১৮ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ২রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

বেনাপোলের কমিশনার হাকিম-জেসি সাফায়েত-হাফিজুল এবং ডিসি অথৈল চৌধুরীর সম্পদ-সম্পতির খোঁজে মাঠে নামার দাবি

সুন্দর সাহা
ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের মত বেনাপোলে কাস্টমসে দায়িত্বরত চার শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অন্য কারও সম্পদের তদন্ত হবে কিনা তা নিয়ে দেশের বৃহত্তম এই বন্দর জুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে ফলকাণ্ডে জড়িত তিন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িতদের নগদ অর্থসহ সম্পদ-সম্পতির খোঁজে মাঠে নামার দাবি জোরালো হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের মত বেনাপোলে দায়িত্বরত কমিশনার আব্দুল হাকিম, জয়েন্ট কমিশনার (জেসি) সাফায়াত হোসেন, জয়েন্ট কমিশনার (জেসি) হাফিজুল ইসলাম এবং ডেপুটি কমিশনার অথৈল চৌধুরীর নগদসহ সম্পদ সম্পতির খোঁজে সংশ্লিষ্টদের মাঠে নামার দাবি উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী, পাঁচ সন্তানের সাংসারিক দায়িত্ব পালনের পরও তাদের ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এ পর্যন্ত দেশেই তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকাতেই অন্তত ২৪টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে। এছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে হাজার বিঘার বেশি জমি। দেশের বাইওে রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ। ছাগলকাণ্ডের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নামে পাওয়া গেল গাজীপুরে ৬০ বিঘা জমির উপর নির্মিত রিসোর্ট। ওই রিসোর্টে সারা বছরই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। ‘আপন ভুবন’ নামে পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট ও রিসোর্টটি গাজীপুর মহানগরীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও এলাকায়। ছাগলকাণ্ডে ছেলে ভাইরালের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের একাধিক বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের তথ্য বেরিয়ে আসছে। গাজীপুর, নরসিংদী ও ময়মনসিংহে খোঁজ মিলেছে তার একাধিক রিসোর্ট ও ফ্যাক্টরির। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে শতকোটি টাকা। তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। একইভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হওয়া এবং পরে তার বড় অংশ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে। আদালতে জমা দেওয়া দুদকের নথি বলছে, ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর শাশুড়ি মমতাজ বেগম পেশায় গৃহিণী। দুদক বলছে, ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিজের ও স্ত্রীর নামে রাখার পাশাপাশি স্বজনদের নামেও রেখেছেন। শ্বশুর ও শাশুড়ির নামের ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ লেনদেন হয়েছে, তা ফয়সালেরই অপরাধলব্ধ আয়। দুদকের নথি অনুযায়ী, ফয়সাল ও তাঁর ১১ স্বজনের নামে ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। দুদক আদালতে জানিয়েছে, ফয়সাল তাঁর অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য স্বজনদের নামে ৭০০টির মতো ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন। এর মধ্যে দুদক ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় বেনাপোলে ফলকাণ্ডসহ নানান অভিযোগে অভিযুক্ত আলোচিত কাস্টমস কমিশনার আব্দুল হাকিমের নগদ অর্থসহ অস্থাবর-স্থাবর সম্পদ-সম্পত্তির তথ্য অনুসন্ধানের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে বেনাপোল কাস্টম হাউজের কর্মকর্তারা মাছ শুঁটকি, টমেটো, পান ও ফলের চালান বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে রাতে খালাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রাতে এসব পণ্য ডেলিভারী দেয়ায় জেসি সাফায়েত হোসেন এবং কমিশনারের অত্যন্ত প্রিয় ভাজন অথৈল চৌধুরী হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। অভিযোগ রয়েছে, এসব অবৈধ অর্থের সরাসরি ভাগ পান কমিশনার আব্দুল হাকিম। এছাড়াও নানান অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে এইচটি ইমামের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এবং এনবিআরে দায়িত্বরত শীর্ষ একজন কর্মকর্তার এলাকার লোক হওয়ায় বেনাপোল কাস্টমস হাউজের কমিশনার ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। তিনি ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ তার আস্থাভাজনদের নিয়ে চেম্বারে দেনদরবার করেন। অন্য কোন সিএণ্ডএফ এজেন্ট বা আমদানিকারক গেরে তাদের সাথে র্দুব্যবহার করে রুম থেকে বের দেন। হাতে গোনা কয়েকজন দুর্নীতিবাজ সিএন্ডএফ এজেন্ট ছাড়া কেউ তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট নন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ফলকাণ্ড নিয়ে। রাতে ফল খালাসের ব্যবস্থা চালু করেন কমিশনার আব্দুল হাকিম। এসব ফলের সাথে ভারত থেকে আসে বিপুল পরিমাণ শাড়ী-থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন উমিটেসন সামগ্রী। যাতে কাস্টমসের প্রতিরাতে কোটি টাকা বাণিজ্য হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, রাতারাতি কোটি কোটি টাকা আয় করতে ড্রাইভারপুত্র ছোট রয়েলের সাথে কাস্টমসের শীর্ষ এক কর্মকর্তা ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। যার কারণে, টমেটো, পান ও ফলের চালান আমদানিকারক ছোট রয়েল কাস্টমসের বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। ছোট রয়েল, শামীম, জিয়া, হাদী, কামালসহ কতিপয় আমদানিকারক ও সিএণ্ডএফ এজেন্টের সাথে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। অথচ কথিত এসব আমদানিকারকদের অধিকাংশের কোন লাইসেন্স নেই। অন্যের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। আর লাইসেন্সবিহীন আমদানিকারক ট্রাক ড্রাইভারপুত্র ছোট রয়েল এখন বেনাপোলে ধনাঢ্য ব্যাক্তিদের একজন বনে গেছেন। জিরো থেকে হিরো বনে যাওয়া ছোট রয়েলের রয়েছে কোটি-কোটি টাকার জায়গা-জমিসহ বিত্ত-ভৈবব এবং আলিশান কয়েকটি বাড়ি। বাপ ট্রাক ড্রাইভার হলেও ছেলে ছোট রয়েল চলেন কোটি টাকা দামের গাড়িতে। ইতোপূর্বে এনবিআর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় রাতে ফলসহ কাচামাল খালাস করা যাবে না। এতে কমিশনারসহ দুর্নীতিবাজদের মাথায় বাজ পড়ে। অভিযোগ রয়েছে, এই নির্দেশনা ঠেকাতে কমিশানারের নির্দেশে ‘বিশেষ পেশার দুই ভাড়াটিয়াকে ম্যানেজ করে বিভিন্ন পত্রিকায় অর্থ খরচ করে রিপোর্ট করিয়ে সেই নির্দেশনা বাতিল করিয়ে আনেন এই চক্র। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৩ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর পচনশীল পণ্য শুল্কায়নের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা জারি করে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের এক সভায় আমদানিকৃত শুল্কায়ন সমতা বজায় রাখা এবং আমদানিকারকদের জন্য সুষম সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্যে আমদানি পর্যায়ে মাছ শুঁটকি, টমেটো, পান ও ফলের সঠিক পরিমাপ নির্ধারণে পণ্যবাহী ট্রাকের চাকার সংখ্যার ভিত্তিতে ন্যূনতম ওজন প্রস্তাব ও সুপারিশ করা হয়। যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর করে কাস্টমস। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। আর এ কারণেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারীকৃত নতুন আদেশে অতিরিক্ত শুল্কায়নের কারণে বেনাপোল বন্দরে মাছ, ফল ও সবজি নিয়ে কয়েকটি ট্রাক পচনশীল পণ্য ছাড় করাচ্ছেন না দুর্ণীতিবাজদের অনুসারি কয়েকজন আমদানিকারক। কথিত এই প্রতিবাদ বেনাপোল কাস্টমস হাউজের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পরামর্শে কিনা সেটি জানা যায়নি। যাকে বন্দর সংশ্লিষ্টরা কমিশনারের আরেক খেলা বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এনবিআরের এই নতুন আইনে অনিয়মে পারদর্শীদের জ্বালা উঠেছে। এতে বেনাপোলের আলোচিত কাস্টমস কর্তাদের ‘অনেক’ লোকসান হবে। সে কারণে কথিত এই আন্দোলন বেনাপোলের কাস্টমসের দুর্নীতির তিন শিরোমণির নেপথ্য হস্তক্ষেপে হচ্ছে কিনা তা জানা যায়নি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্যা নিরসনে কাস্টমস পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তবে শনিবার থেকে এ পথে আমদানি, রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন বলেও হুমকি দেয় তারা। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি না হওয়ায় এই চক্রের হোতারা বেকায়দায় আছেন বলে জানা গেছে। এসব কারণেই ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের মত বেনাপোলে কাস্টমসে দায়িত্বরত কমিশনারসহ চার শীর্ষ কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিতে জড়িত অন্য কারও সম্পদের তদন্ত হবে কিনা তা নিয়ে দেশের বৃহত্তম এই বন্দর জুড়ে ব্যাপক গুঞ্জন চলছে। বিশেষ করে ফলকাণ্ডে জড়িত তিনজনসহ চার শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িতদের নগদ অর্থসহ সম্পদ-সম্পতির খোঁজে মাঠে নামার দাবি জোরালো হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের মত বেনাপোলে দায়িত্বরত কমিশনার আব্দুল হাকিম, জয়েন্ট কমিশনার (জেসি) সাফায়াত হোসেন, জয়েন্ট কমিশনার (জেসি) হাফিজুল ইসলাম এবং ডেপুটি কমিশনার অথৈল চৌধুরীর নগদসহ সম্পদ সম্পতির খোঁজে সংশ্লিষ্টদের মাঠে নামার দাবি উঠেছে। এখানেও কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেনাপোলের একাধিক সিএণ্ডএফ এজেন্ট দাবি করেছেন।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়