মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
আলংকারিক সচেতনতার সাক্ষ্য দেয় গোমতীর বীণার তরাস
অপরূপ ধ্বনিহিল্লোল—আবেগস্পন্দিত প্রলয়শঙ্খ বাতাস
আজ একাদশী।
শুক্লপক্ষ।
বনবীথি মৃদু আলোকে উদ্ভাসিত। চন্দ্রালোকে আলোর সমপরিমাণ অন্ধকার। রহস্যও তাই অনেক বেশি। এক নারী-প্রতিহারী মনোমোহিনীর সঙ্গী হতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তাকে বারণ করে; ফলত মৃদু হাওয়ায় কম্পমান পত্ররাজি রাজকুমারী মনোমোহিনীকে আবাহন করে শিহরিত হচ্ছে।
আজ নৃত্যগীতের কোনও অনুষ্ঠান মহারাজ রাখেননি। উদ্যানের কেন্দ্রে একটি দীর্ঘিকা, তার এক প্রান্তে প্রস্তরনির্মিত রাজাসনে মহারাজ একাকী অর্ধশায়িত হয়ে হস্তধৃত পেয়ালা থেকে দ্রাক্ষারস পান করছেন। পত্রমর্মরের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, তার মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হলো, হাসিটি অতীব সুন্দর। তিনি তার কাছে ডাকলেন মনোমোহিনীকে: এসো, বোসো।
ত্রিপুরার মানুষ অদীর্ঘদেহী, মাঝারি শির, কিন্তু মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার ব্যতিক্রম। তার পেশিবহুল দেহ। আয়ত নয়নে স্নেহ। মনোমোহিনীর জন্য উদ্বেগ। মহারাজ নিজের সঙ্গে যেন যুদ্ধ করে চলেছেন। কে না জানে, অন্তরের যুদ্ধই সবচেয়ে জটিল ও ক্ষয়কর। মহারাজের জন্য দুঃখ হলো মনোমোহিনীর; মনে হলো, তার বিশাল মস্তক বক্ষে ধারণ করে বলতে: যত কষ্টই হোক, মহারাজের সুখের জন্য আমি সবকিছুই হাসিমুখে মেনে নিতে পারি; কিন্তু বলতে পারল না।
মহারাজের নির্দেশে মনোমোহিনীর জন্যও পানীয় এলো। দ্রাক্ষা নয়, তালের রস; গরম থেকে রক্ষা পেতে এটির কোনো বিকল্প নেই।
শরীর ভালো আছে তো? গ্রীবা আন্দোলিত করে প্রশ্ন করে মনোমোহিনী; তখন বেণিবদ্ধ কেশ সামনে এসে পড়ল, তাকে আবার স্বস্থানে প্রেরণ করল সে। মহারাজ তার কুশল সংবাদ জানার জন্যই কেবল ডেকে পাঠিয়েছেন তা নয়, তা মনোমোহিনী জানে, তাই প্রতীক্ষা করাই শিষ্টতা।
ইচ্ছে করে তোমার গান শুনি। হঠাৎ হঠাৎ আগে যেমন গান গেয়ে উঠতে, এখনও করো?
হেসে ফেলল মনোমোহিনী। পিতার কাছে এলে, তার সঙ্গে কথা বললে তিনি যেন রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে দেখা দেন; এই পিতাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে মনোমোহিনী।
মনোমোহিনীর হাস্যে হাসি বিনিময় করলেন মহারাজ। বললেন, কতদিন কারও সঙ্গে প্রাণ খুলে একটু কথাও বলতে পারি না। তুমি এলে, এত ভালো লাগে!
ডাকলেই পারেন!
পারি না, চারদিকে বিভিন্ন সমস্যা।
যেমন?
পূর্বে বর্মণ-বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিচ্ছে। রোজই গুপ্তচর এসে খবর দিচ্ছে, না-গেলেই নয়। কুকিপ্রদেশও অস্থির। জানোই তো, ত্রিপুরার অধিবাসীরা স্বভাবত শান্তিপ্রিয়। চাষবাস মেষপালন বাদ দিলে যেটুকু সময় পায় গান-বাজনায় কাটাতেই ভালোবাসে। এই শান্তিপ্রিয় জাতিটির শান্তিরক্ষার দায়িত্ব অনার্য শিব আমার কাঁধে অর্পণ করেছেন, এ কি কম কথা!
চুপ করে শুনছিল মনোমোহিনী, আসলে এগুলো সবই মহারাজের নিজের সঙ্গে কথা বলা; তাকে ডাকা, সামনে বসানো, সবই উপলক্ষ্য মাত্র; অথবা এই বাক্যবন্ধগুলো উপক্রমণিকা; যে-কথাগুলো শোনানোর উদ্দেশ্যে তাকে ডাকা হয়েছে, এমনভাবে শুরু না করলে সেখানে পৌঁছনোই যাবে না।
আপনি কি কোনও কিছু নিয়ে চিন্তিত? উদ্বিগ্ন?
মহারাজ দ্রাক্ষারস ওষ্ঠে উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু মনোমোহিনীর কথায় হাত কেঁপে উঠল, কয়েক বিন্দু ছলকে পোশাকে পড়ে গেল। মনোমহিনী আঁচল দিয়ে মুছে নিল।
আমাকে কী জন্য ডাকা হলো বললেন না তো!
উত্তর না দিয়ে দূরদিগন্তের পাহাড়ের মাথায়—সেখানে অন্ধকার বিরাজমান—দৃষ্টিস্থাপন করলেন মহারাজ। একখণ্ড মেঘ চন্দ্রশোভা রচনা করতে গিয়েও বারবার ব্যর্থমনোরথ হচ্ছে। আসলে মহারাজ পাহাড়, মেঘ অথবা চন্দ্রশোভা কিছুই দেখছেন না, বুঝতে পারল মনোমোহিনী, তিনি কিছু একটা বলতে চাইছেন; কিন্তু কতখানি বলা উচিত, কেমন করে বলা ঠিক হবে বুঝে উঠতে পারছেন না, তাই সন্ধান করছেন সঠিক শব্দের; যতক্ষণ-না তার সন্ধান সম্পূর্ণ হবে, নিরুত্তর থাকবেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য।
মণিপুরের রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধে কতটুকু জানো তুমি?
যা জানি তা আপনার মুখেই শুনেছি।
হ্যাঁ, মণিপুর রাজপ্রাসাদ!
একটু ভেবে মনোমোহিনী বলল, ত্রিপুরার অনেক রাজমহিষীই তো সেখান থেকে এসেছেন।
ঠিক, ত্রিপুরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত মণিপুর রাজ্য। খুবই শক্তিশালী তার রাজবংশ। এই মুহূর্তে মণিপুরকে যে-রাজবংশ শাসন করছে তার মধ্যে নিত্যানন্দের বংশ অগ্রগণ্য।
হঠাৎ মণিপুরের কথা তুললেন কেন? কিছু হয়েছে সেখানে?
হয়েছে নয়, হবে। মণিপুরের যুবরাজ এসেছে, অতিথিশালায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মনোমহিনীর গণ্ডদ্বয় আরক্ত হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকে। সে রজঃস্বলা হওয়ার পর থেকেই দূরদিগন্ত থেকে ভাটেরা আগমন করে। তাদের খাইয়ে-দাইয়ে আপ্যায়ন করিয়ে পিতা বিদায় করে দেন। পরে সাক্ষাৎ হলে বলেন, আমার মনোমোহিনী কি এতই ফেলনা? অবশ্যই নয়। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী—এই মেয়েকে কি আমি যার-তার হাতে তুলে দিতে পারি? না, পারি না।
মনোমহিনীর কেমন যেন সন্দেহ হয়, এতদিনে হয়তো তার পতির সন্ধান সম্পূর্ণ হয়েছে।
মহারাজ দূরে তার দৃষ্টি প্রসারিত করলেন, তারপর বললেন: মণিপুর বর্তমানে শাসিত হচ্ছে যে-রাজার দ্বারা তিনি যোদ্ধা হিসেবে, নৃপতি হিসেবে, মানুষ হিসেবে অতুলনীয়। তার স্বহস্তলিখিত একটি পত্র নিয়ে তার পুত্র নিত্যানন্দ এসেছে। সে তোমাকে প্রার্থনা করছে।
আমাকে? যুবরাজের জন্য?
