১লা আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১৫ই জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

ইসরায়েলের গণহত্যা ও শব্দের আধিপত্য ৫ যুদ্ধাপরাধের অর্থ

মুনতাসীর মামুন
সম্প্রতি গণহত্যা জাদুঘরের এক সেমিনারে এসে কলকাতার ড. সাগর তরঙ্গ আমাকে একটি বই উপহার দিয়ে গেছেন। ভারতীয় সাংবাদিক শোভা ওয়ারিয়র অনেক নামকরা রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিভিন্ন সময়। বইটির নাম দিয়েছেন ব্যাটলফিল্ড ইন্ডিয়া: ২৫ ইয়ার্স অব পলিট্রিকস অ্যান্ড ইকোনোমিকস। ইংরেজিতে যে ভাবে পলিটিক্স Politics ও ইকোনোমিকস Economics লেখা হয় সেভাবে না লিখে ঠাট্টা করে লেখা হয়েছে Politricks and Economix. এখানে পলিট্রিক্স শব্দটি আমাকে আকর্ষণ করেছে। আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কি পলিটিক্স করেন? না করেন না, তারা tricks করেন।
পরে, মনে হলো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব দেশের রাজনীতিবিদরাই আসলে পলিটিক্স করেন না, পলিট্রিক্স করেন। পলিটিক্স করলে বিশ্বজুড়ে এ অবস্থা হতো না। আর প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট এ বিষয়টা সবার কাছে স্পষ্ট করে তুলেছে।
শোভা পলিট্রিক্স শব্দটা কবি বাবাতুন্ডে আরেম্যু থেকে নিয়েছেন। অবশ্য আগে যে কেউ এ শব্দটি ব্যবহার করেন নি তা নয়। অনেকে করেছেন। বাবাতুন্ডে লিখেছেন-
তারা সত্য জানে
তারপরও সত্যকে চ্যুত করেছে
তারা সত্য দেখছে
কিন্তু সত্যের কাছে অন্ধ
তারা সত্য লুকোয়
সত্য বলার ঝোঁক অসম্ভব
তবে সত্যকে অস্বীকার করে
তারা সত্য [র কথা] প্রচার করে
অবগুনঠনে ঢাকা তাদের সত্য
সেটি পুস্ট পলিট্রিক্স দ্বারা
এটিই তাদের সত্য
সুতরাং, তাদের ঠোঁটের ভাষা পড়
যখন তারা সত্য বলে।
এককথায় রাজনীতিবিদরা সত্য সত্য করে আর মিথ্যা মিথ্যা বলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়। বা চতুরামী বা পলিট্রিক্স করে নিজ স্বার্থ জিইয়ে রাখা যায়। একথা মনে হলো আইসিসি বা হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের হামাস ও নেতা নেহানুর বিরুদ্ধে প্রসেকিউটরের আবেদন দেখে।
প্যালেস্টাইনি হলোকাস্ট বন্ধের জন্য জাতিসংঘের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আদালত বা আইসিজের কোনো অনুরোধ, আদেশ-নির্দেশ ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র মানে নি। জাতিসংঘের সব সদস্যদের এই আদালতের নির্দেশ মানা উচিত। কিন্তু, তারা মানেনি এবং ঐ আদালতের এমন কোনো শক্তি নেই সে নির্দেশ কার্যকর করার। আসলে কোনো আদালতই তার নির্দেশ কার্যকর করতে পারে না নির্বাহী বিভাগের সহযোগিতা ছাড়া। নির্বাহী বিভাগ কিছু মানে কিছু মানে না। এটি একটি প্রতীকী ব্যবস্থা এবং তা মানা না মানা নির্ভর করে নৈতিক মানদন্ডের ওপর। এ মানদন্ড সার্বজনীন হলেও প্রত্যয়টি নির্মিত পাশ্চাত্যের রীতিনীতি, সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে।
আমার স্বদেশি ও বিদেশি বন্ধুরা গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা করেন। তারপর বিষয়টি এমন নির্বস্তুক করেন যে, আমরা বিভ্রান্ত হই। লেমকিনের সংজ্ঞা থেকে আইসিসির সংজ্ঞা তারা আওড়াতে থাকেন। আমি এদের সঙ্গে তর্ক করি না। আমি গণহত্যা দেখেছি, আমাকে গণহত্যার সংজ্ঞা বোঝাতে হবে না। মান্ধাতা আমলের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিয়ে বর্তমানে কৃৎকৌশলগত উন্নতির আলোকে চলা রাষ্ট্রসমূহে তা অচল। ধরা যাক, বাংলাদেশের গণহত্যা।
