩০ তারিখ সম্পন্ন হলেই মে মাস থেকে রেল চলাচল শুরু করা যাবে। মোংলা সমুদ্র বন্দর শুধুমাত্র দেশের দ্বিতীয় বন্দরই নয় বরং এ বন্দরের সঙ্গে এখানে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ রেলপথ সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং মোংলা রেলস্টেশন থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার আরামদায়ক ভ্রমণের সুব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে কাজ করবে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে রেল সংযোগ না থাকায় মোংলা বন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। মোংলা বন্দরে রেল সংযোগ চালু হওয়ায় এবার সে সুবিধাও পাবে রেলওয়ে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসায়ীরা স্বল্প খরচে মোংলা বন্দর দিয়ে নিজ দেশে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে মোংলা বন্দর অচিরেই ‘গেম চেঞ্জারের’ ভূমিকায় আসতে পারে।