২১শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৫ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

মামুন মুস্তাফার কবিতা: অন্তরের অনুপ উল্লাস

প্রতিদিনের ডেস্ক:
মামুন মুস্তাফা বিগত বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে বাংলা কবিতার সদনে পদচারণার সুবাদে এখানকার একজন স্বজনের পরিচিতি অর্জন করেছেন। দশকটি ও তার পরবর্তী সময়ের কবিতাকেন্দ্রিক বিবিধ ভাঁজ-অনুভাঁজের পরতে কণ্ঠের নম্র উদ্ভাসে তিনি পাঠককে তাঁর দিকে আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। কবিতার শৌখিন মজদুরি থেকে তিনি দায়বদ্ধ ঋষভের পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করেছেন। এখন এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও সে-কথা বলাই যায়। মামুন মুস্তাফা স্পষ্টতই স্বচ্ছ মনন ও সেই মাননিক ঋদ্ধিতে তাঁর বোধের খেয়া ভাসিয়ে রেখেছেন। কবিতা তো বস্তুত সাহিত্যের সবচে’ সম্ভ্রান্ত বা কুলীন পরোয়ানা। এর নির্মাণকলা থেকে উচ্ছ্রিত আলোকদ্যুতির কণামাত্রের ছোঁয়াতেও সংবেদে যে-দোলা লাগে, তাতে লগ্ন-মগ্ন মহাজনের সংখ্যা কম নয়। এই প্রৌঢ়া, প্রাচীনা ও বহুদর্শিনী অথচ চঞ্চলা দেবীকার পদতলে তাই অর্ঘ্যদানের সীমা-পরিসীমা ছিল না কোনো কালেই, আজও সেই ভজনায় বিরতি নেই। বরং অর্ঘ্যদাতা ও অর্ঘ্যদাত্রীর সংখ্যাধিক্যে কবিতা দেবীকার ‘ঢের পেয়েছি’ ধাঁচের পুরুষ্টু মৃদুহাসি অতি আবশ্যিকভাবে প্রার্থিত এই সজনে কিংবা বিজনে।চলমান বিভিন্ন গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবি ও কবিতার নামে হরেক রকম ব্যাজস্তূতির মার্গে এ-প্রতীতির গাঢ়তাপ্রাপ্তিই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে দুরন্ত খিস্তি আউড়ে সদল বা নির্দলীয় আশ্লেষে বিব্রত হবার তাই জোরালো কোনো প্রেক্ষিত দেখি না। বরং এ ঢক্কা-নিনাদের তালে বা বেতালে ধ্যান ও মনস্বিতার পুণ্ডরীক ফুটিয়ে যাঁরা দিগবিস্তার ও সৌরভ বিতরণে যোগ্য হয়ে উঠেছেন অজান্তে, সেই পরশপাথর খোঁজা স্বয়ং পরশপাথরের সন্ধান পেতে রসিকজনেরও খামতি নেই—এই অধ্যাস মোটেও উপেক্ষিত থাকার মতো নয়। মামুন মুস্তাফা শেষোক্ত বিতানে তাঁর ঔজ্জ্বল্য প্রমাণে ঝুলে আছেন হীরক আংটা হয়ে আর তা মৌন-মধুর আকর্ষক বিভায় দ্যুতিমান তো নিশ্চয়ই। তাঁর প্রধান অভিপ্রায় আত্মকুণ্ডয়নে দ্বন্দ্বিত বা বিবাদমুখর থাকাতে নয়। তিনি বরং মননের সপ্রকাশে সচ্ছল ও সাবলীল থাকতে চান। নিরন্তর আত্মখননপ্রবণতা তাঁর মননের তৃপ্তিহীনতাকে দ্যোতিত করে। এই সচলতার যজ্ঞে ব্যাপৃত ব্রাহ্মণদের পৌরোহিত্যের বেদিতে উপবেশনে আগল থাকে না কোনো। বরং দৌবারিক এখানে গৌরবদানে সদা স্মিতহাস্যময়। তাঁর নির্বাচিত কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং কবিতাসমগ্র ব্যতিরেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত মৌলিক বারোটি কাব্যের সৃজনসম্ভার বীক্ষণে পাঠক একজন পূর্ণ কবির সত্তাতেই বিচরণ করেন।দুই.