এখন বলবেন, হাড়ের ফরেনসিক রিপোর্ট লাগবে, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য লাগবে, সেটি এথনিক ক্লিনজিংয়ের পড়ে কিনা সেটি নিয়ে বিতর্ক লাগবে, তারপর ৪০ বছর আদালতে বিচার চলে এমন একটি রায় দেয়া হবে যা হ্যা-ও হতে পারে নাও হতে পারে। নুরেমবাগে তা হয়নি। কারণ, সুপার পাওয়াররা সব একদিকে, তারা যে ভাবে চেয়েছেন সে ভাবে দ্রুত বিচার ও রায় কার্যকর হয়েছে। বিজয়ীরা জানিয়েছিলেন, বিজয়ীরা যা বলবেন তাই সত্য। নাজীরা এমন বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল যে সারা বিশ্ব তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু, এখন কেন এত দ্রুত বিচার হয় না বা রায় কার্যকর করা যায় না? কারণ, সুপার পাওয়াররা সব বিষয়ে একমত, আর সুপার পাওয়ারদের মধ্যে এক নম্বর আমেরিকা। তাদের ওপর ইসরায়েল।
সুতরাং, আমেরিকা বা ইসরায়েল যা বলে তা মানতে বাধ্য হয় বিশ্ববাসী। এখন যে, সুপার প্যালেস্টাইনি হলোকাস্ট চলছে কোন সুপার পাওয়ার বা লিটল পাওয়ার এর সরাসরি বিরোধিতা করেছে? আমি দেখেছি, ১৯৭১ সালের নয় মাস জুড়ে প্রতিদিন কী ভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। বুলেটের খরচ বাঁচাবার জন্য নদীপাড়ে এনে জবাই করে লাশ ফেলা হয়েছে। খুলনায় সৈয়দপুরের পাটকল, রেলওয়ে ওয়ার্কশপে বয়লার বা জলন্ত চুল্লিতে মানুষ ফেলে হত্যা করা হয়েছে।
যারা ঐ সময় ছিলেন তারা তা দেখেছেন, জেনেছেন, শ্রুতিতে ধারণ করেছেন, পরবর্তীকালের জন্য জ্ঞান রেখে গেছেন। এখন আমাকে ফরেনসিক রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী আনতে বললে তো হবে না। এ কারণেই বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচারের সময় ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য আইন বদল করতে হয়েছিল। বর্তমানে, নানাবিধ সংজ্ঞা দেখে মনে হয় ঝাড়– মারো ঐ সব সংজ্ঞায়। বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল, তাই গণহত্যা জাদুঘর হয়েছে, এটিই প্রমাণ করে এখানে গণহত্যা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মান সরকার তা মানল কিনা কী আসে যায়! আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে এতো হাহাকারের কী আছে! খুলনার গণহত্যা জাদুঘর দেখে অনেক মার্কিন, পাশ্চাত্য, চিনা এমনকী পাকিস্তানিরা বিস্মিত হয়েছে, ঝিম মেরে বসে থেকেছেন এবং তাদের পূর্বসূরিদের অভিশাপ দিয়েছেন। এটিই স্বীকৃতি।
ইতিহাস বেঁচে থাকে স্মৃতিকে ভিত্তি করে। আমাদের অপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল নিয়ে পাশ্চাত্যে অনেক কথা হয়েছে, বিতর্ক করেছেন অনেকে এর স্বচ্ছতা নিয়ে। কিন্তু, সে সব উপেক্ষা করে বিচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন তারা নিশ্চুপ এ কারণে যে, এটি তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এবং সে গণহত্যার অংশীদার তারাও ছিল। ভাগ্য ভাল বাংলাদেশ তাদের সে অপরাধের জন্য তাদের ওপর দায় চাপায়নি।
