ইব্রাহিম পাঠান
এবারের বাজেট পেয়ে রাজ্যের লোক মন ভার করে বসে থাকলেও বেজায় খুশি আবাসন ব্যবসায়ীরা। জমি আর ফ্ল্যাটে বিপুল বিনিয়োগ করে এখন তারা খদ্দেরের অপেক্ষা করছেন। তা-ও আবার যেনতেন চাকুরে বা মুদির দোকানদার গোছের কেউ নন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দর দেওয়ার মতো টাকার গরম আছে যাদের, তাদের জন্য।
বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আবাসন ব্যবাসীয়দের সংগঠন রহ্যাবের নেতারা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে এর প্রশংসা করেছেন। নৈতিকতা চুলায় যাক, খুনখারাবি বা লুট করে আনা টাকা হোক, কোন প্রশ্ন না করে কালো টাকা আবাসন বা স্থাবর সম্পত্তিতে লগ্নি করার এই সুবিধা আরো পাঁচ বছর ধরে বহাল রাখারও দাবি জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
নিত্যপণ্যের দামে লাগাম নেই। মার্কিন মুদ্রার রিজার্ভ তালানিতে। আমদানি রপ্তানিতে মন্দা ভাব কাটছে না দুই বছর ধরে। ওদিকে বিদেশি ঋণের বোঝা আর সুদ ক্রমাগত বাড়ছে। কবে অর্থনীতি সুপথে আসবে তার ঠিকানা নেই। কিন্তু ফ্ল্যাট-বাড়ি বিক্রিতে রমরমা ব্যবসা চলছে। রিহ্যাব জানাচ্ছে, করোনা মহামারি’র পর ২০২০-২১ অর্থবছরে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় ২০ হাজার ৬শ কোটি টাকা অর্থনীতির মূলধারায় এসেছে। আর এর পরের বছর, শুধু আবাসনে বিনিয়োগ হয়ে বৈধ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং দিনগুলোতে যদি এমন বৈষম্যমূলক সুযোগ থাকে তাহলে কালো টাকার মালিকদের মতো আবাসন ব্যবসায়ীরাও আঙুল ফুলে কলা গাছ নয়, হাতি হওয়ার সুযোগ পাবেন।
এখন তো খোলাখুলি মন্তব্য আসছে, পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজির আহমেদ আইনের জালে আটকা পড়েছেন বলে তার সম্পত্তি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করা যাচ্ছে না। কিন্তু যাদের এখনো চিহ্নিত করা যায়নি, তারা কিন্তু সাদা করার সাঁকো পাড়ি দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষা করছেন। সীমাহীন লুটপাটের টাকা সরকারি সুবিধায় বৈধ হবে। যদিও বাজেট উত্থাপনের পরদিনই প্রধানমন্ত্রী কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে রসিকতা করে বলেন, ‘আমি বলি মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না। সেই রকম একটা ব্যবস্থা, এটা আসলে আগেও হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু হয়েছিল। এরপরও প্রত্যেক সরকারই করে’। তবে এবার শুধু ব্যক্তি নন, হিসাব ঠিকমতো রাখতে না পারা অথবা অবৈধ সম্পদ বা অপ্রদর্শিত সম্পদ তৈরির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানকেও দায়মুক্তির এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থাৎ ব্যাংক ব্যবস্থায় টাকার প্রবাহ বাড়াতে আয়কর আইনে নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করাকে প্রণোদনামূলক সংযোজন বলছেন অর্থমন্ত্রী।
কেউ কেউ বলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। সুযোগের অভাবে বহু লোকে সাধু সেজে আছেন। আর্থিক লেনদেনে ছোট কিংবা বড় যে মাত্রায়ই নীতির বড়খেলাপ হোক না কেন সেখানেই তৈরি হয় কালো টাকা। তবে কি শুধু জমি-ফ্লাটে বিনিয়োগ করেই লোকে ঘুস অথবা লুটের টাকা লুকিয়ে রাখে? অপ্রদর্শিত আয় আবাসন ব্যবস্থা ছাড়া অনেকভাবেই লোকে আড়াল করে রাখে। এসবের কিছু ক্ষেত্র উল্লেখ করতে চাই।
এক. কর দিয়ে বৈধ করা টাকা মানুষ ব্যাংকে রাখবে এমন যুক্তিতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও দুর্নীতির টাকার একটা বড় অংশ গচ্ছিত থাকে ব্যাংক ব্যবস্থায়ই। অপরাধীরা বড় অংকের টাকা এক হিসাবে না রেখে অনেকগুলো হিসাবে ছোট ছোট করে এমন ভাবে রাখে যেন এর উৎস নিয়ে সন্দেহ না আসে। চলতি অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পেয়েছে। সহজেই আন্দজ করা যায়, এই অ্যাকাউন্টগুলো বৈধ কাজের চেয়ে অবৈধ কাজেই বেশি ব্যবহার হয়েছে। একজন স্বাভাবিক লোকের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে এতগুলো ব্যাংক হিসাব থাকাটা অস্বাভাবিক ঘটনা।