আজ্ঞে, শুধু প্রার্থনা বললে ভুল হবে। একেবারে শিবিকাসমেত পুত্রকে পাঠিয়েছেন মণিপুরের মহারাজ। বিবাহের দিন-ক্ষণও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের নিমন্ত্রণও করা হয়েছে বিবাহ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য।
কিন্তু এ তো এক ধরনের পরাক্রম প্রদর্শন। ত্রিপুরার ইচ্ছে-অনিচ্ছা, কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেননি তিনি, যেন মণিপুরের মহারাজ দাসানুদাসকে আদেশ করেছেন বিবাহযোগ্য কন্যাটিকে তার সেবাদাসী হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। ‘না’ বলে দিলেই তো হয়।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারাজ। তারপর ধীরস্বরে উচ্চারণ করলেন: ইচ্ছে থাকলেই কি সবকিছু করা যায় মা? না, যায় না। পত্রখানি পাঠ করে, যদিও খুব মার্জিত ভাষায় ও ভঙ্গিতে চিঠিটি লেখা হয়েছে, আমারও অন্তরাত্মা বলে উঠেছিল, এ কী কথা! আমার কন্যার কার সঙ্গে বিবাহ হবে তা কি মণিপুরের রাজসভা নির্ধারণ করতে পারে? পরে মন্ত্রী-অমাত্য সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত পালটাতে বাধ্য হই।
কেন পিতা?
একটু আগেই বললাম না, সীমান্তে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে। ত্রিপুরার মানুষ স্বভাবত শান্তিপ্রিয়। যুদ্ধবিগ্রহ তাদের অপছন্দ। সংগীত, কলা ইত্যাদি সুকুমারবৃত্তিতেই তারা নিরত। যুদ্ধ যদি চাপিয়ে দেওয়া হয়, এতদিনের অনভ্যাস, যুদ্ধে জয় হওয়ার সম্ভাবনা খুব মহৎ বলা যায় না। মণিপুরের বর্তমান মহারাজ জগৎজয়ী যোদ্ধা। তার যুদ্ধকৃতী দূরদূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। ত্রিপুরা আক্রান্ত হলে তার আসার প্রয়োজন হবে না। তিনি আমাদের সহায় আছেন, এই সংবাদটুকু পেলেই বিপক্ষ সেনাদল রণে ভঙ্গ দেবে।
তার মানে দেশের মানুষকে যুদ্ধবিহীন নিশ্চিন্ত প্রশান্তি দিতে আপনার আদরের কন্যাকে মণিপুরে পাঠাতেই হবে?
মা, দুঃখ পেয়ো না। মহারাজকে কেবল তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বা পরিবার-পরিজনের ভালো-মন্দের কথা ভাবলে চলে না। মহারাজের পরিবার তার সমস্ত রাজ্যে প্রসারিত। প্রতিটি প্রজার ভালো-মন্দের তিনি রক্ষক। কষ্ট হলেও বলতে হচ্ছে, মণিপুরের মহারাজের অনুরোধ এক্ষেত্রে আদেশ। তা অমান্য করার সাধ্য আমার নেই।
কবে যেতে হবে? চোখের জল মুছে মনোমোহিনী জিজ্ঞেস করল।
পূর্ণিমার উষাকালে, রাজাচার্য দিন-ক্ষণ দেখে দিয়েছেন, তখনই যাত্রা শুভ।
আপনাদের সকলকে, এই ত্রিপুরার সমস্ত কিছু ত্যাগ করে সেই দিনই আমাকে চলে যেতে হবে পিতা? আর কখনও ফিরে আসব না?
এবারে মহারাজ আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। মনোমোহিনীর মস্তক নিজের বক্ষে ধারণ করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেঁদো না মা। আজ না হোক কাল, যেতে তো হবে তোমাকে, কন্যা হয়ে জন্মেছ যে তুমি! তবে এখানে যেমন ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ তোমার স্পর্শে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে ধন্য ধন্য করছে, সেখানেও যেন তা-ই হয়। তোমার জ্ঞানে, মনীষায়, মেধায়, কলানৈপুণ্যে মণিপুরের রাজগৃহ পূর্ণ হয়ে উঠুক, এ-ই আমার প্রার্থনা।
পিতার কথাগুলোর অর্থ ভালো করে বুঝতে পারল না মনোমোহিনী। তথাপি অন্ধকার পথে পদক্ষেপ খুঁজতে খুঁজতে মনে হলো মহারাজ কীসের জন্য তাকে পরিত্যাগ করছেন?
অশ্রুজলে গড়ায় ক্ষুধাবিশীর্ণ তীর্থমহল
নীড় ছেড়ে পালিয়ে যায় স্বপ্নের শঙ্খচিল
সূর্যদগ্ধ পোড়া মাটি হয়ে যায় ম্লান-অচঞ্চল
আজ চতুর্দশী। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে ক্ষণকাল চিন্তা করে ডেকে পাঠালেন তার তিন কন্যা কৃষ্ণাভামিনী, সুহাসিনী ও মনোমোহিনীকে। সঙ্গে অবশ্য জামাতাদ্বয় শশিভূষণ ও উদীয়মান। তার রাজ্যকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিন কন্যাকে অর্পণ করতে চান তিনি, যেন ভবিষ্যতে কোনও ঝগড়াঝাঁটির উদ্ভব না হয়। বৃদ্ধ বয়সে মহারাজের একমাত্র কাম্য শান্তি আর বিশ্রাম। মনোমোহিনীর যদিও এখনও বিয়ে হয়নি, তবে তার স্বামিত্বের দাবিদার মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দ, তাকেও মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য ডেকে পাঠালেন, সেও এসে উপস্থিত হলো। রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজকার্যের দায়ভার অর্পণ করার আগে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার কন্যাদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখলেন, তোমরা আমাকে কতটা ভালোবাসো?