ভূমিকা দীর্ঘ হয়ে গেল, এ পটভূমি বিবেচনায় না নিলে বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা অস্পষ্ট থেকে যাবে। আলোচনাটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে।
যখন আন্তর্জাতিক বিচারালয় সমূহ হয়, সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল যে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। কিন্তু, বিশেষজ্ঞ জটিল আইনের কারণে, বিচার হতে ৫-১০ বছর লেগে যাচ্ছে ফলে এসব বিচার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। পাশ্চাত্য তাদের ‘ন্যায় বিচার’ প্রতিষ্ঠায় এগুলি করলেও এমন সব জটিল আইন করেছে যার ফলে বিচার দীর্ঘ দিন চলে এবং তা প্রাসঙ্গিকতা হারায়। তাহলে ‘ন্যায় বিচার’ও হলো, সাধারণ তাতে আগ্রহও হারালো, প্রাসঙ্গিকতাও রইল না। কারণ, সব গণহত্যাইতো পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষার প্রকল্প। লক্ষ্যণীয় যারা অধিকাংশ গণহত্যার মদত দাতা তারা এ সমস্ত আদালতের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ইসরায়েল এমনকী ভারতও। শেষোক্ত দেশটি কোন যুক্তিতে করেনি তা জানি না।জাতিসংঘের আইসিজে ইসরায়েলকে বলেছে, রাফায় আগ্রাসন বন্ধ করতে, বর্ডার খুলে দিতে। ইসরায়েল সেটি মানে নি। এবং মার্কিন এক জন প্রতিনিধি বলেছেন, গুলি মারো ঐ সব প্রস্তাবে।
নানা কারণে আই সি সিকে গণহত্যা কিছু স্বীকার করে নিতে হয়। বিচারকদের অধিকাংশ পাশ্চাত্যের বা পাশ্চাত্য ঘেঁষা হলেও অনেকেই আছেন আফ্রিকা, এশিয়ার। তাদের পূর্বসূরীরা ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন। এই অনুভব তারা একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেন নি। সবাই বিবেকহীন বা পাশ্চাত্যের অদৃশ্য ডিকটাটই মানেন তাও নয়। কিন্তু, পাশ্চাত্যের কারণেই এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাতে বাইরে বলা যায়, এটা নিরপেক্ষ। তাই রায় ঘোষণার ব্যাপারে তারা কতো সাবধানী এর উদাহরণ দিচ্ছি।
আই সি সির প্রসিকিউটর হামাস এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানার দাবি জানিয়েছেন। প্রসিকিউটর জানেন, হামাসের তিন নেতার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি না করলে পাশ্চাত্যের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। হামাসের অপরাধ, স্পষ্টভাষায় ‘ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড ক্রাইমস অ্যাগেইনিস্ট হিউম্যানিটি’।
হামাস নেতাদের সরাসরি যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নেতানেয়াহু ও তাঁর যুদ্ধ মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে তবে অনেক কিছু বলে- যেমন, সিভিলিয়ানদের ক্ষুধার্ত রাখা যা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ, ইচ্ছাকৃত হত্যা এবং দুভোর্গের সৃষ্টি করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ইত্যাদি। নেতানেয়াহু পৃথিবীর কারো কোনো কথা না শুনে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যাপক ভাবে, সেখানে ক্ষুধার্ত বা ধ্বংসযজ্ঞ কোনো অপরাধ হলো সে তুলনায়।দুর্ভিক্ষ আগে গণহত্যার মধ্যে ছিল না। এখন অন্তর্ভুক্ত করা আছে। ১৯৪৩ সালে বাংলার মন্বন্তর চার্চিলের সৃষ্টি। সুতরাং, তিনিও গণহত্যাকারী। এ বিষয়ে আমাদের তেমন জ্ঞান ছিল না, আমি ও অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদের কিয়েভে হলদোমোর গণহত্যা জাদুঘর দেখতে গিয়েছি।