এসব কাব্যপুস্তিকায় মামুন মুস্তাফার ঘনিষ্ঠ স্বদেশ ও ব্রহ্মাণ্ডবিহারের আলেখ্য ধরা আছে যেন একটি অখণ্ড তোড়ায়—নানা কুসুমের সুবাস ও রঙের বিচিত্রতার মতো। তাঁর এই ঐকান্তিক সংযুক্তির দিকে তাকিয়ে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, ‘সব মিলিয়ে কবিতারচনা ছাড়া অস্তিত্বের অন্যতর কোনো তাৎপর্য থাকে না।’ (ভূমিকা, ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র)। এই কবি এমন এক পরাভাষায় কবিতার তাঁত বোনেন, যেখানে ব্যক্ততার পাশাপাশি অনুক্তি ও অনুরণনের ইশারাও ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায় বোধের উজ্জয়িনীকে। বেদনা-বিষাদের ইতিহাসচেতনা ও ইতিহাসের অনুবর্তী বাস্তবতার প্রতি তাঁর পক্ষপাত একটি অনুক্ষণ জাগ্রতসত্তার আদল হয়ে থাকে। মামুনের কবিতাপাঠ শেষে এ প্রত্যয়ও দৃঢ় হয় যে, কবিতার সর্বগ্রাসী বুভুক্ষা জীবন ও জীবনেতর বিষয়-আশয়সমূহকেও তার অতল আধারে অতি সাবলীলভাবে একীভূত করে, যদি সেই মনন ও মননঋদ্ধির চাষাবাদে শৈল্পিক সততা ও সক্রিয়তা বিরাজমান থাকে কবিতাস্রষ্টার। বহু শতাব্দী আগে সংস্কৃত কবি ভমহ’ও বলেছিলেন প্রায় একই কথা:
‘ন স শাব্দো ন তদ্বাচ্যং ন স ন্যায়ো ন বা কলা
জায়তে যন্ন কাব্যাঙ্গাং অহো ভাবো।’
অর্থাৎ—এমন শব্দ নাই এমন যুক্তি নাই এমন কলা নাই—যা কাব্যে অঙ্গীভূত হয় না।আগেও বলেছি, মামুন উচ্চকণ্ঠ নন, নম্রভাষণেই প্রকাশে অভ্যস্ত তিনি গুঞ্জরণের মতো তাঁর সদ্ভাব সমুচ্চয়। তাঁর রচনা থেকেই কিছু উদ্ধৃতি:
১: সাবিত্রীকে হৃদয়ে ধারণ করে
আমরা বসবাস করেছি,
আমি ও আমার বন্ধু।
সাবিত্রী ভালবেসেছিল আমার বন্ধুকে
আমার সে বন্ধু আজ পরবাসী।
আমি তার সাথে পথে হেঁটে
শুধু মুগ্ধ হয়েছি সাবিত্রীর মোহে,
সাবিত্রী আমাকে দ্যায়নি তার
ভালবাসার ছিটেফোঁটা।
তবু আমি আজও পথ হাঁটি
সাবিত্রীর ভুবনে।…
(সাবিত্রীর জানালা খোলা, ‘সাবিত্রীর জানালা খোলা’)
২: … সংসারী বউ সে
খুলে রেখে গেছে অন্তর্বাস
নরকে ডুবে ডুবে তোলে স্বপ্নলতা
ঘেমে ওঠা শরীর ধুয়ে নেয় পাঁকজলে,
উনুনের তাপে লাল হয়ে ওঠা যুবতীশরীর
ধোঁয়া ওঠা ভাপে শঙ্কা ঝরে পড়ে
দাস্যসুখ নির্মাণ করে রাতের ঝাউবন। …
(বউ, ‘কুহকের প্রত্নলিপি’)
৩: … আলো,
এক সম্পন্ন ভোর তুমি আনবে কি? ওঁ
নমস্তুতে ভরে আছে দিগ্বলয়। পাখিডাকা
ভোর। মোরগের বাগ। মানুষের
কুশল বিনিময়;— সেই এক মোহিনী
সকাল আমাদের সংসার হতে হারিয়ে
গেছে বিস্মরণে।
আলো,
তুমি ছিঁড়ে আনো সেই লক্ষ্মী হিঙ্গুল সকাল।
(আলো, হারানো বিজ্ঞপ্তি, ‘এ আলোআঁধার আমার’)
৪: ওই দরজাটা আজ ইতিহাস। বকপক্ষী নীড়ে
কেটে গেছে গোপন রাত। সূর্যোদয়ে দেখি
রাজনীতির মঞ্চভাঙা! ‘সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যে’র
জঠরে হামাগুড়ি দেয় অসহায় তৃতীয়বিশ্ব। নিজেরে
হারায়ে খোঁজে স…ব বামরাজনীতিক। তুমি যাদের
জল দিয়েছিলে পিপাসার …
(নকশালবাড়ি, ‘পিপাসার জলসত্র’)
৫: বাজারের থলি থেকে ইলিশের কানসা
বোয়ালের লেজ চিতলের পেটি তড়পায়
কুয়ো পাড়ে। আবারও কুয়োর জলে
বালতি নামালে— এবার অমাবস্যার চাঁদ
তোমার ক্ষয়ক্লিষ্ট দাম্পত্য গিলে খেলো,
খিড়কি দরোজা খুলে পালায়
একমুঠো জীবনেশ্বর!