পিতার কথায় কৃষ্ণাভামিনীর যৌবন প্রাপ্ত মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। শরীরের যুবতি সৌন্দর্য-লাবণ্য। সে তার পিতার ডান হাতটি তুলে নিয়ে চুমু কেটে ঝটপট বলল: পিতা, আমার ভালোবাসা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কোনও কিছু দিয়েই এই ভালোবাসার পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না। সুখীসার্থক জীবনের অংশীদার যেমন আমার পতি, তার চেয়ে কম নয় আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা, বরং তা সকল সীমাপরিসীমার ঊর্ধ্বে।
কৃষ্ণাভামিনীর কথা শুনে কেউ তার ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তোমার উত্তরে আমি খুবই সন্তুষ্ট। তাই তোমাকে ও শশিভূষণকে আমি আমার রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল প্রদান করলাম। এখন সুহাসিনীর পালা।
পিতার কথায় সুহাসিনীর মুখও আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আগ্নেয়গিরির লাভার মতো নানা স্বপ্ন মাথাকে পেঁচিয়ে ধরল। স্বপ্নের কত-যে ধরন! বেশির ভাগ সময়ই মগজে বিষসুচ ফুটিয়ে দেয়। বাস্তবতার সঙ্গে মিলল কি না তা নিয়ে চিন্তা নেই, বরং হৃদয়ে অলীক কাহিনি সৃষ্টি করে। রক্তে সর্প-জিভ লকলক করে, হৃৎপিণ্ডে হিংস্রতা ফেনিয়ে ও ঠোঁটে বিষ জমে ওঠে। কথার ছোবলে সেই বিষ ঢেলে দিতে চায়। সুহাসিনী বলল: আমিও দিদির মতো এক ধাতুতেই তৈরি। তাই সে আমার মনের গোপন কথাগুলো আগেই প্রকাশ করে ফেলেছে। তবে দিদির কথার সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই, আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা তা অমূল্য। সমস্ত ত্রিপুরার বিনিময়েও এই ভালোবাসার মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার দ্বিতীয় কন্যার কথায়ও খুশি হন। তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জানালেন, তুমি ও উদীয়মানকে তোমার দিদির মতোই ত্রিপুরার সুন্দর অংশ রাঙামাটি প্রদান করলাম। তারপর একবার তার কনিষ্ঠ কন্যা ও মণিপুরের রাজপুত্র নিত্যানন্দকে দেখে নিয়ে যোগ করলেন, আমার কনিষ্ঠ কন্যা কী বলে দেখা যাক! সে আবার যুবরাজ নিত্যানন্দের সঙ্গে দিনকয়েক পর মণিপুরে চলে যাচ্ছে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, মনোমোহিনী তা জানে। মহারাজের একাধিক মহিষী থাকলেও তার মাত্র তিন কন্যা; এই তিন কন্যার মধ্যে মনোমোহিনীর প্রতি মনোযোগ সর্বাধিক, মনোমোহিনী এই ব্যাপারে সম্যক অবহিত। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের তিন কন্যার মধ্যে কেবল তাকেই স্নেহভরে দ্রুহ্য-আত্মজা, দ্রুহ্য-নন্দিনী ইত্যাদি নামে ডাকেন। তাই পিতার প্রশ্নের উত্তর মনোমোহিনী কীভাবে দেবে! গভীর চিন্তায় সে তলিয়ে যেতে থাকে। শূন্য হয়ে আসে যেন সবকিছু। গভীর অস্বস্তি নিয়ে অবশেষে সে বলল, আমার কিছুই বলার নেই পিতা।
অনিন্দ্যসুন্দর মনোমোহিনীকে পাবে কি পাবে না, তা এখনও অবগত নয় যুবরাজ নিত্যানন্দ; তাই নিত্যানন্দের অন্তরে গভীর হাহাকার চলছে। অন্যদিকে, মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের অন্তরে তার কনিষ্ঠ কন্যার কথায় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তিনি বললেন: তোমার কিছুই বলার নেই?
মনোমোহিনী তার পিতার প্রশ্নের উদ্দেশ্য আঁচ করতে অক্ষম। একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। সে জানে দিনকয়েক পরই তাকে ত্রিপুরা থেকে চলে যেতে হবে। তাহলে এখন কেন এমন প্রশ্ন? পিতার এমন প্রশ্নের উত্তাপ তার কাছে দুর্বিষহ মনে হল। ক্রোধ এবং ঘৃণা উভয়ই মিশ্রিত। যদিও জানে পিতার কাছে সে অপরিসীম ঋণী। কী করে তা উড়িয়ে দেবে? তবুও অভিমানে সে বলল: না, পিতা। যাকে পরিত্যাগ করা হয়, তার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়।
মনোমোহিনীর কণ্ঠে গম্ভীরতা, দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা অতিপ্রকট। মুখ ফিরিয়ে নেন মহারাজ। একটি দীর্ঘ সাপের মতো বেদনা তার বুক চিরে খুব দ্রুতবেগে এগিয়ে চলছে যেন। তিনি একবার রাজসভাসদের দিকে তাকালেন। মহারাজের চিন্তার কুণ্ডলী-ঘেরা মুখটি ও কপালের ওপর চেপে বসা ধূসর আস্তরটি দেখে রাজসভাসদ কেঁপে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তারা ঘাড় ফিরিয়ে মনোমোহিনীর দিকে তাকালেন। অপরাধীর মতো মনোমোহিনী মাথা নিচু করে আছে। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যও তার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তার দৃষ্টি যেন মনোমোহিনীর সত্তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি জানেন মনোমোহিনীর অভিব্যক্তি কখনও পরিবর্তিত হয় না। তবুও বললেন: ভেবে বলো। কিছু বলার না-থাকলে তোমার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না।
মনোমোহিনী স্থির দণ্ডায়মান। মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দকে একবার দেখে নেয়। মনে হয়, নবোদিত সূর্য প্রভাতের কিরণসম্পাতের ভেতর দিয়ে নেমে এসেছে এই রাজসভায়। তার উপস্থিতি, যৌবনের সকল সৌন্দর্য বুঝি-বা ঘনীভূত হয়ে তার সস্মিত আননের চারপাশে জ্যোতির্বলয় রচনা করে চলেছে। তার অঙ্গভঙ্গি ত্বরিত নয়, মন্থরও নয়; আবার জীবনের লক্ষ্যের প্রতি মৃদুতম ঔদাস্যও প্রতীত হয় না। অঙ্গের তরঙ্গায়িত রাজবস্ত্র সমুজ্জ্বল, নয়নদ্বয় মহাকরুণায় ঢলোঢলো; যেন স্নেহলাবণ্যে পরিপূর্ণ। শিরোদেশে কুন্তলগুচ্ছ, অধরে মৃদুমঞ্জুল হাস্যরেখা যেন অন্তরের অন্তস্তলে লুক্কায়িত, ঈষৎ ত্রিভুজাকৃতির চিবুক, উন্নত ভুরুযুগল, দক্ষিণ করে ধৃত তরবারি, রাজাদেশের জন্য যেন নিঃশব্দে অপেক্ষারত। মনোমোহিনীকে শিহরিত করল। তারপর দৃষ্টি স্থাপন করল তার পিতার ওপর। নিজেকে আরও অবাঞ্ছিত মনে হলো তার। যদিও সে জানে প্রতিবাদ করা বৃথা তবুও চোখ নামিয়ে নরম ও বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল: আমি অবশ্য আপনাকে ভালোবাসি, তবে স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে নয়। আপনি আমাকে লালনপালন করেছেন, ভালোবেসেছেন, আমিও আমার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি। আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু আমার দিদিদের ভালোবাসার যদি পুরোটাই আপনি পান, তাহলে তাদের পতিদের ভাগ্যে কী জুটবে? ভালোবাসা ও যত্নের অর্ধেকটা তো তাদেরও প্রাপ্য। তাই তারা কাণ্ডজ্ঞানহীন, বিবেচনাহীন, লাজলজ্জাহীন উত্তাল অভিমত প্রকাশ করেছেন। কেননা, তাদের ভালোবাসার পুরোটা আপনাকে দিতে পারেন না তারা।
চাপা তীব্র তীক্ষ্ণ এই কথা যেন তির হয়ে ছুটে যেতে চাইছে উদ্ধত যৌবনের স্বাক্ষরে দুটি কলঙ্কিত বুককে লক্ষ্য করে, তবু স্থির হয়েই থাকে দুটি বুক। কোন্ অভিযোগে জর্জরিত করছে মনোমোহিনী তার ভগিনীদেরকে, কোন্ ধিক্কারে ধিক্কৃত?