সেটির মূল বিষয়, স্টালিন আমলে মন্বন্তরে নিহতদের স্মৃতি তুলে ধরা এবং এর জন্য রাশিয়া দায়ী সেটি তুলে ধরা। এটি হলো পলিট্রিক্স। যদি তারা বলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এখানে নাজি ও নাজি সমর্থকরা ইহুদী ও নাজী বিরোধীদের ওপর যে গণহত্যা হয়েছিল তা নিয়ে জাদুঘর। তাহলে বলতাম ন্যায্য হয়েছে বা পলিটিক্স, যদিও অনেকে এখন এই শব্দটিকেও ঘৃণা করেন।পৃথিবীতে এই প্রথম সরাসরি প্রতিদিন মানুষ গণহত্যা বা প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট দেখছে যা আগে কখনও কেউ দেখেনি। বাইডেন ও সুনাক ছাড়া ঐ ভাবে কেউ হামাসের বিরুদ্ধে বলেন নি। প্রসেকিউশন বলেছে হামাস ১২০০ জন হত্যা করেছে। কিন্তু সেটা ইসরায়েলি ভাষ্য।
ঐ ভাবে মৃতদেহও ইসরায়েল দেখাতে পারে নি। ইসরায়েল ছাড়া হামাসের ধর্ষণের কথা কেউ বলে নি। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যে সব প্রচারণা চালিয়েছে তার অধিকাংশই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু হামাস দোষী। ব্যাপারটা এরকম- হামাস যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী, হ্যা, ইসরায়েলও দায়ী বলতে পারেন তবে তেমনটা নয়।
হামাস দোষী হলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নয় কেনো? তারা সরাসরি ইসরায়েলকে গণহত্যায় উসকানি শুধু নয়, অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে, প্রকাশ্যে করছে, লুকোছাপা নেই তাতে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তরুণরাই বাইডেন, ব্লিনকিন, অস্টিনকে যুদ্ধাপরাধী বলছে।
মূল বক্তব্য এই, সরাসরি গণহত্যার দৃশ্য দেখানোর পরও সাক্ষ্য প্রমাণ লাগবে, বিচারকদের মন যোগাতে হবে, বিশ^রাজনীতির কথা ভাবতে হবে। এটিই পলিট্রিক্স। মনে হয় পাশ্চাত্যের সব প্রতিষ্ঠানই যা আমাদের কাছে ছিল আদর্শ তা এখন পলিট্রিক্সের শিকার।
প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট অন্তত একটি বিষয় তুলে ধরেছে এবং তাতে বিশ্ববাসীর লাভ হয়েছে। তাহলো পাশ্চাত্যের জ্ঞান-গরিমা, মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ যার কথাই বলুক না কেনো সেটি দুই নম্বরী। বিশ্বে তারা যে ইমেজটি গড়ে তুলতে চায়, তাহলো তারা বিনয়ী, ধর্মপ্রাণ ককেশিয়; তাদের সংস্কৃতির ভিত্তি মানবতা, মানবাধিকার রক্ষা। এ ভাবে তারা বিশ্বসভ্যতা বাঁচাতে চায়। এর বাইরে কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু, পুরোটা ভাঁওতাবাজি।
যেমন, জার্মানীতে তদন্ত চলছে, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের নির্যাতনকারী রয়েছে। এটি শাস্তিযোগ্য। শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ কি থাকতে পারে? র্যাবের দু’একজন অফিসারকে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পাঠানো হয়েছে। তাতে বিশ্বশান্তি ক্ষুন্ন হতে পারে।অথচ, এই জার্মানী প্যালেস্টাইনি গণহত্যায় প্রায় ৪০ হাজার খুন সমর্থন করে বিবৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশকে আমেরিকা লাইনে আনতে না পেরে তার চাকর-বাকরদের দিয়ে আপাতত হুমকি দিচ্ছে। যেমন, জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নেতানেয়াহুকে নয়, যদিও সারা বিশ্ব জানে নেতানেয়াহু নিরস্ত্র মানুষের রক্তে স্নান করছে প্রতিদিন।