(জীবনেশ্বর, ‘যাপনকথা’)
তিন.‘শিখাসীমন্তিনী’ কাব্যে একটি নতুন নিরীক্ষার প্রেক্ষিত ডানা মেলেছে, তা হলো: বাংলা কথাসাহিত্যের নন্দিত কয়েকটি উপন্যাসে বিধৃত প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোকে নিয়ে কবির মন্তাজক্রীড়া। এখানে শ্রীকান্ত (‘শ্রীকান্ত’: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), নিতাই (‘কবি’: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), কুসুম (‘পুতুল নাচের ইতিকথা’: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়), মাধবী রায় (‘জতুগৃহ’: সুবোধ ঘোষ), ছোট বৌঠান (‘সাহেব বিবি গোলাম’: বিমল মিত্র), বিলাস ও মনিক চ্যাটার্জি (‘গোলাপসুন্দরী’: কমলকুমার মজুমদার), দরিয়াবিবি (‘জননী’: শওকত ওসমান), সুবন্ন পদুমা (‘চাঁদবেনে’: অমিয়ভূষণ মজুমদার), বিলাস ও হিমি (‘গঙ্গা’: সমরেশ বসু), জোবেদা (‘কাশবনের কন্যা’: শামসুদ্দীন আবুল কালাম); কুট্টিবালা (মঙ্গাকালের প্রণয়মঙ্গল’: আবুবকর সিদ্দিক); সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গা (‘আগুনপাখি’: হাসান আজিজুল হক); রাবেয়া (‘নন্দিত নরকে’: হুমায়ূন আহমেদ) প্রভৃতি চরিত্র ও বিষয় যেমন; অন্যদিকে ‘একাত্তরের এলিজি’তেও নতুন এক বোধের খননক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেখি। দ্বিতীয়টিতে (‘একাত্তরের এলিজি’) রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও শাহাদতবরণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু চিঠির ভাব অবলম্বনে কাব্যকথার নয়া উন্মেষ ঘটেছে। এ রকম ৪০টি চিঠি নিয়ে এক অভিনব রচনা এটি।চার. কবি তো ভাববিভূতির পাতালে থম মেরে থাকা কোনো বিবশসত্তা নয়। সুপরিসর স্বপ্নের তালাশে তিনি যুগপৎ স্বতশ্চল পথচারী ও নভোবিহারী। মানুষ এবং মানবিকতার বিজয় বৈজয়ন্তীর সঙ্গেই তার নিত্য ওড়াউড়ি। শুভ ও সুন্দরের বিরোধীয় শক্তিসমবায় শুধু প্রার্থিত মানবিকতার নয় বরং মানবিকতার পরম উৎসারণ শিল্প-সাহিত্যের সমস্ত অর্জনের সৌধমালায়ও কালিমা মেখে দিতে তৎপর। কেবল বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়াতেই এ দৃশ্যের মঞ্চায়ন নয়, বিশ্বভূখণ্ডের দেশে-দেশে এই অপচ্ছায়া নিত্যনতুন ভয়ংকর পাখসাটে জায়মান ও উড্ডীন। সে কারণেই কখনো-সখনো বৃহত্তর মানবিকতার শুভাস্তিক চেতনাকে সামনে এনে ঘরশত্রুদের শাসাতে হয়। তাই তো পথশিশুদের সঙ্গে ঢাকার ফুটপাতে অবাধে মিশতে গিয়ে এক ভক্তের প্রশ্নের জবাবে ভুবনবিখ্যাত অভিনয়শিল্পী অড্রে হেপবার্ন বলেন: ‘হিউম্যানিটি ইজ দ্য বেস্ট অব অল আর্টস’। অন্যদিকে কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তির উন্মোচনে সিরীয় কবি আদোনিস (আলী আহমাদ সায়ীদ এসরার)-এর একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি স্মরণ করি: ‘একটি তুচ্ছ গ্রেনেড বা গুলি কবিতার চেয়ে অনেক প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে। ফলে পরিবর্তন কথাটাও উপলব্ধি করার দরকার আছে। কবিতা এমন কিছু বিষয়কে পাল্টে দেয়, যা কবিতা ছাড়া আর অন্যকিছু দিয়ে পাল্টানো সম্ভব নয়। ভাষার ভেতরকার সম্পর্কগুলোকে কবিতা আমূল পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় ভাষা আর আমাদের চারপাশের বস্তুপুঞ্জের সম্পর্ক। কবিতা আসলে পৃথিবীর চিত্রই পাল্টে দেয়। কবিতার মধ্যে আমরা পাই পুরোনো পৃথিবীর নতুন সম্পর্কের সম্পূর্ণ নতুন একটি উপলব্ধি।’কবি আদোনিসের এই বক্তব্যের আঁচ রয়েছে মামুন মুস্তাফার বাংলা ধ্রুপদি উপন্যাসসমূহের মহান চরিত্রগুলোর ভেতর সঞ্চরণশীল জীবন-জিজ্ঞাসার কাব্যিক বয়ানে। এবং রণাঙ্গন থেকে মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করার শপথে সংশপ্তক লড়াকু ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠির বক্তব্য থেকে আহরিত মর্মকথাসমূহের প্রেক্ষাপটে নতুন সময়কে তুলে আনার প্রয়াসের মধ্যে। প্রচলিত কবিতার ধারাপ্রবাহে মামুন মুস্তাফার এই নিরীক্ষা অন্তরের অনুপ আলোয় ধৌত। তাই কবিকে ভারতচন্দ্রের ভাষায় নন্দিত করি এই বলে: ‘তব মায়া ছান্দে, বিশ্ব পড়ি কান্দে…।’

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়