মনোমোহিনীর কথাগুলো কি বিশ্বাস করেন না মহারাজ? না, করতে চান না, তাই তিনি চারপাশ দেখতে লাগলেন। ধারণা ছিল তার সহ্যক্ষমতা লোকগাথা-সমপর্যায়ের। তবুও মনোমোহিনীর এই কথাগুলো শুনে অবাক না হয়ে পারলেন না তিনি। তিনি বিস্মিত। অতঃপর উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলেন, তুমি তোমার প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলে। ত্রিপুরা রাজ্যকে আমি দুই ভাগে পার্বত্য ও সমতলে বিভক্ত করে একাংশ আমার প্রথম কন্যাকে আর অন্যাংশ আমার দ্বিতীয় কন্যাকে প্রদান করলাম। আমি আরও ঘোষণা করছি, এক মাস করে আমার দুই কন্যা ও জামাতার কাছে থাকব। অবশ্য আমার সঙ্গে অনুগামী বীরদের খরচ বহন করতে হবে তাদের। সেইসঙ্গে আমার ‘মহারাজ’ উপাধিটিও বজায় থাকবে।
রাজকবি রাধারমণ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন। মনোমোহিনী তার কন্যার মতো। বললেন: মহারাজ, আপনার কনিষ্ঠ কন্যা আপনাকে কোনও ভাবেই অল্প ভালোবাসেন না। তার কণ্ঠস্বর তারই মনের গভীরতাকে প্রকাশ করেছে মাত্র।
রাজকবি রাধারমণের কথার কাছে হারতে চান না—এই বিশ্বাসই বদ্ধমূল মহারাজের কাছে। তিনি উত্তেজিত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, বললেন: রাজকবি, ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে রাখলেও আপনার অন্তরের বাসনা দেখছি প্রবলতর।
রাজকবি রাধারমণ আমতা-আমতা করে বললেন: তবুও অনুরোধ মহারাজ, অকারণে আপনার অসহায় কন্যাকে ত্রিপুরার বক্ষ থেকে বিচ্যুত করবেন না। আর যদি করেন, তাহলে কি আপনার কন্যাশোক হবে না? আপনার এমন নির্দেশে আমাকেও দগ্ধাতে হবে সারা জীবন!
রাধারমণের ওপর মহারাজ জ্বলন্ত দৃষ্টিক্ষেপ করতে লাগলেন। তারপর বললেন: আপনি আন্তরিক জিজ্ঞাসু, তাই আপনাকে বলছি, এই সুখ-দুঃখ-পূর্ণ জগৎটাই আমাদের সামনে আছে। আর এই সুখ-দুঃখ-পূর্ণ জগতের বাইরে যা-কিছু আছে বা থেকে থাকে, সেকথা আমরা জানতে পারি না। আমরা কোনও এক বিষয় বা বস্তুকে এক প্রকারে জানি না, অন্য প্রকারে জানি না। আমরা যে জানি না, তাও জানি না। কিংবা তাও নয়। তাই অনুরোধ করছি, আপনার মুখ বন্ধ রাখুন। অতঃপর মহারাজ মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দের ওপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন: আমি তোমাকে বলব না যে, আমার কন্যাকে তুমি গ্রহণ করো, বরং অন্য কোনো যোগ্য পাত্রীর সন্ধান করাই উচিত।
মনোমোহিনী জানে, তার ব্যবহারে মহারাজ আহত হয়েছেন। রাজমহিষীরা গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকেন। মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে বুদ্ধি ও পরামর্শে যথার্থ সঙ্গ দেওয়ার সামর্থ্যও তাঁদের নেই। মনোমোহিনী একাধারে সখা এবং কন্যা। সে কি অজ্ঞাতে কোনও অপরাধ করে ফেলেছে? মনোমোহিনী এও জানে, তার বিবাহ-বিষয়ে মহারাজ আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার ইচ্ছে যুবরাজ নিত্যানন্দের গলায় তাকে বরমাল্য অর্পণ করা; কিন্তু এখন পিতার মুখে এ কেমন কথা!
যুবরাজ নিত্যানন্দ বলল: আশ্চর্যের ব্যাপার এই-যে, মহারাজ, যে আপনার স্নেহের পাত্রী ছিল, আপনার অবসর সময়ের যে ভরসা, এই সামান্য কারণে সে এখন আপনার ঘৃণার পাত্রী হয়ে গেল!
যুবরাজ নিত্যানন্দের সহানুভূতি মনোমোহিনীর হৃদয়কে নাড়া দিলো। সে মহারাজের উদ্দেশ্যে বলল: আমি বাক্পটু নই, মুখে এক আর মনে অন্য করতে পারি না। কিন্তু আমার কথায় অন্যায় কিছুই নেই। অপবিত্র অসম্মানের কোনও ইঙ্গিতও ছিল না। তবুও আমি মহারাজ, আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলাম। তবে আমার মনের আশঙ্কা এই-যে, রাজপ্রাসাদের চারপাশে ষড়যন্ত্রকারীদের জাল পেঁচিয়ে রয়েছে। যেদিন আমি প্রকাশ্যে তাদের সর্পমাথা কাটতে পারব সেদিন আবার মহারাজের ভালোবাসা লাভ করব বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য কিছুই বললেন না।
এগিয়ে এসে মনোমোহিনীর হাতে হাত রাখলেন রাধারমণ। তারপর বললেন: মানুষ অদৃষ্টের ওপর কত দিন নির্ভর করে পড়ে থাকতে পারে? মাঝেমধ্যে ভাবি, এমন কি কোনও পন্থা নেই, যা মানুষ সজ্ঞানে অনুসরণ করে দুঃখকে অতিক্রম করতে পারে?