দুই. টাকা ব্যাংকে না রেখে অনেকে নগদ হিসেবেই লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এর অগে বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধারের উদাহরণ দেশেই আছে। ২০১৬ সালে ভারত সরকার দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা অর্থব্যবস্থা থেকে সরাতে পাঁচ শ ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল করেছিল। পরে ২০২৩ সালে দুই হাজার টাকার নোট বাতিল করে দেশটি। বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পুরস্কার দেওয়া হলো।
তিন. অর্থনীতির খারাপ সময়ে সোনার দামে লাগাম নেই। ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম এখন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকার ওপরে। এই দাম দেখে মনে হতেই পারে মানুষ ভাত খেতে না পেলেও যেন সোনার গহনা ঠিকই কিনছেন। গত কয়েক বছর ধরেই সোনার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। আন্তর্জাতিক বাজার দরের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের জুয়েলারি ব্যবসায় বাজুস দফায় দফায় দাম বাড়ালেও দেশে সোনার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। মূল্যবান ধাতু হওয়ায় অল্প পরিমাণ সোনা কিনেও অনেক টাকা লুকিয়ে ফেলা যায়। এছাড়া সোনা লুকিয়ে রাখা সহজ ও নিরাপদ।
চার. এনবিআর চেয়ারম্যান আপত ঠিকই বলেছেন। বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, দুর্নীতির টাকার বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কিন্তু তিনি বলেননি যে এই লুট-দুর্নীতির টাকা হুন্ডি-হাওলাসহ নানা কায়দায় অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে ফের বিদেশি বিনিয়োগ আর রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরে আসে। বৈধ হয়ে যায়। তাই কালো টাকা দেশে রাখতে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে চান অর্থমন্ত্রী।
পাঁচ. কিছু বৈধ আর কিছু অবৈধ টাকা একসাথে মিশিয়ে সন্দেহ দূর করার চেষ্ট করেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। ব্যবসায়িক উদ্দেশে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় এমন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই টাকা ঢুকে গেলে সেখান থেকে সন্দেহজনক লেনদেন হয় বলে কালো টাকা চেনা ও উদ্ধার করা বেশ জটিল। আর অডিট ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকে লুকানো টাকা বের করা জটিল হয়ে ওঠে।
ছয়. দান-খয়রাতের নামে অনেকে কালো টাকা বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার কাছে গুজে দেন। আদতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কালো টাকার মালিকরাই গড়ে তুলেছেন। স্ব-নিয়ন্ত্রিত এসব প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী তাদের নিজেদের লোকজন। শুধু তাই নয়, আইনের ফাঁকফোকরে আত্মীয় স্বজনের নামেও কালো টাকায় কেনা বহু সম্পত্তি আড়াল হয়।
সাত. আমদানি রপ্তানির মাধ্যমে পণ্যের দাম কম দেখিয়ে বা কখনো অতিরিক্ত দেখিয়ে টাকা পাচার একটা চিরায়ত ঘটনা। রপ্তানির টাকা পুরোটা দেশে আসছে না এমন শিরোনামে প্রায়শই গণমধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে তৈরি হয় গরমিল। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দেখান ক্রেতাদের বিলম্বিত পরিশোধের কারণেই সব আয় দেশে আসছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালো টাকার মালিকরা এই টাকা পুরোটা দেশে আনেন না।
বাংলাদেশের মতো দেশে কালো টাকার যে ছায়া অর্থনীতি তৈরি হয়েছে তার পরিমাণ কত-কেউ কি বলতে পারে? এ নিয়ে গবেষণা করেও সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য আর দারিদ্র্য বৃদ্ধির হার দেখে টের পাওয়া যায়, পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। যে যুক্তিতেই হোক ব্যক্তি পর্যায়ের সাথে প্রতিষ্ঠানকেও এবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পর বলা যায়, দুর্নীতি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে গেছে। আইন করে কালো টাকার মালিকদের সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিতে আপতত একটা গতি আনার চেষ্টা করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দেশ ও জাতির জন্য বরং ক্ষতিই করছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হোক গণমানুষের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, লুটেরাদের স্বার্থে নয়।
লেখক: অর্থ-বাণিজ্যের বিশ্লেষক। চার্টাড সেক্রেটারি।