মোস্তফা কামাল
ঘোষিত বাজেটটি প্রস্তাবিত, চূড়ান্ত নয়। কিন্তু চূড়ান্ত কথা বলে ফেলতে একটুও পেছনে ফিরে না তাকানোর চর্চা চলছে হরদম। কথাবার্তা একদিকে লাগামহীন, আরেকদিকে যার যার সুবিধা মতো। নানা কারণে অবৈধ সম্পদ-সম্পত্তি, কালো টাকা-সাদা টাকার ওপর কর হারের বিষয়টি এবার বেশি আলোচিত। আলোচনার চেয়ে বেশি সমালোচনা। আর ৩০ শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ নিয়ে এই সমালোচনার তীর সরাসরি সরকারের দিকে। এটাই স্বাভাবিক, মানুষ সরকারকেই দুষবে। এ বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এনবিআরসহ দায়িত্ববান জায়গা থেকে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অবৈধ টাকা ব্যাংক ব্যবস্থায় নিয়ে আসার জন্যই বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটাকে তুলনা করেছেন বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ ধরার সঙ্গে। এতে ধারণা করাই যায়, এ সিদ্ধান্ত থেকে সরছে না সরকার। বড়জোর করের হারে এদিক-সেদিক হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি এ নিয়ে এত ব্যস্ত?
বরাবরই দেশের বেশির ভাগ মানুষের চোখ থাকে নিত্যপণ্যের দামের দিকে। আদা-রসুন, পাতা-লতার মতো টুকটাক কোনো পণ্যের দাম কমলেও তারা খুশি। এ জায়গাটায় তামাশা-নিষ্ঠুরতা এবার আরো বেশি। কিন্তু সেভাবে ফোকাস হচ্ছে না বিষয়টি। কথাবার্তা সব আশপাশে এবং বড়দের বিষয়-আসয় নিয়ে। এর মাঝে অর্থমন্ত্রী ঝাল ঝেড়েছেন সাংবাদিকদের ওপর। ঘোষিত বাজেট বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিকদের ম্যাচিউরিটি নিয়ে। বাজেট-পরবর্তী প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাংবাদিকদের ওপর খেপে যাওয়ার হেতু মিলছে না। খেপে গিয়ে তিনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, কখনো বা এড়িয়ে গেছেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও এনবিআর চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব তিনি তার এ সহকর্মীদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। একপর্যায়ে একজন সাংবাদিক কালো টাকা বৈধ করা নিয়ে জানতে চান। ওই সাংবাদিক বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, কালো টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। এছাড়া আমাদের ব্যাংকিং খাতেও সুশাসনের অভাব রয়েছে। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ বা বার্তা বাজেট বক্তব্যে দেখিনি। আর্থিক অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কেন বার্তা দিচ্ছেন না? প্রশ্নটিতে চটে যান অর্থমন্ত্রী। বলে বসেন, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো? কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, সেটা তো শিখতে হবে। এটা কোনো জার্নালিজম নয়। আরো একটু পড়েটড়ে আসবেন। একটু ম্যাচিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আপনাদের লেভেল অব ম্যাচিউরিটি দেখে আমি খুব হতাশ।’ কী প্রশ্ন করে কী জবাব পেলেন সাংবাদিকরা? মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বাজেটের আকার ছোট হয়ে গেছে- এমন প্রশ্নের জবাবেও গোস্যা করেন অর্থমন্ত্রী। জানান, এমন অপরিপক্ব ও সরলীকরণ প্রশ্ন তিনি আশা করেননি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ গোঁজামিলে ভরপুর উল্লেখ করে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা একটা অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার যার সুবিধা মতো কথার কাতারে শরিক হয়ে গেলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও। বলে বসলেন- ‘গতকাল বাজেট দিয়েছে, আজকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মুহিত সাহেব যখন বাজেট দিতেন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ত না। সহোদর বড় ভাই মরহুম আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে স্মরণ করা বা প্রশংসা করা তার বিশেষ দায়িত্ব। তাই বলে এভাবে? অন্য কত কথা দিয়েই তো বড় ভাইকে আরো বড় বানানো যায়। মুহিত বা মাহমুদ আলী বলে নয়, বাজেট এ দেশে বরাবরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর একটি আনুষ্ঠানিক মৌসুম। পণ্যের দাম বাড়াতে বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না ব্যবসায়ীরা। তা তারা বাজেটের আরো আগেই সারিয়ে ফেলেন। এবার সেখানে কিছুটা হলেও ছেদ পড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের ওপর উৎস কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ঘোষণার মতো করে। যার সুবাদে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর মতো কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে দাম আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার পরদিন শুক্রবারই। আচানক এই মশকরায় আরো বেশ কিছু পণ্যের দামই বাড়তি। বাজারে গিয়ে মাথা চক্কর দেয়ার অবস্থা সাধারণ মানুষের। বাজেটের আগের দিন ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও পরদিন ডিমের ডজন হয়ে যায় ১৬০ টাকা। এ দাম প্রায় বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। আলুতেও তেলেসমাতি। গত বছর থেকে আলুর দাম অসহনীয়। এখন বাজারে প্রতি কেজি আলু ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েক দিন আগেও ৫০ টাকা ছিল। কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ৭০ টাকা ছিল। এদিকে পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তি আদা-রসুনের দামও। প্রতি কেজি আদা ও রসুন ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সবজিসহ তেল, চিনি ও আটার মতো অন্যান্য নিত্যপণ্য চড়া দামে আটকে রয়েছে। বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি, লাল লেয়ার ও খাসির মাংসের দামও। সামনে তা আরো চড়ার যাবতীয় নমুনা। কোরবানির ঈদকে ঘিরে এরই মধ্যে বাজারে পেঁয়াজ, আদা, আলু ও কাঁচামরিচসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। বাজেটকে সেখানে টোকা হিসেবে ব্যবহার করছে সিন্ডিকেট চক্র। বাড়তি দাম নিয়ে প্রশ্ন করলেই তারা বাজেটকে দেখিয়ে দেয়। বাজেটের ভালো দিকগুলোকেও তারা ফেলে দিচ্ছে অপব্যাখ্যা ও ভাওতাবাজির তালিকায়। ব্যক্তিপর্যায়ে এবারের বাজেটে ন্যূনতম কর হার বাড়েনি। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা। অন্যান্য শহরের জন্য তা চার হাজার টাকা। সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকার বাসিন্দাদের কর তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক ১১ থেকে সাড়ে ২১ লাখ টাকার মধ্যে যাদের আয়, তাদের জন্য কিছু সুখবর আছে। চার বছর পর এবার উচ্চ আয়ের উপার্জনকারীদের ওপর ৩০ শতাংশ কর পুনর্বহাল করতে চায় এনবিআর। বার্ষিক ৪৩ লাখ টাকার বেশি আয় হলে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। যদিও ধনীদের সম্পদের ওপর নতুন করে কোনো অতিরিক্ত সারচার্জ চাপানো হয়নি। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকলেও আছে সুখবর। কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে সম্পদের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না সরকারি কোনো সংস্থা। এ ক্ষেত্রে শুধু নগদ বিনিয়োগ, ব্যাংক আমানত, আর্থিক সিকিউরিটিজ বা অন্য যে কোনো বিনিয়োগের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। কথিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি দেয়ার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অল্প কর দিয়ে সেই টাকা ব্যাংকে নিয়ে আসা। সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিপরীতে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাজেট মূলত সারা বছরের আয়-ব্যায়ের একটি ছক। তবে পরিবারের আর সরকারের বাজেটের চরিত্রগত তফাত আছে। পরিবার বা ঘর-সংসারের বাজেট হয় আয়ের ওপর ভর করে। আর সরকার বাজেট করে সারা বছরের ব্যয় হিসাব করে। তখন সরকারকে আয় তালাশ করতে হয়। আর আয় মানে কর। সেটার পাইপলাইন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে ৪ দশমিক ৮০ লাখ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি এবং সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি। এ লক্ষ্য অর্জনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের মতো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করবে এনবিআর। এনবিআর চায় ক্যাশলেস লেনদেন এবং আরো কর আদায়। সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে নানা দিকে জাল ফেলে এনবিআর। এটাই হয়ে আসছে। সেই চেষ্টায় এখন মোবাইল ফোন থেকে বিয়েসাদি কোত্থেকে কত আনা যায়, এ চেষ্টা তাদের। বাণিজ্য সম্প্রসারণ, কর ব্যবস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো এবং স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রস্তাবিত করহার বছরের পর বছর ধরে রাখতে চায় এনবিআর।বরাবরের মতো এবারো সমস্যাটা হয়ে যাচ্ছে, বাজেট বিষয়ে কথাবার্তায় আশপাশের বাড়তি বিষয় নিয়ে আসায়। কীসের মধ্যে কী দিয়ে পান্তা ভাতে ঘি মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বর্তমানে বা নগদে এবং দৃশ্যত মূল সমস্যা হচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে খাদ্যমূল্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সরকার চ্যালেঞ্জ মনে করে আসছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়বে। আমাদের উৎপাদন বেড়েছে। চাল উৎপাদনই বেড়েছে প্রায় চার গুণ। কিন্তু এর বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হচ্ছে না। প্রশ্ন করা হচ্ছে না, এত চাল যায় কই? কেন চাল আমদানি করতে হয়? আলোচনা বা প্রশ্ন থাকা উচিত, এক বছর আগে যে দলিল উপস্থাপন করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়নে গলদ হয়েছে কোথায়? সেখান থেকে এবার কী শিক্ষা নেয়া দরকার?
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।