যুবরাজ নিত্যানন্দ বলল: যে সঠিক ও সত্য বলে, ঈশ্বর তারই সহায় থাকেন।
রাধারমণের উদ্দেশ্যে মনোমোহিনী বলল: ভেবেছিলাম, আমার মনোবেদনা যদি মহারাজের কাছে জ্ঞাপন করি, নিশ্চয়ই তিনি এই বিষয়ে যা জানেন তা আমাকে বলবেন; কিন্তু আমি মহারাজের সমবেদনা লাভ করতে পারিনি। তবে আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, অন্ততপক্ষে আপনার ও মণিপুরের যুবরাজের সমবেদনা আমি লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। এরই সঙ্গে দৃঢ় স্বরে বলতে চাই, যার ভালোবাসার প্রকাশ হয় শুধু সম্পদের প্রতি লোভের কারণে, সেই রকম কন্যা হতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
বলিষ্ঠ ভঙ্গিমায় ও বীরদর্পে যুবরাজ নিত্যানন্দ বলল: বঞ্চিত হয়েও তুমি হৃদয়-সম্পদে ধনী, ঘৃণিতা হয়েও তুমি ভালোবাসার পাত্রী। আমি তোমাকেই তোমার চারিত্রিক গুণাবলির কারণে গ্রহণ করতে চাই। তুমি আমারই হবে। ত্রিপুরা রাজ্যের সমস্ত সম্পদের বিনিময়েও আমি তোমাকে হাতছাড়া করতে প্রস্তুত নই।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য একটা পরিতৃপ্তির হাস্য হেসে বললেন, তোমার কাছ থেকে এইরূপ উত্তরই আশা করেছিলাম। তোমার মনোহর আকার, বলিষ্ঠ ও তেজোব্যঞ্জক মূর্তি ক্ষত্রিয়শক্তিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তোমার হস্তদ্বয় রাজদণ্ড ধারণের জন্যই উপযুক্ত।
যুবরাজ নিত্যানন্দ বলল: মহারাজ, যেমন স্রোতের মধ্যে পতিত তৃণখণ্ড নিজেকে একবিন্দুও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না, স্রোতই তাকে সম্মুখে বহন করে নিয়ে যায়; স্রোতই ঠিক করে দেয়, সে কোন্ পথে যাবে; আমরাও এই স্রোতের মধ্যে পতিত তৃণখণ্ডের মতো। তাই আমি আপনার কন্যাকে লাভের বাসনা পোষণ ও তার পাণিপ্রার্থনা করছি, মহারাজ।
মনোমোহিনীর প্রীতিস্নিগ্ধ মুখশ্রী অবলোকন করে মহারাজের বুঝতে বিলম্ব হল না, সে এই প্রস্তাবে নারাজ নয়। তাই তিনি বললেন: নিয়তিতাড়িত জীব এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে, এইভাবে অগণ্য জন্মের পর মুক্তি লাভ করে। তাতে জীবের কোনও হাত নেই। নিয়তি যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই যেতে হয়। তাই তোমার প্রতি আমার নির্দেশ: তুমি যদি একান্তই আমার কন্যার পাণিপ্রার্থনা করো, তাহলে তাকে নিয়ে তুমি অবিলম্বে মণিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করো। সেখানেই তোমাদের বিবাহানুষ্ঠান কোরো।
মহারাজের আদেশ আমার শিরোধার্য।
প্রসন্নমনে যুবরাজ নিত্যানন্দ রাজসভা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো; আর মহারাজ পরম স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলেন, কেননা এমনভাবে রাজনিয়ম ভঙ্গ করে অন্য রাজ্যে কন্যাদানের বিষয়ের সমস্যা সমাধান হবে তা মহারাজ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। তাই তিনি, মনে-মনে, হাতে চাঁদ পেয়ে হেসে কেঁদে আকুল হলেন। অবশ্য তিনি চিন্তিত ছিলেন কীভাবে রাজনিয়ম ভঙ্গ করে কন্যাদানের কাজটি মণিপুরে হবে; কারণ, এমনটি হলে তিনি প্রজাকুলের কাছে যেমন হীন-নিন্দিত হবেন, তেমনই চিরদিনের জন্য তার শির নত হয়েই থাকবে। প্রকৃতপক্ষে তার এই নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে অবশ্য তিনি এক ঢিলে দুটি পাখি বধ করলেন; একদিকে, রাজসভাসদের সামনে মহারাজের প্রতি মনোমোহিনীর ভালোবাসা কিঞ্চিৎ বলে প্রমাণিত এবং ত্রিপুরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মণিপুরে তার বিবাহানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন, আর অন্যদিকে, মনোমোহিনীর প্রতি যুবরাজ নিত্যানন্দের কতটুকু ভালোবাসা রয়েছে সে-সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হলেন। মহারাজের অভিপ্রায় বুঝতে পেরেই রাধারমণের কণ্ঠ দিয়ে প্রকাশ পেল: জয় মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সর্বজয়।
কবিত্ব বিশ্বকৃৎপ্রদত্ত বিশালাক্ষ
কবিতাই কাব্য, কবিতাই কবি
কদম আর বকুল ফুলের ঝামেলা
উষাকালে যাত্রারম্ভে সকলকে প্রণাম ও যথাযথ সম্ভাষণ বিনিময় করে একটি শিবিকায় আরোহণ করল মনোমোহিনী, সঙ্গে তার একান্ত সহচরী। অন্য একটি শিবিকায় আরোহণ করল যুবরাজ নিত্যানন্দ। মহারাজ অশ্ব চেপে রাজপ্রাসাদের বাইরে পদার্পণ করেছেন। মনোমোহিনীর বিদায়দৃশ্য তার পক্ষে অসহনীয় তা মনোমোহিনী জানে।
কন্যার সঙ্গে নাট্যাভিনয় করলেও কন্যাদানের ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য করেননি মহারাজ। মণিপুর থেকে দুটি শিবিকা মাত্র এসেছিল। তাকে রত্নালংকারে ভূষিত করে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে আরও কয়েকটি শিবিকায় যাচ্ছে মনোমোহিনীর নিজস্ব কয়েকজন নারী-প্রতিহারী। তাছাড়া রয়েছে মণিমাণিক্য, উপহার, উপঢৌকন ইত্যাদি; শ্বশুরালয়ে মনোমোহিনীর কোনও ভাবেই যেন অমর্যাদা না হয়। মণিপুরের যুবরাজ নিত্যানন্দ এবং চারজন সান্ত্রী এতকিছু রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়—একথা বিবেচনা করেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য শত সৈন্য তাদের সঙ্গে মণিপুর যাত্রা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
দেখতে দেখতে শিবিকাসমূহ ত্রিপুরার দিক্চক্রবালরেখার নিকট বিন্দুবৎ মিলে গেল।
দীর্ঘ পথ, কিন্তু মনোমোহিনীর আশা ছিল ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ থেকে মণিপুরের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত, যুগে যুগে দুই রাজ্যের আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসা এই পথের সৌন্দর্য অবলোকন করে পথশ্রম কিছুটা লাঘব করবে। বিচিত্র পথ, অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আশ্চর্য সব মানুষ দেখতে দেখতে সময় কীভাবে কেটে যাবে বুঝতেই পারবে না। আর তাই শিবিকার অয়ন গমনাগমন পথ সামান্য উন্মোচন করে বাইরের দৃশ্য দেখছিল মনোমোহিনী। হঠাৎই, মণিপুরের অশ্বারোহী এক সৈনিক হাতজোড় করে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ভদ্রে! একটি নিবেদন আছে।
