২০শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৪ঠা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুপক্ষের বিবাদে কিশোর খুন: ‘হুকুমদাতার’ বিচার চায় পরিবার

প্রতিদিনের ডেস্ক:
শেখ হাসিনার ৪৪তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ছিল সেদিন। দিনটি পালনে শোভাযাত্রার আয়োজন করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ। কিন্তু শোভাযাত্রা শেষ হয় রক্ত ঝরিয়ে। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সড়কে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায় এবং সেখানে হত্যা করা হয় এক কিশোরকে। গত ১৮ মে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত কিশোরের মা ও মামা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। এ ঘটনায় পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও এর ‘হুকুমদাতা’ গ্রেফতার না হওয়ায় উদ্বেগ নিয়ে প্রায় দেড় মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ঘটনার হুকুমদাতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ ভিকটিমের পরিবারের।নিহতের পরিবারের দাবি, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল হুকুমদাতা শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ। তার নেতৃত্বে মেহেদীকে হত্যা করেছে তার অনুসারীরা। অথচ তাকে আইনের আওতায় আনছে না পুলিশ।নিহত কিশোরের নাম মেহেদী হাসান (১৭)। সে এবছর ভাটারা সুলমাই উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরিক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরিবারের সঙ্গে ভাটারা থানার নুরেরচালা এলাকায় থাকতো। মেহেদীর মা ভাটারা থানা ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক। মামা চয়ন মিয়া ভাটারা থানার ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। মেহেদী হত্যা মামলার বাদীও তিনি। গত ১৮ মে শেখ হাসিনার ৪৪তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের শোভাযাত্রায় আমার সঙ্গেই এসেছিল মেহেদী। ধানমন্ডি থেকে প্রোগ্রাম শেষ করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বকুলতলা এলাকায় আমরা বাসে ওঠার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখন শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা পিকআপে করে যাওয়া সময় আমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে একাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের দলনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ আসে। তর্কাতর্কির কথা শুনে তার নেতাকর্মীদের আমাদের ওপর হামলা চালাতে বলে সে চলে যায়। এরপরই তারা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করতে থাকে। তখন আসাদের কর্মী মুফতি ওরফে গুল্লি রুবেল আমার ভাগ্নে মেহেদীকে সুইচ গিয়ার দিয়ে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। আমার চোখের সামনে আমার ভাগ্নেকে মেরে ফেললো। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলাম না।মেহেদীর মা ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক লিপি শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার বাবা (মেহেদী) শেখ হাসিনার প্রোগ্রামে যাইয়া শোডাউন দিছে ‘জয় বাংলা জয় বন্ধু’, ‘শেখ হাসিনা সরকার বারবার দরকার’। এরপরই আমার বাবা শহীদ হইয়া গেলোগা। আমি ভাবতেও পারি নাই আমার সন্তান এমনে চইলা যাইবো। এই কষ্ট আমি কই থমু, এই কষ্ট রাখার আমার জায়গা নাই। এই ইতিহাস আমি কেমনে ভুলমু।লিপি আরও বলেন, আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। আমার রক্তের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতি জড়ায়া আছে। আমার স্বামী-সন্তান সবাই বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শে চলে। আমি এতো মিছিল করলাম, প্রোগ্রাম করলাম। কখনও কোনও নেতা আমাদের বলে নাই কোনও প্রোগ্রামে লাঠি-সোঁটা নিয়া যাইতে। আর অস্ত্র তো অনেক দূরের কথা। ওই দিন ছিল আনন্দ র‌্যালি, আমাদের নেত্রীর আনন্দ র‌্যালি। এই র‌্যালিতে গিয়ে আমার সন্তান মারা গেলো। এইটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবো না। আনন্দ র‌্যালিতে কেন আমার সন্তান মারা গেলো? আনন্দ র‌্যালিতে কেন অস্ত্র থাকবে? এটা কি আমার নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ? আমার নেত্রী কি এসব শিখাইছে?কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিপি বলেন, আমার সন্তানকে যারা হত্যা করছে তারা মিরপুরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, মাদককারবারী। এসব মানুষ কেন এমন সুন্দর প্রোগ্রামে আসবে? তাদের কেন দলের কর্মী বানানো হলো? আমার নেত্রীতো বলে নাই এসব মানুষ দিয়ে দল ভারী করতে। এটা আমার নেত্রীর আদর্শ না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ না। তাহলে আমরা কী আদর্শ নিলাম, কী শিক্ষা পেলাম? আমরা কোন আদর্শ নিয়া রাজনীতি করি?তিনি বলেন, যারা আমার বাবাকে (সন্তান) ছুরিকাঘাত করে মারছে, আমি শুধু তাদের বিচার চাই না। যারা সন্ত্রাসী ও কর্মী ব্যবহার করে মানুষ মারে আমি তাদেরও বিচার চাই। সামান্য তর্কাতর্কি নিয়া আসাদ কেন হামলা করতো বললো? আমি আগে আসাদের বিচার চাই। আসাদ কেন আমার আমার ছেলেকে মারলো? তারাও সেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করে, আমার ছেলেও সেচ্ছাসেবক লীগের ব্যানারে প্রোগ্রামে গেছে। আমরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। যেকোনও প্রোগ্রামে ঝগড়া হতেই পারে। আসাদ চাইলে সামান্য ঝগড়াকে থামাইতে পারতো। অথচ আসাদ তা না করে, হামলার চালাইলো। আমি আগে তার বিচাই চাই। তাদের এমন শস্তি হোক যাতে এমন ঘটনার আর পূনরাবৃত্তি না হয়।’হামলার অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘মারামারির বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। সামান্য তর্কাতর্কি থেকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখানে আমি হুকুম দিয়েছি; এ কথা সত্য নয়।’রাজনৈতিক শান্তি সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মীদের কাছে অস্ত্র ছিল কেন— এমন প্রশ্নে আসাদ বলেন, ‘কর্মীদের অস্ত্র বহন করার কোনও নির্দেশনা দেওয়া ছিল না। কারও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অস্ত্র সঙ্গে রাখতে পারে, সেটা আমি বলতে পারবো না। যারা আমাদের আদর্শিক কর্মী, যারা দলকে ভালোবাসে; তাদের সঙ্গে তো অস্ত্র থাকার কথা না।’পুলিশ জানায়, ১৮ মে হত্যাকাণ্ডের পর ২১ মে মামলা করেন মেহেদীর মামা চয়ন মিয়া। মামলার এজহারে মুফতি, কমল, সাগর ও হাতেমের নাম উল্লেখ করে আরও ১৫-১৬ জনকে অজ্ঞাত করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে মুফতি ও আরিফ নামে দুই জনের কাছে চাকু (সুইচ গিয়ার) ছিল। এই দুই জনসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সজীব দে।তিনি বলেন, শিক্ষার্থী মেহেদী হত্যা মামলা এজহার ভুক্ত আসামি মুফতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মূলত মুফতি মেহেদীকে ছুরিকাঘাত করে। তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়াও ঘটনাস্থলে মুফতি ও আরিফের কাছে দুটি চাকু (সাইচ গিয়ার) ছিল। সেগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে। মুফতি, আরিফ ছাড়াও রবিউল ইসলাম, রানা, ইছহাক ও রাজিব নামে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে কে এই হামলার হুকুমদাতা, তা এখনও জানা যায়নি। তবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়