৮ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ২২শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

বাংলা সাহিত্যে সেলিনা হোসেন একটি স্বতন্ত্র নাম

সুজন হাজং
দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস। যা পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যে কারণে স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যে সেলিনা হোসেন একটি স্বতন্ত্র নাম। একটি মূল্যবান নাম। যে নামটি এক বাক্যে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয় পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার অগণিত পাঠকের কাছে। বর্তমানে তাঁর লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ৪৩টি। গল্পগ্রন্থ ১৬টি। প্রবন্ধ ১০টি। শিশুসাহিত্য ৩৫টি। ভ্রমণকাহিনি একটি। প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৫টি।
পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের লেখা গল্প-উপন্যাস। সেলিনা হোসেনের ১১টি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। পাশাপাশি ফরাসি, জাপানি, কোরিয়ান, রুশ, উর্দু, হিন্দি, মালয়ালাম, মারাঠি, ফিনিস, আরবি, অসমিয়া, উড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাস। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী ভাষায় তাঁর গল্প-উপন্যাস অনুবাদের কাজ চলছে।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের পটভূমি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জের একজন মা দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে তাঁর নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। ১৯৮৭ সালে হাঙর নদী গ্রেনেড ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। উপন্যাসটি ২০০৩ সালে ভারতের মালায়লাম ভাষায় অনূদিত হয়ে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়।
২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিনয় রাজ্যের ওকটন কমিউনিটি কলেজে দুই সেমিস্টারে পাঠ্য ছিল হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। পরবর্তীতে হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদ করেন বাংলাদেশ থেকে জ্যাকি কবীর। সেই পাণ্ডুলিপি পরিমার্জন করেন প্যারিসের দ্য গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান লিটারেচারের অধ্যাপক পাস্কেল জিন্ক। ২০১৬ সালে উপন্যাসটি ‘রিভার অব মাই ব্ল্যাড’ নামে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়।
হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য। হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে তিনটি চিঠি লেখেন। ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি চেয়ে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় সেলিনা হোসেনকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিরাপত্তাজনিত কারণে ছবিটি নির্মাণ না করতে পারার কারণে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম হাঙর নদী গ্রেনেড চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।
সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ এক জীবনীভিত্তিক উপন্যাস। চর্যাপদে প্রাচীন সমাজের শিকড়ের সঙ্গে যে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ছিল তার সামগ্রিক চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। ১৯৮৩ সালে নীল ময়ূরের যৌবন ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। পরবর্তীতে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল ময়ূরের যৌবন পাঠ্য করা হয়। ১৯৯৯ সালে ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় এবং ২০০৩ সালে টানাপোড়েন উপন্যাসটি উর্দুতে অনূদিত হয়ে পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়।
২০১২ সালে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়। ২০১৮ সালে পূর্ণ ছবির মগ্নতা উপন্যাসটি অসমিয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে গৌহাটি থেকে প্রকাশিত হয়। পূর্ণ ছবির মগ্নতা সেই সময়কার ঘটনা; যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখভাল করার জন্য শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর এসে বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতি প্রেম নিয়ে লেখা পূর্ণ ছবির মগ্নতা বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় সিংহলী ভাষায় অনূদিত হচ্ছে।
সেলিনা হোসেনের ‘নারীর রূপকথার গল্প’ উড়িয়া ভাষায় অনূদিত হয়ে উড়িষ্যা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা মোহিনীর বিয়ে মালায়লাম ভাষায় অনূদিত হয় ২০০১ সালে কেরালা থেকে প্রকাশিত হয়। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়েছে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’। গায়ত্রী সন্ধ্যায় সেলিনা হোসেন সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে পঁচাত্তর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময়কে তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাসে। এ উপন্যাসে নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এগারো দফা, গণআন্দোলন, নকশাল আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
দেশভাগ এবং বৈষম্যের শিকার একটি সাধারণ পরিবারের কাহিনি ও দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ববাংলার জীবনচিত্র নিয়ে তাঁর ‘যাপিত জীবন’ উপন্যাসটি রচিত। যাপিত জীবন উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত একটি উপন্যাস। নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পত্রে পাঠ্য। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্ট্যাডিজ ডিপার্টমেন্টে বাংলা বিভাগে তাঁর দুটি গল্প পাঠ্য। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়, কোচবিহার ইউজিসি পাঠ্যক্রমে ‘আমিনা মদিনার গল্প’ পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫টি কলেজ রয়েছে।
২০১৮ সালে ‘কাঠ কয়লার ছবি’ উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়। কাঠ কয়লার ছবি একটি লস্ট আইডেনটিটির গল্প। উপন্যাসটি একাত্তরের যুদ্ধশিশু এবং সিলেটের চা শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে লেখা। কাঠ কয়লার ছবি উপন্যাসটি সম্প্রতি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য করা হয়েছে। নাচলের তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নারী নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ উপন্যাস ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগে সেলিনা হোসেনের ‘ঘরগেরস্থের রাজনীতি’ গ্রন্থ পাঠ্য। ২০১৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
দেশমাতৃকার চেতনা যার লেখায় প্রোথিত, জীবনঘনিষ্ঠ মানবিক মূল্যবোধ যার লেখায় শাণিত। সে শব্দের দীর্ঘ পথ হাঁটা এক অক্লান্ত পথিক, আমাদের কাব্যময় নির্মোহ, নিরহংকার জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে শব্দের সাহসী গাঁথুনি যার কলমে এখনো অবিরাম। তিনি আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি আমাদের অহংকার। দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে সেলিনা হোসেন জনপ্রিয় নাম। আমরা তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। সেলিনা হোসেনের ৭৭তম জন্মদিন হোক বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়।
লেখক: গীতিকবি এবং পরিচালক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, বিরিশিরি, নেত্রকোণা।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়