২৪শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৮ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদনে ধস

প্রতিদিনের ডেস্ক॥
তীব্র আকার ধারণ করেছে চলমান গ্যাস সংকট। শিল্প-কারখানার উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। কলকারখানা মালিকরা সরকারের একাধিক দপ্তরে চিঠি দিলেও মিলছে না প্রতিকার। রিমালে একটি এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত কয়েক সপ্তাহে এই সংকট আরও বেড়েছে।
পেট্রোবাংলা বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে সামিট গ্রুপের একটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্যাস সরবরাহ কমেছে। তবে একটি পাইপলাইনে একাধিক শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ায় লাইনের শেষ প্রান্তে থাকা কারখানাগুলো গ্যাস কম পাচ্ছে।
আর গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বলছে, তাদের কাজ শুধু গ্যাস সংযোগ ও সরবরাহ করা। পেট্রোবাংলা যে পরিমাণ গ্যাসের জোগান দিচ্ছে তারা সেই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করছে।
তবে চলতি মাসের মাঝামাঝি সংকট কেটে সমাধানের দিকে যাবে বলে দাবি করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটি। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এমনিতেই দীর্ঘদিন গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্পখাত। এ সংকট থেকেই সরকার গ্যাস আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু হয়।
সংকট কাটতে পারে মাসের মাঝামাঝি
সূত্র জানায়, স্থানীয়ভাবে গ্যাসের উৎপাদন না বাড়ায় দেশের গ্যাস খাত অনেকটাই বিদেশনির্ভর। এলএনজি আমদানি করে তা গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে একটি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। ৬ অথবা ৭ জুলাই সামিটের এফএসআরইউ সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। ১২ জুলাই এটি দেশে পৌঁছাবে। দেশে পৌঁছানোর পর কার্যক্রম শুরু করতে আরও তিনদিন সময় লাগতে পারে। এর আগে চলমান গ্যাস সংকট কাটছে না।
সমাধান চেয়ে কারখানা মালিকদের চিঠি
গ্যাস-সংকটের সমাধান চেয়ে গত সপ্তাহে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ)। চিঠিতে সংগঠনটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা উল্লেখ করেন, সিরামিক কারখানার চুল্লি চালাতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই ছাড়া চুল্লির ভেতরে উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। গ্যাসের চাপ কমে গেলে চুল্লির ভেতরে থাকা সব পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আর একবার চুল্লি বন্ধ হলে চালু করতে সর্বনিম্ন ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে।গ্যাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান রুগণ হয়ে পড়লে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে বলেও চিঠিতে সতর্ক করা হয়।
‘তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে টেক্সটাইল মিলগুলো স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কয়েক মাস ধরে মিলগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে সুতা ও কাপড়ের উৎপাদন কমেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ ফেব্রিক প্রসেসিং ব্যয়ও বেড়েছে, যা এ খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে।’
তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদনে ধস সম্প্রতি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে লেখা এক চিঠিতে একথা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির পক্ষে দেওয়া ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন।
চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, সাভার, আশুলিয়া, মাওনাসহ দেশের অন্য এলাকায় অবস্থিত স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হয়। বিটিএমএ চিঠিতে আরও জানায়, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সরাসরি প্রভাব রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে পড়েছে। গ্যাসের অভাবে যদি বিটিএমএর মিলগুলো সময়মতো তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সুতা ও কাপড় সরবরাহ করতে না পারে তাহলে যথাসময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করা সম্ভব হবে না।
দাম বাড়লেও বাড়েনি সরবরাহ
গত বছরের জানুয়ারি মাসে গ্যাস ট্যারিফ প্রতি কিউবিক মিটার ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা ধার্য অর্থাৎ ৯৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বাড়িয়ে আশ্বস্ত করা হয়, এরপর থেকে শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বিগত এক বছরের বেশি সময় মিলগুলো বর্ধিত গ্যাস ট্যারিফ দিলেও গ্যাসের সরবরাহ কখনোই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। ফলে মিলগুলোর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় রপ্তানি আদেশ পরিপালন করতে পারছে না।
পেট্রোবাংলা ও তিতাসের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘মিল মালিকরা সাধারণ কথাবার্তা বলছেন। একটি পাইপলাইন থেকে দুই অথবা তিনটি কলকারখানা সংযোগ পেতে পারে। কিন্তু আলাদা পাইপলাইন না করে একই পাইপলাইন থেকে তিতাসের কাছ থেকে তারা ১০ জন সংযোগ নিচ্ছে। একটি পাইপলাইন থেকে এভাবে ১০ জন সংযোগ নেওয়ায় গ্যাস থাকা সত্ত্বেও শেষ প্রান্তের গ্রাহক পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না।’তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘আমরা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে মিটারের ছবি তুলে পাঠাচ্ছি। আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, ফতুল্লা গাজীপুরের মাওনাসহ সব জায়গায় গ্যাস সংকট। পেট্রোবাংলা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে যে তারা গ্যাস দিতে পারছে না।’
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ বলেন, ‘এই লাইন তিতাস দেয় না বা কিছু করে না। এগুলো দেশের বিষয়, দেশে ইন্ডাস্ট্রিলাইজেশন করার স্বার্থে বোর্ড মিটিংয়ে ডিসিশন হয়। এটি ইচ্ছা করে কেউ কাউকে দেয় না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো গ্যাস আনি না, গ্যাস আনে পেট্রোবাংলা। আমাদের কাজ হলো ডিস্ট্রিবিউশন করা। একটি এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৫০০ মিলিয়ন ফুট গ্যাস কাট হয়েছে। এজন্য সাফার করতে হচ্ছে। এটি এই মাসের মাঝামাঝি চলে এলে সংকট কেটে যাবে।’
সার্বিক বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আগে ৩১০০ থেকে ৩১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হতো। তখন কোনো সমস্যা ছিল না। এফএসআরইউ দেশে এলে সংকট কেটে যাবে।’
চেয়ারম্যান বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান আপাতত করা যাবে না। আমি যতই গ্যাস দেই না কেন, পাইপলাইনের প্রথমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে তারা গ্যাস পেয়ে যাবে। তারপরও আমরা কেস টু কেস স্টাডি করে দেখবো কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়।’

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়