২২শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৬ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

ঢাকা শহরটি কেউ ভালোবাসি না শুধু ব্যবহার করি

শাহানা হুদা রঞ্জনা
মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে ঢাকার বাতাসে হয়তো কোনো মাদকতা ছড়ানো আছে। তা না হলে ‘বসবাসের অযোগ্য’ এই শহরটি আমাদের এত টানে কেন? এত অনুযোগ ও অভিযোগ থাকার পরও কেন পালাতে পারছি না এই শহর ছেড়ে? একবার এই দূষিত শহরে যারা বসতি গড়েছেন, তারা বড়ধরনের কোনো বিপদে না পড়লে এই শহর ছেড়ে যেতে চান না।
মানুষের রুটি-রুজির সংস্থান হয় এই শহরে। এভাবেই মানুষ বাড়তে বাড়তে ঢাকার জনসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে চার কোটি। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য আবাসন ও খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঢাকা নামক এই মেগাসিটি বা অতিমহানগরীর নিজেরই শ্বাস বন্ধ হতে চলেছে, সে অন্যকে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেবে কীভাবে? জনসংখ্যা অনুপাতে মহানগরীর কোনো সুযোগ-সুবিধাই নিশ্চিত করতে পারেনি ঢাকা।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তাই এই শহরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন জন্মকালের বন্ধন। কেউ এই শহরের নিন্দা করলে, কোথাও বাজে কোনো রেটিং হলে, অব্যবস্থা দেখলে মনটা খুব খারাপ হয়। এই যে কিছুদিন পর পর ‘অবাসযোগ্য শহর’ হিসেবে ঢাকার নাম উঠে আসে, এতে ঢাকাবাসী হিসেবে খুব কষ্ট হয়। আক্ষেপ হয় কেন এত সুন্দর একটি শহর এভাবে তলিয়ে যাচ্ছে? এজন্য দায়ী কে আমরা নগরবাসী, নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজউক নাকি সিটি করপোরেশন?
এই শহরে একসময় অনেক গাছ-গাছালি ছিল, শিয়ালের ডাক শোনা যেতো, শীতের আগমনী বাতাস শরীরে লাগতো, গান গেয়ে বোঝাতে হতো না যে বসন্তকাল এসেছে-নবীন পাতার দুলুনিতেই বোঝা যেতো ঋতুরাজ এসেছে। নাগরিক জীবনেও আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারতাম, কখন কোন ঋতু আসছে। বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটে, মাঠে পানি জমতো। কিন্তু পলিথিন ও আবর্জনা খুবই কম ছিল বলে, সেই পানি দ্রুত সরে যেতো।
সত্তর দশকে এবং আশির দশকের প্রথমদিকে আমরা বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে পা ভিজিয়ে ঘুরে বেড়াতাম পাড়ায়। ছেলেপেলেরা পানিতে ভেসে আসা মাছ ধরতো। বৃষ্টির পরের দিন মাঠে ঘাসের হলুদ পাতা জমে যেতো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল কোথা থেকে যেন এক পাল হলুদ ব্যাঙ এসে মাঠে বসে ঘ্যাংর-ঘ্যাং করে ডাক ছাড়তো প্রতি বর্ষায়। সন্ধ্যার পর মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে যেতে রীতিমতো গা ছমছম করতো। পথের দুপাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় দিনেরবেলা পথচারীদের জন্য ছিল আশীর্বাদ। কেন, কার পরামর্শে এই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে জানি না। গাছ রেখেও যে নগর পরিকল্পনা করা যায়, এই কথাটি মনে হয় আমরা এখনো জানি না।
এই শহরে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মাঠ ছিল, নিরাপত্তা ছিল, শিশুদের জন্য খেলার জায়গা ছিল, খেলাঘর ছিল, কচিকাঁচার আসর ছিল, পাঠাগার ছিল। এই শহরেই আমরা প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে বড় হয়েছি, খেলেছি, দুষ্টুমি করেছি, গাছ থেকে ফল-ফুল চুরি করেছি। শবে বরাত, রোজা, পূজা ও ঈদে এর-ওর বাড়ি ঘুরতে গেছি। নাড়ু–, সেমাই-পায়েশ-মাংস ভাগ করে খেয়েছি। পাড়া-মহল্লাগুলো যেন ছিল পরিবারের বর্ধিত অংশ।
নগরীর ছায়া ঢাকাপথে মানুষ রিকশা বা হেঁটেই চলাচল করতো। গাড়ির পরিমাণ এত কম ছিল যে হাতেগোনা যেত কখন কয়টা গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। ছোট ছোট দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ছিল। টিংটিং করে ঘণ্টি বাজিয়ে বেবি আইসক্রিমওয়ালা রাস্তা দিয়ে যেতো। কাঠের বাক্সে ছিল বরফগোলা আইসক্রিম আর টিনের বাক্সে বিক্রি হতো হট প্যাটিস।
