১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

বাজেটটি প্রাসঙ্গিক, তবে প্রান্তজনের জন্য আরো কিছু করার ছিল

ড. আতিউর রহমান
শেষ পর্যন্ত একটি প্রাসঙ্গিক বাজেটই দেয়া হয়েছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বাস্তবায়নের কৌশল ততটা স্পষ্ট নয়। সমস্যা চিহ্নিত ঠিকই করা হয়েছে, কিন্তু কী করে দেড়-দুই বছর ধরে ঘাড়ের ওপর চেপে বসে থাকা ৯ শতাংশের বেশি হারের মূল্যস্ফীতিকে আসছে অর্থবছরের মধ্যে টেনে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে, সে কথাটি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি যেখানে ১০ শতাংশেরও বেশি, সেখানে খাদ্যসহ কিছু কিছু নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের শুল্ক হার ১ শতাংশ কমিয়ে এবং কয়েকটি পণ্য খোলা বাজারে কম দামে বিক্রি ও সামাজিক সুরক্ষার চৌহদ্দি খানিকটা বাড়ালেই তা বাগে আনা যাবে- এমনটি আশা করা ঠিক হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন এই বেয়াড়া মূল্যস্ফীতিই এই সময়ের মূল সমস্যা। অর্থমন্ত্রীও মনে করেন এ সমস্যা সমাধানে সময় লাগবে। আসলেই এটি খুব সহজেই সমাধান করা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন না। চারদিক থেকে একে আক্রমণ করতে হবে। আর সব খাতের নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারীদের এ প্রশ্নে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বৈদেশিক অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও আমাদের নীতি অবহেলায় টাকার দাম কমে গেছে। কোভিডকালে যেভাবে তারল্য বাড়িয়েছিলাম, তাও সময়মতো মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করে দ্রুত তুলে নিতে দ্বিধায় ছিলাম। এসবের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের যে ভূত বোতল থেকে বের হয়ে গেছে, তাকে ফের বোতলে ভরা যে মোটেও সহজ হবে না, সে কথাটি আমাদের মানতেই হবে। ঘরে ও বাইরের এসব চাপ সামলাতে এবার যে সংকোচনমূলক বাজেটটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাকে কেউই অপ্রাসঙ্গিক বলছে না। শুধু সংশয় জটিল এই অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এর অর্থায়ন কী করে করা হবে- সেই বিষয়টি নিয়ে। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বাজেটের আকার ছোট করার প্রচেষ্টাকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। এর ফলে যে এ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমতে পারে, তাও সবার জানা। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ৫ অর্থবছরে প্রতিটিবার আগের বছরের সংশোধিতের তুলনায় বাজেট বেড়েছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে আসছে বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি ২০২৩-২৪-এর প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তথা এডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে আরো কম (১ শতাংশেরও কম)। বিরাজমান বাস্তবতায় এডিপিতে বেশি বেশি প্রকল্প বাবদ ব্যয় বরাদ্দ না রাখার চেষ্টাকেও স্বাগত জানিয়েছেন বাজেট পর্যবেক্ষকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে থেকেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করছে। রাজস্বনীতিতে এই সময়োচিত সংকোচনমুখিতাকে তাই স্বাগত জানানোরই কথা। বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে হলে এর কোনো বিকল্প ছিল না। তাছাড়া এডিপিতে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ছোটখাটো যেসব প্রকল্প এখনো রয়ে গেছে, হয় বাদ দেয়া অথবা সেগুলোর অযথা মেদ ঝেরে ফেলার উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ কিন্তু এখনো রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন চাইলেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে কোন কোন প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় এবং এই বছর বাস্তবায়ন না করলেও চলবে, তা চিহ্নিত করতে পারে। সেই পরামর্শ মতো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিকে আরো আঁটসাঁট নিশ্চয় করা সম্ভব। তাতে বাজেটের অর্থায়নের চাপ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখাই এখন প্রধানতম অগ্রাধিকার। