৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ২১শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

থামছেই না সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচার: সিণ্ডিকেট প্রধান আফিলের মাফিয়া ডন নাসির

সুন্দর সাহা
প্রায়শই পুটখালীসহ যশোরের শার্শা-বেনাপোল ও চৌগাছা সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে সোনা ধরা পড়ে। এতো সোনা ধরা পড়ে বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জব্দ করে যে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে আসে এসব সোনার চালান আর কারাই বা জড়িত এই পাচারে? আর তারা কেনো ধরা পড়ে না। ভারতে সোনার চাহিদা এবং দাম বেশি হওয়ায় যশোরের বিভিন্ন সীমান্ত পথে সোনা পাচার করছে আন্তর্জাতিক ও দেশী পাচারকারীরা। সীমান্তে সোনা পাচারে সবার উপরে রয়েছে বেনাপোল পোর্ট থানার অবৈধ ঘাটগুলি। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ এসব ঘাট দিয়ে ভারতে পাচার হয়। বেনাপোলের যে সব সিন্ডিকেট আছে তাদের অধিকাংশের মূল মালিক হচ্ছে আন্তর্জাতিক সোনা পাচার চক্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল হোতা আলোচিত ভয়ঙ্কর নাসির উদ্দীন, খচ্চর রমজান, বারোপোতার রেজা-ওলিয়ার, সন্ত্রাসী-কিলার বাদশা, রেজা-জিয়া, কামাল-বাবু মেম্বারসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন পাচার হয় অধিকাংশ সোনা। এছাড়াও সাদীপুর, দৌলতপুর এবং বড়আঁচড়া রেল লাইন দিয়েও বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