তরুণ বয়সে এই শহরে আমরা এক মাথা থেকে আরেক মাথায় রিকশা করে ঘুরে বেরিয়েছি, ইউনিভার্সিটি থেকে ইচ্ছে মতো যে কোনো জায়গায় সবাই মিলে বাসে বা রিকশায় চেপে ঘুরেছি। কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধুরা নিউমার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে বা অযথাই ঘোরাঘুরি করে বলাকা বা বিডিআর হলে সিনেমা দেখেছি।
বড় হতে হতে এই শহরটাই ক্রমে অচেনা হতে শুরু করে। আর এখন তো মনে হয় এই শহর আমার সেই মায়াভরা শহর নেই। এই শহরে প্রতিদিন নতুন মানুষ যোগ হচ্ছে, নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে এবং সবই হচ্ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া। কিন্তু আমরা অনেকেই পালাতে পারিনি এই শহর ছেড়ে। সুমনের গানের মতো বলতে চাই, “এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু, পালাতে চাই যতো সে আসে আমার পিছু পিছু।”
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই শহর বড় হতে শুরু করলো, গাছ কেটে ভবন বানানো হলো, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে শপিং কমপ্লেক্স, গার্মেন্টস, অফিস বানানো হলো। ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করলো জ্যামিতিক হারে। যারা পড়াশোনা করতে বা কাজ নিয়ে ঢাকায় আসতেন, তারা পারতপক্ষে কেউ ফিরে যেতেন না এবং এখনো যান না। কারণ ঢাকা ছাড়া বাইরের জেলায় কাজের ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। পথে গাড়ি নামানো হলো ব্যবসার কথা মাথায় রেখে। ফলে কোয়ালিটি নিশ্চিত করা না গেলেও গণপরিবহন বাড়লো। গণপরিবহনের চেয়ে বাড়লো ব্যক্তির ট্রান্সপোর্ট।
পরিকল্পনাহীনভাবে নগরায়ণ হলে যা হয়, ঢাকার তাই হয়েছে। ৫০ লাখ মানুষ থাকার মতো একটি শহরে প্রায় দুই, আড়াই কোটি মানুষ বসবাস করছি। এদের জন্য চাই বাড়িঘর, পরিবহন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ। কম আয়ের মানুষের জন্য গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য বস্তি। এদের কাজের জন্য গড়ে উঠেছে ফুটপাতজুড়ে দোকানপাট।
সবাই মিলে ময়লা-আবর্জনা, কফ-থুথু ফেলে, প্রস্রাব-পায়খানা করে, গাড়ির কালো ধোঁয়া ছেড়ে ও হর্ন বাজিয়ে এই শহরকে ভাগাড়ে পরিণত করেছি। উচুঁ ভবনে বসবাসরত শিক্ষিত ও ধনী-মধ্যবিত্ত নগরবাসীর অধিকাংশেরই নেই কোনোরকম পৌরজ্ঞান। রাজউকে টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট, অফিস, সুপারশপ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট বানিয়েছে কিন্তু গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। কাজেই ঢাকার রাজপথ এখন পাকিং লটে পরিণত হয়েছে। বড় বড় বাস, ট্রাক রাখার জায়গাও এই রাস্তা। তাদেরও কোনো টার্মিনাল বানাতে হয় না।
এখন ক্রমাগত বলা হচ্ছে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহর। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ষষ্ঠ। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোর মতো সূচকের আলোকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর হয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ সাড়ে চার কোটি মানুষ থাকেন ঢাকায়, সেখানে ভিয়েনার লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে আঠারো লাখ। তাই খুব স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ঢাকা কেন অবসবাসযোগ্য শহর। বসবাসের যোগ্য তালিকার শীর্ষ পাঁচ শহরগুলো হলো- ভিয়েনা, কোপেনহেগেন, জুরিখ, মেলবোর্ন ও ক্যালগারি। এই শহরগুলোর সাথে শুধু জনসংখ্যা দিয়ে তুলনা করলেই বোঝা যায় কেন আজ ঢাকার এই দুর্গতি। কেবলই জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে নেই নগর-পরিকল্পনা, আলো-বাতাসের ব্যবস্থা, পার্ক, চিকিৎসা সুবিধা, ও আইন রক্ষাকারীর সংখ্যা।