মুখমণ্ডল আবৃত করে মনোমোহিনী বলল, বলুন।
মণিপুরের রাজবধূরা সর্বসমক্ষে তাদের দৃশ্যমান করেন না। আমার অনুরোধ—আপনি শিবিকার গবাক্ষ বন্ধ রাখবেন।
আমি তো এখনও মণিপুরের যুবরানি হইনি। এই মুহূর্তে আমার পরিচয় দ্রুহ্য-নন্দিনী, ত্রিপুরা-নন্দিনী। আমার ওপর আপনার এই আদেশ খাটে না।
মাননীয়াসু, আপনার কথা অংশত সত্য। আপনি মণিপুরের যুবরাজের বাগ্দত্তা। কিছুটা হলেও সেই পরিবারের নিয়মকানুন আপনার ওপর এখন থেকেই বর্তায়। তাছাড়া মনে রাখতে হবে যে, এই পথ দস্যু-আকীর্ণ, আপনার নিরাপত্তার কারণে শিবিকার গবাক্ষ বদ্ধ রাখাই বিধেয়।
সেই থেকে মনোমোহিনীর একান্ত সহচরী শিবিকার অভ্যন্তরের সংকীর্ণ অন্ধকারে—পাশ ফিরতে গেলেও স্থান সংকুলান হয় না—পদযুগল প্রসারিত করতে সাহস পেল না।
যখন এক প্রশস্ত ক্ষেত্রে রাত্রি অতিবাহিত করার জন্য শিবিকাসমূহ এসে থামল, নির্মাণ করা হল সেনাশিবির। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সেনাশিবিরের বাইরে পা রাখল মনোমোহিনী। ঊর্ধ্বে তাকাতেই নক্ষত্রখচিত আকাশ, দূরে বৃক্ষরাজির আভাস, জনপদে কয়েকটি আলো দেখতে পায়। রাত্রির যে-দৃশ্য সে ফেলে এসেছে তার সঙ্গে এটির কোনও অমিল নেই। মনোমোহিনীর মনে হল, রাত্রি মানুষে মানুষে, স্থান স্থানান্তরে, দৃশ্য দৃশ্যান্তরে যে-প্রভেদ তা বিলুপ্ত করে দেয়। একমাত্র আলোকিত সূর্যই মানুষ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য প্রকাশ করে। মানুষের জীবনে আলোর উপস্থিতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ! আকাশের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে মনোমোহিনী, কিন্তু মেঘহীন আকাশে এর কোনও উত্তর পায় না—শুধু একটা স্তম্ভিত জিজ্ঞাসা নক্ষত্রখচিত আকাশে ঝুলে থাকে।
নক্ষত্রখচিত নৈশাকাশের দিকে অনন্যমনে তাকিয়ে থাকে মনোমোহিনী, মনে হয়, নির্জন নক্ষত্রবীথি সুদূর থেকে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে! সে কোন্ অজ্ঞাত রহস্যময় জগতের সংবেদনা, আকাশগঙ্গার সুদূর তীরে কোনও এক অজানা পৃথিবীর সংবাদ যেন এইমাত্র তার কাছে এসে পৌঁছে। ভাবে: দূরে, এই পৃথিবীর মতো কি আর-একটা পৃথিবী আছে? হয়তো সেখানে গ্রাম আছে, নদী আছে, রাজসভা আছে। সেই পৃথিবীর নর-নারী: যুবক, প্রৌঢ়, বালক, বালিকা হয়তো প্রতিদিন জীবনস্রোতের প্রবাহপথে শ্যাওলার মতো ভেসে চলেছে… সেই ধাবমান জনপ্রবাহের মধ্যে হয়তো তারই সদৃশ কোনও রাজকুমারী আছে, কিন্তু সে হয়তো বিবাহের জন্য সুদূর কোনও এক ক্ষুদ্র রাজ্যে যাচ্ছে না। হয়তো তার কন্যাদান সম্পন্ন হচ্ছে তার দেশেই। তাই তাকে স্বজন-স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোনও অজানিত পথে যাত্রা করতে হচ্ছে না। রাত্রির নক্ষত্রখচিত আকাশ যেন তার কানে কানে অস্ফুট স্বরে এসবই বলে চলে।
ঠিক তখনই যুবরাজ নিত্যানন্দ তার সেনাশিবির থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় মনোমোহিনীর পাশে, নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে। বৃষস্কন্ধ দীর্ঘবাহু মানুষটি অমিত শক্তির অধিকারী। তার গাত্রবর্ণ গোধূমের মতো, নাসিকাগ্র তীক্ষ্ণ, ওষ্ঠদ্বয় পরিপূর্ণ। তার চক্ষু দুটিতে গোমতী নদীর প্রশান্তি। দৃষ্টিতে কাম, স্নেহ, কৌতুক, আপ্যায়ন।
একটু অবাক হল মনোমোহিনী! অবোধ হরিণীর মতো তার দুটি চক্ষু ফিরিয়ে নিত্যানন্দের মুখের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে সরল বিশ্বাস ছায়া ফেলছে।
এত রাত্রে কে বাঁশি বাজাচ্ছে? জিজ্ঞেস করল মনোমোহিনী।
নিত্যানন্দ বলল, জানি না রাজকুমারী।
তার বাঁশি এত রাত্রে কে শোনে? মনোমোহিনীর কণ্ঠ বিস্ময়ভরা।
নিজের জন্যই হয়তো-বা বাজাচ্ছে, অথবা সে জানে, কেউ-না-কেউ জেগে আছে শুধু তার বাঁশি শোনার জন্য।
সত্যি যুবরাজ? বিশ্বাস হয় না মনোমোহিনীর।
তাও জানি না, রাজকুমারী।
তাহলে বললেন যে?
মনে এলো। হয়তো কল্পনা করে বললাম।
কত কিছু কল্পনা করে মানুষ!
শুধু প্রকৃতিই রহস্য জমিয়ে তোলে।
মানে? জিজ্ঞেস করে মনোমোহিনী।
রাজকুমারী, সেদিন ত্রিপুরার জলসাঘরে গান-বাজনা করছিল যারা, তাদের সম্পর্কে কি কোনও আগ্রহ জন্মেছিল অন্তরে?
না!
অথচ এই অজানা অচেনা এক বাঁশিওয়ালা এখন মনে ঠাঁই নিয়েছে।
সত্যিই, মানুষ বড় বিচিত্র। আমি বুঝতে পেরেছি, প্রকৃতির রহস্যের দার্শনিক যুবরাজের ইঙ্গিতটা।
আমি দার্শনিক নই। সামান্য এক কবিমাত্র।
এখন তাহলে একটি কবিতা শোনা যাক।
আমার কবিতা তো আমজনতার মুখের ভাষায় গড়ে ওঠা, রাজকুমারী। এসবকে কবিতা বলাও মনে হয় ঠিক হবে না। বেশিরভাগই আমার নয়। গ্রামগঞ্জের চারণকবিদের মুখে-মুখে রচিত। যে দু-চারটি ভালো লাগে শিখে নিই। মাঝেমধ্যে গুনগুন করে নিজেকে শোনাই।
ওসবেরই দু-একটাই শোনা যাক। এই নিরিবিলি পরিবেশ এসব শোনার জন্যই উপযুক্ত।হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের মনে কী আছে জানতে চাইলে এসব শোনা উচিত।
এত ক্ষুদ্র করে দেখার কোনও কারণ নেই, যুবরাজ। কাব্যপ্রতিভা কজনের আছে, বলুন?
অপরাধ নিয়ো না রাজকুমারী। কবিতাকে ছোট করার জন্য বলিনি। নিশ্চয় এসব মহৎ কবিতা। এসব হয়তো ইতিহাসে লেখা থাকবে।
আমি চাই আপনার কবিতা ইতিহাসে লেখা থাকুক।
আমজনতার কথা: কবিতা কখনও ইতিহাস হয়ে ওঠে না, ওসব লোকমুখেই থেকে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবার নতুন নতুন গাথা রচিত হয়।
যাই হোক, এখন কিছু শোনান, যুবরাজ।
শোনাই তাহলে, দুটি চরণ: যমুনার জল সই দেখতে কালো, সই গোমতীকূলের নারীরা দেখতে ভালো।
বাহ্। চমৎকার।এসব কবিতার একটাই রূপ নয়, রাজকুমারী। ভিন্ন অঞ্চলে এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে।
যেমন?
ওই যমুনার জল আমার দেখতে কালো সখি, তোর রূপ দেখে আমার লাগল ভালো সখি।
মাটিলগ্ন কবিতা এগুলো।
এসব মাটিতে বসে, একতারা কিংবা দোতারা বাজিয়ে নেচে নেচে পরিবেশন করা হয়।
আগামী পূর্ণিমায় এসব কবিতার একটি উৎসব করা যায় না? করতাল, মন্দিরা বাজিয়ে ভাবের সঙ্গে এসব প্রকাশ করা যায় না?
