১৮ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ২রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

খুলনাজুড়ে ফয়সাল দেশজুড়ে মতিউরের অঢেল সম্পদ : এক বৃন্তে দুই দুর্নীতিবাজ ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ

বিশেষ প্রতিবেদক॥
খুলনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের পরিবারের দুটি বাড়ি ও প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাড়ির গ্যারেজে একটি টয়োটা ‘হ্যারিয়ার’ গাড়ি দেখা গেছে। তাঁর স্ত্রী একটি হ্যারিয়ার গাড়িতে চড়ে প্রায়ই খুলনায় ঘোরাফেরা করতেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এদিকে সচেতন মহল বলছেন ফয়সাল-মতিউর একই বৃন্তে দুটি বিষাক্ত ফুল। দেশজুড়ে তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নিজেদের বাইরে শ্বশুর-শাশুড়িসহ আত্মীয়-স্বজনদের নামেও ব্যাংক-ব্যালেন্স, গাড়ি বাড়ি ও অঢেল সম্পদ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বাড়ি খুলনা মহানগরীর মুজগুন্নী এলাকায়। তাঁর বাবার নাম কাজী আবদুল হান্নান। তবে স্থানীয়রা তাঁকে ফিরু কাজী হিসেবে চেনেন।
সরেজমিনে মহানগরীর মুজগুন্নী আবাসিক এলাকায় প্রায় ২ বিঘা জমির একটি প্লট দেখা যায়। সেখানে ফিরু গাজীর নামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। এ ছাড়া যশোর রোডের নেছারিয়া মাদ্রাসার পাশে একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে। গ্যারেজে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি দেখা গেছে। ওই বাড়িতে কাজী ফয়সালের মা-বাবা বসবাস করতেন। গতকাল শনিবার বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে তাঁর মাকে পাওয়া গেলেও তিনি দরজা খুলতে এবং কোনো কথা বলতে রাজি হননি। খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী মাহফুজুর রহমান লিটন জানান, কাজী ফয়সাল এলাকায় কম আসতেন। তবে তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিন কয়েক দফা তাঁর কাছে সনদ নিতে এসেছেন। এ ছাড়া প্রায়ই তিনি টয়োটা ‘হ্যারিয়ার’ গাড়িতে ঘোরাফেরা করতেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ফয়সালের সম্পদ, ব্যাংকে থাকা টাকা ক্রোক ও অবরুদ্ধের আদেশ হওয়ার পর খুলনায় সম্পত্তি নিয়ে লুকোচুরি চলছে। হঠাৎ করে বাড়ির সামনে থেকে নামফলক সরিয়ে ফেলা হয়েছে। খুলনার খালিশপুর এলাকার ১১৩ নম্বর সড়কে ফয়সালের শ্বশুরবাড়ি। তাঁরা হঠাৎ করে আত্মগোপন করেছেন। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ওই বাড়ির নামফলক খুলে ফেলা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হওয়া এবং পরে তার বড় অংশ উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে। আদালতে জমা দেওয়া দুদকের নথি বলছে, ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর শাশুড়ি মমতাজ বেগম পেশায় গৃহিণী।এনবিআরের ফয়সালের সম্পদ স্ত্রী-শ্বশুর-শাশুড়ির নামেই বেশি, ১০৬ অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি টাকা জমাএনবিআরের ফয়সালের সম্পদ স্ত্রী-শ্বশুর-শাশুড়ির নামেই বেশি, ১০৬ অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি টাকা জমা দুদক বলছে, ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিজের ও স্ত্রীর নামে রাখার পাশাপাশি স্বজনদের নামেও রেখেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ির নামে ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ লেনদেন হয়েছে, তা ফয়সালেরই অপরাধলব্ধ আয়। দুদকের নথি অনুযায়ী, ফয়সাল ও তাঁর ১১ স্বজনের নামে ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। দুদক আদালতে জানিয়েছে, ফয়সাল তাঁর অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য স্বজনদের নামে ৭০০টির মতো ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন। এর মধ্যে ৮৭টি হিসাবে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের সরকারি কৌঁসুলি মোশারফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এ বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। প্রাথমিকভাবে দুদকের অনুসন্ধান দল ঢাকায় তাঁর ফ্ল্যাট, দুটি প্লট, সঞ্চয়পত্রসহ ১৬ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পেয়েছে। এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।
দুদক লিখিতভাবে আদালতকে জানিয়েছে, আবু মাহমুদ ফয়সাল সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ লেনদেন করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের জন্য নিজের নামসহ তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে ৭০০টির বেশি হিসাব খোলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস গোপন করা। দুদকের পক্ষ থেকে ফয়সালের সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ আদালতের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে এনবিআর কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে। তাঁর নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সাবেক কলেজশিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। দুজনের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানেই তাদের শত শত কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তারা নিজেদের নামে সম্পদ করেছেন কম। বেশি করেছেন স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনের নামে। তারা এখন দেশজুড়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বলেও অভিমত সচেতন মহলের। এমন দুগন্ধ ছড়ানো অনেক কর্মকর্তা কাছে-দূরে আছে। যারাও দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়