বিশেষ প্রতিবেদক
যশোরে প্রায় ১৪ হাজার পুকুর ভরাট করা হয়েছে। খবর মিলেছে এখনো পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩০ ফুট ভেতরে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে এবং উত্তর পাশে প্রায় ২৫ ফুট দিঘির জায়গা ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে পৌর হেরিটেজ মার্কেট। এসব কারণে দেখা দিয়েছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। বেড়েছে খরা ও তাপমাত্রা। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কার্যকরী উদ্যোগ না থাকায় বিগত বছরগুলোয় পুকুর ও জলাশয় ভরাটের মহোৎসব চলেছে। প্রশ্ন উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে। তারা অফিসে বসেই বেতন-ভাতা ভোগ করছেন নাকি বিশেষ ব্যবস্থায় নিরব থাকছে-এ প্রশ্ন এখন সর্বমহলের। গত কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রার পারদ যশোরে সর্বোচ্চ হচ্ছে। মধু মাসেও ভ্যাপসা গরমে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। ফ্যানের বাতাসে হিম নেই। যেন উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। মানুষসহ প্রানীকুল একটু স্বস্তির জন্য এদিকে-ওদিক ছুটছে। এসবের নেপথ্যের কারণ পুকুর ও জলাশয় ভরাট এবং গাছ খেকোচক্রের হাজার হাজার গাছ কর্তন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়-গত এক যুগে পুকুর ও জলাশয় ভরাটের রেকর্ড গড়েছে যশোর। শহর ও শহরতলীতে ভরাট হয়ে গেছে একশর বেশি পুকুর। আর যশোর পৌরসভার মধ্যে এক ডজন পুকুরের ওপর এখন শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবন। এ ছাড়া যশোরে ভৈরব নদ পুনঃখননের সময় দুই পাড় এলাকার বসতিরা ঠিকাদারের কাছ থেকে মাটি ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে শতাধিক পুকুর ভরাট করিয়ে নিয়েছেন। এদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, পুকুর ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় যশোরে দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা বিপর্যয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় তাপপ্রবাহ বেশি। জলাধার কমে যাওয়ায় নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। তারা বলছেন- পুকুর ও জলাশয় তাপ ধারণ করে। পুকুর ও জলাশয়ে জলীয়বাষ্প তাপমাত্রা ও পরিবেশের একটি ব্যালেন্স রাখে। পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী জেলাটিতে পুকুর ছিল ৫৩ হাজার ৯৪২টি। বর্তমানে জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী যশোরে পুকুরের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ১২৯টিতে। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে যশোরে ভরাট হয়ে গেছে ১৪ হাজার পুকুর। এ ছাড়া যশোর পৌরসভার তথ্যানুযায়ী, পৌরসভা এলাকায় পৌরসভার নামীয়, জেলা প্রশাসকের নামীয় ও বেসরকারি মিলে ৩২০টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে পৌরসভার ৬টি, জেলা প্রশাসকের ৪০টি এবং বেসরকারি ২৭৪টি পুকুর রয়েছে। ১০-১২ বছর আগে পুকুরের সংখ্যা আরো বেশি ছিল। ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু জানান, যশোর পৌরসভা এলাকায় শহরের ঐতিহ্যবাহী প্রায় সব পুকুর তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বিগত এক থেকে দেড় যুগে ভরাট হয়ে গেছে যশোর হেডপোস্ট অফিসের সামনের পুকুর, যশোর রেলগেট চোরমারা দীঘি, নিরালা সিনেমা হলের পাশের পুকুর, বেজপাড়ার শ্রীধর পুকুর, আরবপুরের বড় পুকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সড়কের ইসমাইল ডাক্তারের বাড়ির পেছনের বড় দীঘি (বাগমারা পুকুর), ইসলামি স্কুলের পুকুর, পুরাতন কসবা আবু তালেব সড়কের পুকুর, ডাক্তার মোজাম্মেল হোসেনের পুকুর, মন্টুদের পুকুর, নিরিবিলি পুকুর, রাজুদের পুকুর, মুন্সীবাড়ি পুকুর, আয়নাল খাঁর পুকুর, জব্বার বিহারির পুকুর, গোহাটা পুকুর, রাজবাড়ি বিদ্যুৎ অফিসের সামনের পুকুর, মুজিব সড়ক বাইলেনে কথিত বৃদ্ধাশ্রম তৈরির নামে পুকুর দখল, ষষ্ঠিতলাপাড়ায় ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের পুকুর, খালধার সড়কের পুকুরসহ শহরের ভেতরে থাকা আরো কিছু পুকুর এখন সমতল ভূমি। প্লট আকারে বিক্রিও হচ্ছে। তিনি বলেন, গত চার বছরে ভৈরব খননকে পুঁজি করে ঠিকাদার নিযুক্ত লোকজন ও কয়েকটি দালাল চক্রের লোকজনের মধ্যস্থতায় নদ পাড় এলাকায় শতাধিক পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পরিবেশে আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন এলাকার পুকুর শূন্য করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধা উপেক্ষা করে ভৈরব নদে চলা ড্রেজার মেশিন দিয়ে দীর্ঘ পাইপ লাগিয়ে বালি কাদা মাটি তুলে পুকুরগুলো ভরাট করা হয়। যশোর শহরের চোরমারা দীঘির পাড় এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা শাহাজান ওমর জানিয়েছেন, বিশালাকার এক দীঘির কারণে এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল চোরমারা দীঘির পাড় এলাকা। সে দীঘিটি ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। বহুতল ভবনও হয়েছে কয়েকটি। ওই পুকুরটি দৈনন্দিন নানা কাজে লাগত।