ভালো বলেছ। তা-ই হবে। তুমি চাইলে আমি তা-ই করব।
রাত্রের খাবারের পর মনোমোহিনী ও নিত্যানন্দ তাদের নিজ নিজ শিবিকায় চলে গেল। পৃথকভাবেই তারা রাত্রি যাপন করল।
অন্ধকার, স্বপ্ন নয়
দেহের প্রশান্তি, হৃদয়ের ভালোবাসা।
প্রভাত।
আবার যাত্রা শুরু হলো।
মণিপুর রাজপ্রাসাদে প্রবেশের অব্যবহিত পূর্বে সৈনিক আর-একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল মনোমোহিনীর ইতিকর্তব্য।
অবশেষে যাত্রা শেষ হলো।
একজন সৈনিক এসে মৃদুকণ্ঠে বলল: ভদ্রে, আমরা রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছি। এখানেই আমাদের যাত্রা শেষ। অন্তঃপুরে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। এই স্থল থেকে অন্তঃপুরিকারা আপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
চিকের আড়ালে ঘিরে ফেলা হল শিবিকা। সন্তর্পণে শিবিকা থেকে অবতরণ করল মনোমোহিনী। অন্তঃপুরবাসী যে সঙ্গিনীরা এসেছিল তারাই সযত্নে মনোমোহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। এখানে কোনও অবগুণ্ঠন নেই। অতএব, সবই দেখতে পাচ্ছে মনোমোহিনী। বিশাল প্রাসাদ। অন্ধকার অলিন্দ। একের-পর-এক দ্বার অতিক্রম করে অবশেষে যে-স্থলে এসে পৌঁছল, এখানে দিনের আলোর প্রবেশের পথেও হাজারো অন্তরায়। একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাকে পৌঁছে দিয়ে সঙ্গিনীরা বলে গেল: বিশ্রাম করুন ভদ্রে। স্নানের সরঞ্জাম নিয়ে আমরা একটু পরেই ফিরে আসব।
অন্ধকার কক্ষে বিশাল পালঙ্কের দুগ্ধফেননিভ শয্যায় নিমজ্জিত হতে হতে মনোমোহিনীর মনে হল, যারা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো, তারা সকলেই দাসী। পরিবারের বধূ হতে চলেছে যে-নারী, তাকে আবাহন বা বরণ করার জন্য রাজবংশের কেউই উপস্থিত হননি। তার কারণ কি নিছকই আত্মাভিমান? না তাচ্ছিল্য? এই পরিবারে বিবাহের অনুষ্ঠান কি এতখানিই অকিঞ্চিৎকর? নাকি বধূ হিসেবে সে নিতান্তই ব্রাত্য?
মনোমোহিনীর একান্ত সহচরী একবার শুধু এসেছিল। খুব উত্তেজিত। ফিসফিস করে বলে গেল: জানো তো, আমাদের যা রাজবাড়ি, কী বলব, অনেক বেশি এদের সবকিছু। দূরদূরান্ত থেকে এসেছে, সব রাজা। কী সাজপোশাকের ঘটা! কত হীরে-জহরত।যেমন এসেছিল, তেমনই লাফাতে লাফতে চলে গেল সে। যাওয়ার সময় বলে গেল: ভেবো না, আবার আসব। যা-যা খবর পাব সব এসে বলে যাব।
কিন্তু আর তার দেখা পাওয়া গেল না।
দেখতে দেখতে লগ্ন এসে গেল। পিতা যা-যা দিয়েছিলেন তা দিয়েই সাজানো হলো মনোমোহিনীকে। তার আগে গাত্রহরিদ্রা হয়েছে। স্নান হয়েছে পুষ্পমিশ্রিত জলধারায়। সুগন্ধি স্পর্শ করা হয়েছে শরীরের প্রতিটি গ্রন্থিতে। কবরী রচনা হয়েছে বহুক্ষণ ধরে। হাত, মুখমণ্ডল, পদযুগল প্রতিটির পরিচর্যায় এক বা একাধিক মণিপুরি সঙ্গিনী বহুক্ষণ অতিবাহিত করেছে। অবশেষে বসনভূষণে অলংকৃত করে তাকে যখন দর্পণের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো, নিজেকে দেখে চমকে উঠল মনোমোহিনী। এই অলোকসামান্যা নারী কি তার পরিচিত? মনে হলো মণিপুরের রাজগৃহে তার নবজন্ম হয়েছে।
মণিপুরি সঙ্গিনীরাই ধীরে ধীরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল তাকে। বিবাহস্থল পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে মন্দ্রিত হচ্ছে। চন্দ্রাতপের নিচে একটি আসনে বর অধিষ্ঠিত। সামনে হোমাগ্নি। অগ্নির ধূম্রজালে স্থানটি আকীর্ণ। বধূর জন্য নির্দিষ্ট আসন তাকে দেখিয়ে দেওয়া হলো। আস্তে আস্তে সেখানেই আসন গ্রহণ করল মনোমোহিনী।
শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, অসংখ্য কণ্ঠের কলরোল। হোমাগ্নি, ধূম্রজাল। এক লহমা ধূম্রপ্রভাবে দুই চক্ষু জ্বালা করে ওঠে মনোমোহিনীর। ভালো করে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না সে। স্বদেশ-স্বজন থেকে বহু দূরে তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি এইমাত্র ঘটে গেল। পিতা একবার চোখের দেখাও দেখতে পেলেন না, ভাবনাতেই বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে তার দুই নয়ন। জলভারে ঝাপসা হয়ে যায় তার দৃষ্টি। চারপাশে এত অসংখ্য অপরিচিতের ভিড়। সবকিছু মিলিয়ে স্বামীর চোখে চোখ রেখে ভালো করে তাকাতেই পারল না সে। তবুও দেখল, শান্তপ্রশান্ত স্বামীর মুখমণ্ডল।
বিবাহের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রটি পড়তে থাকেন পুরোহিত: যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব \ (তোমার এই হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় হোক তোমার।) মন্ত্রটি শেষ হলে পুরোহিত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, গুরুজনকে প্রণাম কোরো কন্যা।
বিবাহ ও আনুষঙ্গিক স্ত্রী-আচার সমাপ্ত হলে বর-বধূকে ফুলশয্যার কক্ষে নিয়ে আসা হলো। এখানে নিত্যানন্দ ও মনোমোহিনী মণিপুরের রাজপ্রাসাদের অন্যান্য যুবতি নারী দ্বারা পরিবৃত হয়ে পাশাখেলায় বসল। বাসরে অবশ্য মনোমোহিনীর লজ্জা ভাঙানো গেল না। অন্যদিকে, সকলেই জানে, নিত্যানন্দ একজন কবি। একজন কলহাস্যমুখরিত যুবতি নিত্যানন্দের কানের কাছে মুখ এনে বলল, তুমি একটি গান শোনাও না! নিত্যানন্দ কী আর করে? সে বঙ্গীয় ভাষায় রচিত একটি দেবীবন্দনা, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ও লালিত্যময় ঝংকারে গাইতে লাগল:
হৃৎকমলমঞ্চে দোলে করালবদনি শ্যামা
মনপবনে দুলাইছে দিবস রজনি ওমা
ইড়া পিঙ্গলা নামা, সুষুম্না মনোরমা
তার মধ্যে গাঁথা শ্যামা, ব্রহ্মসনাতনী।
সকলের কানে চমৎকার লাগল বটে, কিন্তু তার অর্থ যে কী, মণিপুরের নারীরা তা বুঝল না, বরং তারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি গেল, আর নিত্যানন্দের মুখমণ্ডল লজ্জায় আরক্তিম হয়ে উঠল। হাস্যবেগ কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলে এক সুদর্শনা যুবতি এক বৃদ্ধাকে ধরে বসল: ঠাকুরমা, তোমার দু-একটা রসের নমুনা শুনিয়ে দাও তো!