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে এতটা মাথা ঘামানোর সময় এটা নয়। তবুও বিরাজমান বিনিয়োগ খরার মধ্যেও ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন আসলেই দুরূহ হবে। কেননা প্রবৃদ্ধিকে বলশালী করতে ব্যক্তি খাতের স্থবির বিনিয়োগের প্রেক্ষাপটে সরকারি খাতে ব্যয়েই মূলত ভরসা রাখতে হবে। বাড়তি ব্যয়ের চাপ না নিলে, বাজেট ঘাটতি হয়তো আরো কম রাখা যেত। তাতে অন্তত দেশীয় ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমত। জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাজেট ঘাটতি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থাকায় এই ঘাটতির অর্ধেকের বেশি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হবে। আশা করি লক্ষ্য যাই থাক না কেন শেষ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি আরো খানিকটা কমানোর চেষ্টা সরকার করবে। আগের সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে বেশি বেশি ঋণ নিয়েছে বলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই পরিবেশেও তা করাটা অযৌক্তিক হবে না বলাটা সঠিক নয়। এখন সময়টা যে বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ কথা মাথায় রেখে নীতিনির্ধারকদের উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করাটাই যৌক্তিক হবে।
জিডিপির শতাংশ হিসেবে ঘাটতি প্রতি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করে কমানো গেলে ব্যাংকের সম্ভাব্য ঋণ প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা করে কম হতে পারে। ঘাটতি ৪ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে যদি ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতো, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিতে হতো মাত্র ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো। সরকার ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিলে, ব্যক্তি খাতের জন্য ঋণ সহজলভ্য হতো। বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী সুদ হারের প্রেক্ষাপটে তা বিশেষভাবে কাম্য। ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহ ব্যাহত হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে কম গতির রাজস্ব সংগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি ঋণের সুদ শোধ করার চ্যালেঞ্জটি যেভাবে জোরালো হচ্ছে, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আর এসব বাস্তবতার আলোকেই মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যকেও বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে। ব্যয় সংকোচন করেই এ লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। কৃচ্ছ্রসাধনের নীতিকে ছাড় দেয়ার সময় এখনো আসেনি। সে জন্য বাজেট ঘাটতি আরো কমিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে নিয়ে রাজস্ব আহরণের হার বাড়াতে হবে। সংকুচিত আমদানির পরিবেশে গতানুগতিক শুল্ক নির্ভর রাজস্ব আহরণের ওপর নির্ভরশীলতার সুযোগও কমে গেছে। টাকার অবমূল্যায়নে শুল্ক বেড়েছিল। কিন্তু এখন তো বিনিময় হার স্থির হওয়ার পথে। তাই রাজস্বের নতুন উৎসের সন্ধান করে যেতেই হবে। এমন বাস্তবতায় এবারের বাজেটে রাজস্ব বোর্ডের ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তার মাত্র ৩৭ শতাংশের মতো আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে। উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমানোর পথে বড় বাধা। রাজস্ব বোর্ড তাদের লক্ষ্যমাত্রার ৬২ শতাংশের জন্যই নির্ভর করবে পরোক্ষ করের ওপর। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে মোট কর আয়ের ৭০-৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে। প্রতিবেশী ভারতেও মোট কর আয়ের ৫০ শতাংশের মতো প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে গতানুগতিকতা থেকে বেরুনো এখনো সম্ভব হয়নি। বর্তমানে যারা কর দিচ্ছেন, তাদের ওপর আর বোঝা না চাপিয়ে নতুন করদাতাদের যুক্ত করাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা, ডিজিটালাইজেশনসহ পুরো রাজস্ব আহরণ কাঠামোকেই ঢেলে সাজানো দরকার। অবশ্যই বাজেটে প্রযুক্তির ব্যবহারে ভ্যাটসহ রাজস্ব সংগ্রহের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এদিকটায় আরো বেশি নজর দিলে