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ছোলজার রহমান জানিয়েছেন, এমনিতে এপ্রিল মে জুন প্রচণ্ড গরমের মাস। এর আগে অব্যাহত পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে এ অঞ্চলকে উত্তপ্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এবং মহল বিশেষের অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শীভাবে পুকুর এবং জলাশয় ভরাট করে গরমকে স্বাগত জানানো হয়েছে। দিনদিন তাপপ্রবাহ বাড়ছে। একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য পুকুর বা জলাশয় অপরিহার্য। কিন্তু সাময়িক কিংবা স্বল্পমেয়াদি লাভের তাড়না ও লোভ-লালসায় জলাশয়গুলোকে গলা টিপে হত্যা করে হচ্ছে অব্যাহতভাবে। কোনো পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা যাবে, আর কোনোটা একেবারেই যাবে না সে ধরনের কোনো সচেতনতা বা নির্দেশনা আমলে নেওয়া হয়নি। যে পুকুরগুলো এখনো আছে, তা রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে পরিবেশের ভারসাম্য আরো হুমকিতে পড়বে। তাপপ্রবাহ আরো বাড়বে, দুর্বিষহ জীবন আসবে। গ্রিন ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন যশোরের নির্বাহী পরিচালক আশিক মাহমুদ সবুজ জানিয়েছেন, যশোরে একে একে পুকুর ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিগত সময়ে হাজার হাজার জলাধার ভরাট হয়েছে। এখন আর কিছু বাকি নেই বললেই চলে। এখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়েছে পুকুর না থাকায়। এতে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। আর জলাধার না থাকায় ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে সাইকেলটি পূর্ণ হতে পারছে না। যার প্রভাবে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। তাপপ্রবাহ বাড়ছে। জলাধার ও পরিবেশ রক্ষার আইন আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক নুর আলম এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শীভাবে এ অঞ্চলে পুকুর খাল নালা জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব পুকুর খাল বিল দীঘি ও জলাশয়ের পানি চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মেশে। এতে পানির স্তর নিচে নামা রোধ হয়। আবার তাপমাত্রাও কম থাকে। কেননা পুকুরের পানি তাপ ধারণ করে। যে কারণে তাপমাত্রা সহনীয় থাকতে সহায়তা করে। পুকুর কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলেও জানান তিনি। তবে পুকুর বা জলাশয় ভরাটের বিষয়ে তাদের কাছে অভিযোগ না আসলে সাধারণত অভিযান চালানো হয় না। পুকুর বা জলাশয় ভরাট হয়ে পরিবেশের ওপর প্রচণ্ড প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। জলজ প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষাও ব্যাহত হচ্ছে। গরম ও পরিবেশ সহনীয় রাখতে বাকি জলাশয়গুলোকে রক্ষা এখন খুবই প্রয়োজন। যশোরের কেউ পুকুর বা জলাশয় ভরাট করতে উদ্যোগী হলে তার দপ্তরে অভিযোগ করতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩০ ফুট ভেতরে পৌরসভার উদ্যোগে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। লালদীঘি ধ্বংস করতে মঞ্চটির স্পর্শ কাতর নাম দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে। একই উত্তর পাশে প্রায় ২৫ ফুট দিঘির জায়গা ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে পৌর হেরিটেজ মার্কেট। এ দুটি স্থাপনা নির্মাণের সময় পৌর এলাকার সচেতন নাগরিকরা আন্দোলন সংগ্রাম এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞায় দীঘি সম্পূর্ণ ভরাট করতে না পারলেও কৌশলে দীঘির প্রায় ৫৫ ফুট জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। যশোর ঐতিহ্য রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোটের মাহমুদ হাসান বুলু বলেন, এভাবে যশোরের পুকুরগুলো ভরাট হওয়ায় প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বেশকিছু প্রভাবশালী এসব অপকর্মের মাধ্যমে প্লট ব্যবসায় মেতেছেন।