ঠাকুরমা রসিক মানুষ। বিবাহ উপলক্ষ্যে তিনি তার অঙ্গে একটি সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত হার পরেছেন। নিত্যানন্দের গালে হাত বুলিয়ে চিবুকে আদর করে, হাসতে হাসতে বললেন: আমরা হলাম মূর্খ মানুষ! আমরা কি আর তোমার বঙ্গীয় ভাষা বুঝতে পারি। আমাদের হলো রসের ছড়া। এই বলে ঠানদি হাত-পা নেড়ে শুরু করলেন:
আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর
ওগো অনেক দিনের পর
আজ আমার সোনার বধূ এলো আপন ঘর
ওগো অনেক দিনের পর
আজ আমার নাই কিছু কালো
পেয়ে আজ উজ্জ্বল মণি সব হলো আলো।
ঠাকুরমার ছড়ার ভেতর আদিরসের গুপ্ত ইঙ্গিত পেয়ে নারীরা হেসে একেবারে আকুল হয়ে উঠল। তারাই অধিক রাত্রিতে বর-বধূকে শয়নের অনুরোধ করে চলে গেল।
তারপর নিস্তব্ধ।
মনোমোহিনী সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ফুলশয্যার বাজুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। নিত্যানন্দের ঘুম এলো না। সহসা জীবনের এমন পরিবর্তন, গত কয়েক দিনের ঘটনাস্রোত তার মনের ভেতর ওঠাপড়া করছে। উন্মুক্ত বাতায়নপানে তাকিয়ে নিত্যানন্দ দেখল, বাইরে চমৎকার জোছনা। সে বাতায়ন-পাশে এসে দাঁড়াল।
আকাশে চাঁদ হাসছে। বাতাসের স্পর্শ নিত্যানন্দের অঙ্গে কোমল-স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছে। নিত্যানন্দ ভাবছে: জীবন কেমন যেন এক মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বেশ তো ছিল একাকী—স্বাধীন, মুক্ত। কিন্তু সে কি জানত: কোথায় ছিল এই কন্যা? কেমন করে এই কন্যাটি এসে তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাবে? এখন সে ধরা পড়ে গেছে। কোনও এক ভাবকে নিত্যানন্দ যেমন তার কবিতায় ছন্দের নিগড়ে, অক্ষরের গারদে ভরে শ্লোক রচনা করে, তেমনই আজ এই আনন্দ-রাত্রিতে—এই বাসরে—বন্দি হয়েছে। সহসা পশ্চাতে কটিভূষণের কিঙ্কিণী শুনে সে মুখ ফিরিয়ে দেখল, মনোমোহিনী শয্যা থেকে উঠে এসে বাতায়নের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেও মুগ্ধ হয়ে জোছনা দেখছে। চাঁদের আলোক তার মুখের ওপর বাঁকাভাবে পড়ে আলো-ছায়ার সৌন্দর্যলোক রচনা করে চলেছে।
নিত্যানন্দ বলল, বাইরে যাবে? মনোমোহিনী অবাক হয়ে নিত্যানন্দের মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। নিত্যানন্দ পুনরায় বলল, বাইরে নদীতীরে এখন খুব জোছনা ফুটে আছে। এই গৃহের অভ্যন্তরটা ভীষণ উষ্ণ। নদীতীরে খুব বাতাস বইছে। যাবে?
মনোমোহিনী অবগুণ্ঠনের ভেতর মৃদু শিরশ্চালন করে অস্ফুট স্বরে বলল, না। কেউ যদি দেখে ফেলে?কেউ দেখবে না। সকলেই সুপ্তিমগ্ন। বেশি দূরেও যাব না। লুকিয়ে যাব। আবার ভোররাত্রি কেউ জেগে ওঠার আগেই ফিরে আসব। চলো।
মনোমোহিনী ইতস্তত করতে থাকে। তবে তার চক্ষে লুকিয়ে নদীতীরে যাওয়ার উত্তেজনা ক্ষণিকের জন্য নেচে ওঠে। নিত্যানন্দ দ্বার আলগা করল। মনোমোহিনী পা টিপে টিপে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। আলোক ও অন্ধকারের অলিন্দ নিস্তব্ধ পরিরাজ্যে পরিণত হয়ে আছে। এই অলিন্দ পেরিয়ে তারা অগ্রসর হতে লাগল। নিত্যানন্দ কিছু দূরে যায়, পশ্চাতে ফিরে দেখে মনোমোহিনী তাকে অনুসরণ করছে কি না।
মনোমোহিনী কিছুটা অগ্রসর হয়েই একটি বিরাট স্তম্ভের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। লজ্জা, সংকোচেই হয়তো সে আর অগ্রসর হতে চাইছে না। নিত্যানন্দ অদূরে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে মনোমোহিনীকে আহ্বান করে বলল, চলে এসো। আমি ছাড়া কেউ তোমাকে দেখছে না।
মনোমোহিনী পুনরায় অগ্রসর হতে লাগল। এইরূপে রাজগৃহ থেকে পুষ্পতলা পেরিয়ে দোলমঞ্চ অতিক্রম করে নাটমন্দির ছেড়ে এগিয়ে চলল তারা। কোনও এক অস্ফুট পুলকে তাদের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে তারা নদীতীরে বালুচরে এসে উপস্থিত হলো।
মনোমোহিনী পূর্বতন সকল লজ্জা ভুলে এই সংগোপন পলায়নের আনন্দ-উত্তেজনায় উন্মাদের মতো হাসছে। নিত্যানন্দও তার এই নূতন পরিকল্পনার উল্লাসে উল্লসিত। দুইজনে বালুচরের ওপর শ্রান্ত হয়ে বসে পড়ল, আর জোছনার আলোক ঝরে পড়ছে তাদের ঘিরে। নদীজল চাঁদের আলোয় চিক্কণ হয়ে মনোমোহিনী-নিত্যানন্দের নিভৃত অভিযানের সংবাদ পেয়ে হিল্লোলিত হয়ে উঠছে।
নিত্যানন্দের প্রতি মনোমোহিনীর প্রাথমিক সংকোচ কেটে গেল। নিত্যানন্দ অতিঘনিষ্ঠ হয়ে মনোমোহিনীর পাশে বসে মনোমোহিনীর সজ্জীকৃত খোঁপা অর্ধেক খুলে নিজের স্কন্ধের ওপর বিলিয়ে দেয়। জোছনার আলোকে মনোমোহিনীকে দেখতে দেখতে নিত্যানন্দ গভীর-মৃদুকণ্ঠে বলল, নদীর অপর পারের অন্ধকার বনানী কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। তা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?
মনোমোহিনী কোনও উত্তর দিলো না। নিশ্চুপ বসে রইল। সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। শঙ্কিত হয়ে নিত্যানন্দ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?
অশ্রুবিগলিত স্বরে মনোমোহিনী বলল, এই অন্ধকারের কথা আমাকে বলবেন না। এই অন্ধকারের কথা বললে আমাকে আমার পিতার পরিত্যাগের কথা মনে পড়ে।
মনোমোহিনীর স্কন্ধে নিত্যানন্দ হাত রাখল। তখনই স্নেহের স্পর্শ পেয়ে রোরুদ্যমানা মনোমোহিনী আকুল হয়ে কুলায় প্রত্যাশী পাখির মতো স্বামীর বক্ষে মুখ গুঁজে দিলো। নিত্যানন্দের মনে হলো, সহসাই মনে হলো, সে এতদিন কীসব অনর্থক উপাদান নিয়ে কাব্য রচনা করে আসছে! দেবীবন্দনা আর দেবীভজন লিখছে। কিন্তু মানুষের হৃদয়ের হাসি-কান্নার স্রোতধারা, মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র দুঃখ-সুখের কথা সে তো কখনও রচনা করেনি! মনোমোহিনীর বেদনার মধ্য দিয়েই সে তার কাব্যের সার্থকতা আবিষ্কার করতে পারে। মনোমোহিনীকে বক্ষে নিয়ে তার আরও মনে হলো, এই তো তার জীবনের পরম আনন্দ! এই হৃদয় না পেলে সে অনন্তকাল একাকী ঘুরে বেড়াত, তার জীবন চিরকাল অপূর্ণই থেকে যেত। কী মাহেন্দ্রক্ষণেই না সে তার পিতার আদেশে ত্রিপুরায় গিয়েছিল! কী সৌভাগ্যই না তার! আজ যে সে কাব্য, প্রণয় ও জীবনের আভাস পেল, মনোমোহিনীকে না পেলে তা তো তার পাওয়া হতো না।