আজকের ঢাকার আকাশ, বাতাস, রাস্তাঘাট, গাছগাছালি দেখে আমার কেবলই মনে হয় ছেলেবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটির কথা। কবি কী স্পষ্ট করে ঢাকার ভবিষ্যৎ চেহারা বলে গেছেন এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে, তা ভাবতেই অবাক লাগে-
“ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হলো উহ্য।”
এখানে সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে যায় ধুলাবালি দিয়ে, ঢাকার বাতাসে ধুলার গন্ধ মিশে থাকে। মিশে আছে সিসা, যা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এই নগরীতে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছেন তাদের নাকাল হতে হচ্ছে নানাভাবে। ধুলাবালি, খানা-খন্দক, রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, ড্রেন পরিষ্কার, পাইপ বসানো, বৈদ্যুতিক লাইন টানাসহ নানান ধরনের কাজ হচ্ছে এই শহরে। সবসময় নগরীর কিছু অংশে ভাঙাভাঙির কাজ চলতেই থাকে এবং ইট, সুড়কি, লোহা, সিমেন্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যত্রতত্র। তাই ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র চোখে ঝাপসা দেখতে হয়। এসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে কিন্তু অবস্থা তথৈবচ।
ঢাকাবাসীর ক্রমাগত সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব চেস্টের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রাশেদুল হাসান বলেছিলেন, যেসব শিশু ধুলার সংস্পর্শে আসে তাদের ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১০ জন শিশুরই অ্যাজমা বা হাঁপানি হয়। আর বড়দের মধ্যে শতকরা ৭ থেকে ৮ জন আক্রান্ত হন ক্রনিক ব্রংঙ্কাইটিসে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ধুলার মধ্যে যদি দূষিত দ্রব্যের কণা মিশ্রিত থাকে, তাহলে তা থেকে হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসার। এমনটাই তো ঘটছে। ঘরে ঘরে শিশুরা সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
২০১১ সালে ঢাকার বাতাস নিয়ে নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চ এবং ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট ইন বাংলাদেশ- এর করা একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন পার্টিকুলেট এর মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৪৬৩ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছেছে, যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাত্রার। ১৩ বছর পরে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে।
আমাদের প্রিয় নগরীর ঘরবাড়ি, যানবাহন, দোকানপাট, কুল, গাছপালা সবকিছু এক হাত ধুলার নিচে ঢাকা পড়ে আছে, এমনকি মানুষগুলোও। সারাদিন শব্দ, গাড়ির তীব্র হর্ন, চিৎকার, চেঁচামেঁচির কারণে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যাকে নরক বলা যায়।
কবিগুরুর কবিতা দিয়েই লেখাটা শেষ করছি –
“পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
সর্দিজ্বরে উজাড় হলো দেশটা।”
কবিতাটির প্রতিটি লাইন খাপে খাপে মিলে গেছে আমাদের ঢাকা মহানগরীর সাথে। পরিকল্পনা ছাড়া নগরায়ণ, উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে বলে, সেই চাপ এখন ঢাকাকে বহন করতে হচ্ছে। মানুষ কোথায়, কীভাবে থাকবে এই পরিকল্পনা করতে না পারলে তো ঢাকাকে ক্রমাগতই পেছনে হাঁটতে হবে। আমরা দেখছি আমাদের এই প্রাণপ্রিয় শহর, কীভাবে দুর্ভোগের শহরে পরিণত হচ্ছে। এই শহরের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হচ্ছে কেউ এই শহরটি ভালোবাসে না, শুধু ব্যবহার করে।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়