কর-জিডিপির হার নিশ্চয় বাড়ানো সম্ভব। ব্যাংকিং খাত অনেক আগেই স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। নতুন করে ডিজিটাল ব্যাংকও চালু হয়ে গেল। তাহলে রাজস্ব জগতে স্বয়ংক্রিয়তায় এতটা অনীহা কেন? বাজেটে কাটছাঁট করা ছাড়া আসলে অন্য উপায় ছিল না। তবে এই কাটছাঁট থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির মতো সামাজিক খাতগুলোকে যতটা মুক্ত রাখা যায়, ততই মঙ্গল। তার যে চেষ্টা করা হয়নি, সে কথাটি বলা ঠিক হবে না। অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে জনগণকে সুরক্ষিত করতে সামাজিক খাতে সম্পদ সরবরাহ বলশালী করার দিকেই বরং বেশি মনোযোগ দেয়ার যে দরকার, সে কথাটি নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তারাও বোঝেন যে শিক্ষা খাতের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে এ খাতের বরাদ্দের অনুপাত আরো বাড়ানো উচিত। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো পেরে ওঠেননি। বরাবরের মতো মোট বাজেটের প্রায় ১২ শতাংশ যাচ্ছে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ে (খাতওয়ারি বরাদ্দের বিচারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ (খাতওয়ারি হিসেবে ৩য় সর্বোচ্চ) এ খাতে থাকলেও এর বড় অংশই অবকাঠামো উন্নয়নে যাচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নের চাহিদা পূরণ করতে এ খাতে আরো বাড়তি বরাদ্দ একান্ত জরুরি। স্বাস্থ্য বরাদ্দে আরো উদ্ভাবনী কৌশল নিয়ে জনগণের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমানো যেত। প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ অনুপাত ছিল ৫ শতাংশ। বরাদ্দের অনুপাত বাড়ানো গেলে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির এই সময়ে জনগণ স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ থেকে কিছুটা সুরক্ষা পেত। মনে রাখা চাই, জনগণকেই মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ বহন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতার অভাবের বিবেচনায় হয়তো বরাদ্দের অনুপাত বাড়ানো হচ্ছে না। ধারণা করা যায়, জনবল বাবদ কিংবা ভর্তুকি মূল্যে বা বিনামূল্যে দেয়া চিকিৎসা সামগ্রী বাবদ বরাদ্দ বাড়ালে বাস্তবায়ন নিয়ে দুর্ভাবনার কারণ নেই। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দে আরো উদার হওয়া যেত। সামাজিক সুরক্ষায় বাজেটের ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে। চলতি বছরে ছিল ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর পুরোটাই বিপন্ন মানুষের জন্য নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, বিভিন্ন বৃত্তির বরাদ্দও এখানে আছে। এসব বাদ দিলে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬২ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রান্তিক নাগরিকদের শতাংশ সামাজিক সুরক্ষার্থে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আশার কথা, কৃষি বরাদ্দে প্রশংসনীয় ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে। বাজেটে কৃষির অংশ চলতি বছরের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে আসন্ন বছরে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। স্মার্ট কৃষি কার্ড ও ডিজিটাল কৃষি (পাইলট) প্রকল্প, অনলাইন কৃষি মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম ‘হর্টেক্স বাজার’ ও ‘ফুড ফর নেশন’-এ সময়োচিত বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে কৃষি সেচে সৌরশক্তি ব্যবহারের অমিত সম্ভাবনার কথা বাজেট বক্তৃতায় আনা যেত। সৌরশক্তিনির্ভর সেচের মাধ্যমে বছরে ৮১ লাখ লিটার ডিজেল খরচ বাঁচানো সম্ভব। নেট মিটারিং ব্যবস্থাকে ব্যক্তির বেলাতে প্রযোজ্য করলে এবং সবুজ জ¦ালানি উৎপাদনকারীদের ২০ শতাংশ বেশি দামে ন্যাশনাল গ্রিডে ওই বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ করে দিলে দীর্ঘমেয়াদে জ¦ালানি নিরাপত্তা যেমন বাড়বে, তেমনি কার্বন নিঃস্বরণের মাত্রাও কমবে। প্রচলিত জ¦ালানি খাতে ভর্তুকি বজায় রাখার কোনো বিকল্প ছিল না। তা না হলে এক্ষুণি জ্বালানির দাম আরো বাড়াতে হতো। তা সত্ত্বেও বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাড়তি মনোযোগকে আশা-জাগানিয়া মনে