এই দু’নম্বরী ব্যাপার সেটি বিশ্বের তরুণরা অবলোকন করছে। খোলস ছেড়ে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য বেরিয়ে এসে বলছে, তারা যা বলছে ও করছে তা সমর্থন করতে হবে নয়ত তাদের দমন করা হবে। পুতিন কোথায় গণহত্যা করলেন জানিনা। প্রকাশ্যে তা দেখানোও হয়নি। কিন্তু পুতিনকেও যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে। এবং আমেরিকা ও পাশ্চাত্য তাতে উল্লাস প্রকাশ করেছে। এখন আই সিসি গ্রেফতার আদেশ দেয়নি ও প্রসিকিউটার মাত্র ওয়ারেন্ট জারির নির্দেশ চেয়েছেন তাতেই ক্ষুব্ধ আমেরিকার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা। আমেরিকায় আসলে তৃতীয় একটি দলের আবির্ভাব হওয়া দরকার যারা গণহত্যায় বিশ্বাস করে না। আসলেই মানবতায় বিশ্বাসী।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তো বটেই, আমেরিকায়ও তরুণরা মাঠে নেমেছিল। আমরাও ভিয়েতনামের সমর্থনে মিছিল করেছি। ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে পুলিশ আমাদের মিছিলে গুলি চালায়। আমার পাশের ছাত্রটি গুলি খেয়ে মারা যায়। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। তাদের স্মরণে হাইকোর্টের মোড়ে আমরা একটা ফলকও লাগিয়েছিলাম।
ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়েছে। তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। পলিট্রিক্সের কারণে তাদের স্মারক স্তম্ভটিও উপড়ে ফেলা হয়েছে যাতে এর স্মৃতি কারো মনে না থাকে। পৃথিবীতে কয়েকশো বছর ধরে এমন চলছে। হত্যা, নিপীড়ন গণহত্যার বিরুদ্ধে তরুণরা নেমেছে, তাদের মিছিল স্ফীত হয়েছে। এবং হত্যাকারীরা পালিয়েছে, এটিই পলিটিক্স যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করেছিলেন।
ষাট-সত্তর দশকে ইউরোপীয় তরুণরাও মাঠে নেমেছিল। বাধ্য করেছিল তাদের যুদ্ধবাজ নেতাদের। একটু সময় লাগবে, কিন্তু, যুদ্ধবাজদের নিয়তি পতন, এটি ইতিহাসের সাক্ষ্য। এই তরুণরাই একদিন প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট মেমোরিয়াল গড়বে এই ইউরোপ ও আমেরিকাতেই যাতে মানুষ মনে রাখে যুদ্ধবাজরা আসলে মানবাধিকার, মানবতার নামে কীভাবে সভ্যতা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ের প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকা হাত কামড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারে নি। এবং এসব আইন কানুন ও প্রতিষ্ঠান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে, ফলে তারা আরো সাধারণ মুখি হবে, অনেক প্রত্যয়ের সংজ্ঞাও বদলাবে। আমাদের তরুণদের এখন সময় এসেছে- এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা, যাতে সব কিছু বদলে দেয়া যায়। বলা দরকার পৃথিবীর তরুণরা এক হও। যুদ্ধবাজদের হটিয়ে সভ্যতা রক্ষা করো আর সভ্যতা রক্ষার অন্যতম সূত্র স্মৃতি রক্ষা করো। সে জন্য এখনই উদ্যোগ নাও প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট স্মৃতি রক্ষায়। আগের থেকে তা অনেক সহজ কৃৎকৌশল গত কারণে। যুদ্ধবাজদের তৈরি এসব কৃৎকৌশল ব্যবহৃত হোক, ইতিহাস রক্ষায়। পলিট্রিকসের ধ্বংস সাধনই প্রত্যেকটি প্রত্যয়ের মূল অর্থ রক্ষা করবে।
লেখক: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়