প্রতিদিনের ডেস্ক:
দীর্ঘদিন ধরেই নানান সমস্যায় ভুগছে দেশের আর্থিক খাত। একটি দেশের আর্থিক খাতের বিভিন্ন দিক থাকে। তার মধ্যে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যতম। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর খেলাপিঋণের কারণে দীর্ঘদিন ধুঁকছে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক ভালো অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা করুণ।অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার সঙ্গে উচ্চ খেলাপিঋণ, সবমিলিয়ে চরম আস্থার সংকটে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। ফলে একদিকে যেমন দিন দিন আমানত কমছে, অন্যদিকে আমানতকারীও হারাতে শুরু করেছে। যদিও ব্যাংকখাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে এরই মধ্যে পাঁচ দুর্বল ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে দুর্বল এনবিএফআইয়ের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় বাংলাদেশ ব্যাংক।সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো একীভূত করতে তাড়াহুড়ো শুরু হলেও অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো কথা আসছে না। আদৌ এসব প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আপাতত এনবিএফআই নিয়ে ভাবছে না তারা। এখন ব্যাংকগুলোর দিকে নজর, পরবর্তীসময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করা হতে পারে।তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো দুর্বল এনবিএফআই অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করে পলিসি নিয়ে এগোনোর পরামর্শ তাদের।স্থিতিশীলতা ফেরানোর কথা বলে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন ভাটা পড়েছে। একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া পাঁচ দুর্বল ব্যাংকের চারটিই এখন না বলছে। ডুবতে বসা পদ্মা ব্যাংক ছাড়া বাকি চার দুর্বল ব্যাংকই এর বিপক্ষে। এসব ব্যাংকের মধ্যে দুটি ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। বাকি দুই ব্যাংকের একটির কর্মকর্তারা আন্দোলনে নেমেছেন, ক্ষুব্ধ আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তারা। স্থিতিশীলতা ফেরানোর কথা বলে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন ভাটা পড়েছে। একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া পাঁচ দুর্বল ব্যাংকের চারটিই এখন না বলছে। ডুবতে বসা পদ্মা ব্যাংক ছাড়া বাকি চার দুর্বল ব্যাংকই এর বিপক্ষে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটির বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি। বহুল আলোচিত পিপলস লিজিংয়ে খেলাপির হার ৯৯ শতাংশ। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) বিতরণ করা ঋণের ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ খেলাপি। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। জিএসপি ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এফএএস ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ খেলাপিঋণ।অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বে লিজিংয়ের বিতরণ করা ঋণের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, হজ ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, আইআইডিএফসির ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ ঋণ এখন খেলাপি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ৪৩ দশিমক ১২ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের ৫০ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এখন ভাবছেন তারা। ব্যাংকখাতের সংস্কার বা স্থিতিশীলতা ফেরানোই মূল লক্ষ্য। এরপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেওয়া হবে।যদিও এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ও প্রিমিয়ার লিজিং অনাপত্তি (এনওসি) নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ দুই প্রতিষ্ঠান নিজেরাই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে প্রতিষ্ঠান দুটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা মতামত দিতে রাজি হননি।একীভূতকরণ একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি আছে, তবে জোরজবরদস্তি করে কারও ওপর তা চাপানো উচিত হবে না। চাপ দিয়ে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠান একীভূত করে খারাপকে ভালো করা যাবে না।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখন ব্যাংকখাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ করছি। ব্যাংক একীভূতকরণকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। দুটি এনবিএফআই প্রতিষ্ঠান নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছে একীভূত হতে। আমাদের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) কাছে নিজেদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের এনওসি দিয়েছে। ব্যাংকে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে আমরা এনবিএফআইতেও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করবো। কোনো প্রতিষ্ঠানকে জোর করা হচ্ছে না। সব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ উদ্যোগে একীভূত হতে আসছে।’যদিও যে পাঁচ দুর্বল ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে তার চারটিই না বলেছে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারাও একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে পুঁজি কমেছে বেসিক, পদ্মা, এক্সিম, বিডিবিএল, পূবালী, জনতা ও এবি ব্যাংকসহ ২৪ ব্যাংকের। এসব ব্যাংক থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) একীভূত হওয়ার কথা। অভিযোগ উঠেছে বেসিক, ন্যাশনাল ও বিডিবিএল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কোনো সম্মতি ছাড়াই এসব ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একীভূত হওয়ার বিষয়ে রাজি নয় বলে এরই মধ্যে জানিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন বোর্ড। এছাড়া একীভূত না হতে গভর্নর ও অর্থমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। একীভূতের বিপক্ষে আন্দোলনে নেমেছেন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) কর্মীরা।খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একীভূত করার নিয়ম রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দুই প্রতিষ্ঠানের সম্মতি ও সম্পদ যাচাই করতে হবে। কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই এটা করতে হবে। জোর করে একীভূত করলে এর ফল ভালো হবে না বলে জানান তারা।এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং আর্থিক খাত বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘একীভূতকরণ একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি আছে, তবে জোরজবরদস্তি করে কারও ওপর তা চাপানো উচিত হবে না। সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন চর্চার বিষয় রয়েছে। চাপ দিয়ে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠান একীভূত করে খারাপকে ভালো করা যাবে না।’কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবের একীভূতকরণের বিপক্ষে মত দিয়ে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘রাকাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উত্তরের কৃষি এগিয়ে নিতে। সে প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করা ঠিক হবে না।’