সীমান্তের সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান চললেও সোনা পাচারের এসব সিন্ডিকেটের অঘোষিত মালিকরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। এই চক্র প্রতিদিন পাচার করছে কোটি-কোটি টাকা মূল্যের সোনার বার। পাচার হওয়া সোনার খুব কমই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তবে যখন ধরা পড়ে তখন কেজি কেজিই ধরা পড়ে। কেজি কেজি সোনা একবার ধরা পড়ার পর এ কথা আলোচনায় আাসে যে এতটা ধরা পড়লে পাচার হয় কত? বিপুল পরিমাণ সোনা পাচারের কথা বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছেন বিজিবি-৪৯, বিজিবি-২১ ও বিজিবি-৩৩ ব্যটালিয়নের সিও। তাদের মতে, বিজিবির তৎপরতা রয়েছে, ধরাও হচ্ছে তবে প্রতিনিয়তই পাচারকারীরাও রুট পাল্টিয়ে নতুন রুটে নতুনভাবে পাচার করে। অভিযোগ রয়েছে বিজিবি সোনা পাচার ধরার ব্যাপারে যতটা আন্তরিক র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতা ততটা চোখে পড়ে না। এ নিয়ে নানান মহেলে নানা গুঞ্জন রয়েছে। অনেকের অভিযোগ পুলিশ দেখেও দেখে না অথবা আরো কিছু বলে।
সূত্রের দাবি উদ্ধার হওয়া এসব চালান পাচারকারীরাই ধরিয়ে দেয়। সে সুযোগে সীমান্ত নিরাপদ রেখে পাচার করে একেক চালানে ১-২ মণ যাতে ধরিয়ে দেয়া সোনার দামও লাভ যুক্ত করে উসুল করা যায়। সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র বিভিন্ন সময়ে এই পাচারকারী হিসেবে যাদের নাম সামনে এনেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে সেগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। সূত্র মতে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারী এপারের মাফিয়া ডন আলোচিত নাসির, চিটার রমজান, কামাল, মহব্বত এবং রঘুনাথপুরের ফেন্সি সম্রাট বাদশা ছাড়াও ঘিবার শাহজাহান, পুটখালীর ইব্রাহিম, আলমগীর, খোড়া মুনসুর, সিরাজুল পন্ডিত, রায়হান, সাদীপুরের আলোচিত মেম্বার সিন্ডিকেট, ছোট-আঁচড়ার রেজা, হায়দার, নুরুল ইসলাম, আশা, জাকির ও বকুল, বড়আঁচড়ার কামাল, পুটখালীর রেজা ও জিয়া, বারোপোতার রেজা-ওলিয়ার সিন্ডিকেটগুলোর সোনা পাচারের পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক পাচারে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। রঘুনাথপুরের আখের, গাতীপাড়ার আলিমুর, মিন্নু, সালাম মাষ্টার ও শহিদুল, পুটখালীর ওলিয়ার, সেলিম উদ্দীন, জাকির হোসেন, আমির হোসেন, সাহেব আলী, আরিফ, আলমগীর-১, ইকবাল ও আলমগীর-২, ছোট-আচড়ার খায়ের, দৌলতপুরের আয়ুব, পুটখালীর মিলন ও জামাল, দুর্গাপুর রোডের জিয়া এবং ধান্যখোলার বাচ্চু ছাড়াও গোল্ডেন সুমনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা ভারতে পাচার হচ্ছে। তবে যশোরের শার্শা, বেনাপোল ও চৌগাছার সবগুলি সীমান্ত দিয়ে যত সোনা যায়, পুটখালী সীমান্তের ৭/৮টি পকেট ঘাট দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি সোনা ভারতে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার কখনও কখনও তাদের ম্যানেজ করে চলে সোনা পাচারের রমরমা ব্যবসা। ঢাকা থেকে বিভিন্নভাবে এনে সোনার বারগুলো পাচার করা হয় ভারতে। ভারতের সবচেয়ে বড় ডিলার অপু, বস্ গৌতম, ছোট গৌতম, আজগার, পিন্টু, বরুণ, ডাকুসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের হাতে সোনার চালান পৌঁছে দেওয়া হয়। সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময় স্বর্ণের এসব চালান ধরা পড়ায় পাচারকারীরা কৌশল বদল করে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ভারতে সোনার দাম বেশী হওয়ায় এ সীমান্ত পথে পাচার করছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানীরা। ফলে এ সুযোগে চোরাচালানীরা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সোনা পাচার অব্যাহত রেখেছে। তবে রাঘব-বোয়ালরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ারবাইরে। সীমান্তের সূত্রগুলোর দাবি, এসব সোনার অধিকাংশের মালিক কুখ্যাত নাসির, রমজান, কিলার বাদশা, মিন্টু, কামাল, শাহজাহান, হায়দার এবং মহব্বতসহ সীমান্তের ছোট-বড় অন্ততঃ তিন ডজন সিন্ডিকেট। এরা ভারতে সোনা পাচার করে নিয়ে আসে অস্ত্র এবং মাদক। এসব সিণ্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণকর্তা হচ্ছে, পুটখালীর কুখ্যাত নাসির সিণ্ডিকেট। উল্লেখিত সিণ্ডিকেট ছাড়াও আলোচিত সোহেল, কুদ্দুস, তবি, তরিকুল, বকুল ও টিংকুসহ শতাধিক সোনা-অস্ত্র-হুণ্ডি এবং ফেন্সি সিণ্ডিকেটের মাফিয়া ডন হচ্ছে সাবেক এমপি আফিল উদ্দীন অত্যন্ত আস্থাভাজন এই নাসির। সাবেক এমপির আশির্বাদপুষ্ট বলেই কারাগারে বসেও কুখ্যাত নাসির সম্প্রতি সোনা সিণ্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখন আবার রঙ বদলানোর চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে দায়িত্ব পালনকারী ৪৯ বিজিবি যশোরের সাবেক সিও লে. কর্ণেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী বলেছিলেন, বিজিবি সীমান্ত রক্ষায় সব সময় চেষ্টা করছে। আন্তরিক রয়েছে সোনাসহ বিভিন্ন পণ্য পাচার রোধে। তারপরও নিরঙ্কুশ ও নিশ্চিত করা যায়নি। করোনার সময় বেশ কিছুদিন সীমান্ত বন্ধ থাকায় চোরাচালান কম ছিল। তাছাড়া ধরা পড়ার পর পাচারকারীরা কৌশল বদলায়, নতুন রুট তৈরি করে। ব্যবসায় তাদের লাভ বেশি তাই ঝুঁকিও তারা নেয়। তারপরও বিজিবি কাজ করছে। তিনি আশা করেন এক সময় চোরাচালান বন্ধ হবে। কোনো গড ফাদার ধরা পড়ে না বা আলোচিত হোতারা বাইরে থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অনেক সময় পরিত্যাক্ত অবস্থায় সোনর বার পাওয়া যায়। বিজিবির অভিযান বুঝতে পেরে পালিয়ে যায় মাল ফেলে। যারা ধরা পড়ে তারা বাহক মাত্র। তারা নানা কৌশলে হাত বদল করে। একেটা গ্রুপ একেক অংশে দায়িত্ব পালন করে, যার কাছ থেকে তারা গ্রহণ করে তাদের যেমন তারা চেনে না তেমনি যার কাছে দেয় তাদেরকেও চেনেনা। কিছু সাংকেতিক, কিছু সিম্বল তারা ব্যবহার করে একে অপরের কাছে বদল করে। একারণে যেমন শিকড়ের গোড়ায় যাওয়া যায় না তেমনি আটক ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় দিতে হয় এ কারণে তাদের ব্যপক জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান। তার মতে পুলিশ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ব্যপক রিম্যান্ডের মাধ্যমে আরো গভীরে যেতে পারে।

 

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়