হয়েছে। পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বেড়েছে ৫২ কোটি টাকা। অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রভাব হ্রাসের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা। প্রথমবারের মতো প্রণিত ‘আর্থিক ঝুঁকি বিবৃতি’তে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলোকে যুক্ত করা দূরদর্শিতার প্রমাণ। লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। অসরকারি অংশীজনদের যুক্ততা বৃদ্ধির দিকেও নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে হালের রেমাল ঘূর্ণিঝড়ে আহত সুন্দরবন ও উপকূলের প্রাণ ও প্রকৃতির পুনর্বাসনে বাড়তি জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ খুবই প্রাসঙ্গিক হতে পারত। এখনো সময় আছে এ বাবদ সংশোধিত বিশেষ বরাদ্দ দেয়ার। বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন- সিগারেটে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধূমপানের হার কাক্সিক্ষত মাত্রায় কমিয়ে আনা এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির যে সুযোগ ছিল তা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। নি¤œ স্তরের সিগারেটের দাম আপাত বিচারে ১১ শতাংশ এবং উচ্চতর স্তরের সিগারেটগুলোর দাম আপাত বিচারে ৪-৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে কার্যত সিগারেটের দাম বাড়েনি। বরং কমেছে। তবে কিছুটা হলেও দাম বাড়ানোয় সিগারেট বিক্রি থেকে আসা কর বাড়বে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আরো কিছু কর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন- বৈধপথে সর্বোচ্চ ধাপের আয়ে ৩০ শতাংশ করারোপের বিপরীতে কালো টাকার ওপর তার অর্ধেক তথা ১৫ শতাংশ করারোপের প্রস্তাবটি নৈতিক প্রেক্ষাপটে মোটেও গ্রহণীয় নয়। তবে এটি অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। সেই অর্থে এটি নতুন প্রস্তাব নয়। হয়তো রেগুলেটরি কোনো প্রয়োজনে কিংবা আপৎকালীন বাস্তবতায় তা করা হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে এতে খুব একটা লাভ হয় না। বিদেশে চলে যাওয়া কালো টাকা এই সুযোগ নিয়ে দেশে খুব একটা আসে না। বেয়াড়া মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট বেশির ভাগ মানুষের আয় বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত না রেখে আরেকটু বাড়ানোর কথাও ভাবা যেত। টেলি কমিউনিকেশন খাতকে আরেকটু সুবিধা দিলে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য বাড়তে। মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর যে করারোপের কথা বলা হচ্ছে সেটিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে সোলার সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় ইনপুটসের ওপর আমদানি কর যতটা সম্ভব কমানো ও সম্ভব হলে পুরোপুরি প্রত্যাহারের কথা এখনো ভাবার সময় রয়েছে। বাজেট পাশের সময় বিষয়টি বিবেচনার জন্য নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সামষ্টিক অর্থনীতির আরেকটি জরুরি বিষয় হলো এফডিআই। পাঁচ-দশ বছর ধরে কনসিস্টেন্ট কর ব্যবস্থার নিশ্চয়তা, বিনিয়োগকৃত বিদেশি পুঁজির লভ্যাংশ ও মূল পুঁজি সহজেই স্থানান্তরের সুযোগ সৃষ্টি করা, দুর্নীতিমুক্ত বাণিজ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো সেবা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোও বাজেট-প্রণেতাদের নজরে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তবে নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি স্বচ্ছতার সঙ্গে সেগুলোর বাস্তবায়ন আরো জরুরি বলে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন। এত কিছু বলার পরও এবারের বাজেটকে বাস্তবানুগই বলা চলে। নুন আনতে পানতা ফুরোনোর মতো এক কঠিন সময়ে দেয়া হয়েছে এই বাজেট। একে ঘিরে নিশ্চয় অনেক কথাই হবে। আশা করি সংসদের ভেতরে ও বাইরে যেসব আলোচনা-পর্যালোচনা হবে সেসবের নোট সংশ্লিষ্টজনরা নেবেন। অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে সেসব প্রস্তাবনার আলোকে অন্তত মূল্যস্ফীতির কবল থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার বিষয়ে আরো কিছু সংশোধিত নীতি-নির্দেশনা আমরা পাব- এমনটি আশা করতেই পারি।
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়