২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ 

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা: যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা

মোস্তফা হোসেইন
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে আবারও। দাবি ছিল বেশ আগে থেকেই। আগের সরকারগুলো সবাই এর যৌক্তিকতা বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, আইনি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেনি তারা। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর পর এই দাবি নিয়ে আবারও মাঠে নেমেছে তরুণরা। হয়তো বর্তমান সরকার দাবিগুলো অগ্রাহ্য করবে না কিংবা দাবিগুলো অন্যায্য বলবে না। এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ মানুষের মতো তারাও মনে করতে পারে, প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা পরিবর্তিত পরিবেশে যথোপযুক্ত নয়। শুধু গড় আয়ু বেড়েছে বলেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়স পুনর্নির্ধারণ নয়, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়স এবং অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা পুনর্নির্ধারণ জরুরি।
একসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ইত্যাদির কথা বলা হতো। তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪-৫ বছরের সেশনজট ছিল। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ করতে করতেই তার চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা পেরিয়ে যেত। পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট শূন্যে নেমে আসার কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষের যে সময়কাল তা ইতিবাচক হয়। কিন্তু পরবর্তী সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সীমিত পদের জন্য অধিক প্রার্থীর উপস্থিতি। এমনও দেখা গেছে যে, একটি শূন্যপদের জন্য সহস্রাধিক প্রার্থী আবেদন করেছেন। সেই সুবাদে বলা যায় ১ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে ৯৯৯ জনই চাকরি বঞ্চিত থাকেন।
অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে পদের সংখ্যার তুলনায় অস্বাভাবিক চাকরিপ্রার্থী। যে কারণে চাকরিলাভে ব্যর্থ হওয়ার সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের মতো হয়ে দাঁড়ায়। একজন প্রার্থী হয়তো ৫-৭ বছরেও চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একসময় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরও তাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম সুযোগ-সুবিধায় যোগ দিতে হয়। নতুবা বিকল্প কর্মসন্ধানে নিয়োজিত হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে দেশ তরুণদের সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় শুধু বয়সজনিত জটিলতার কারণে।
দীর্ঘসময় ধরে চাকরিরতদের অনেকেই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। বঞ্চনামুক্তির জন্যও এর পরিবর্তন প্রয়োজন বলছেন অনেকেই। সরকারি চাকরির পদসংখ্যা রাতারাতি বাড়ানোর সুযোগ নেই। বয়সজনিত কারণে অবসরে যাওয়ার সংখ্যাও সীমিত। মৃত্যুজনিত পদশূন্য হওয়ার সংখ্যা ২০-৩০ বছর আগের চেয়ে কমে গেছে।
স্বাধীনতা লাভকালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৮ বছর। সেই সময় সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময়ও ছিল ৫৮ বছর। যাকে যৌক্তিক বলেই তখনকার মানুষে মেনে নিয়েছিল। মানুষের গড় আয়ু বাড়ার কারণে সেই বয়সসীমা প্রযোজ্য নয়। আজ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর সেই অবস্থায় বিপুল সংখ্যক মানুষ ৫৮ বছর বয়সে কর্মক্ষমতা থাকার পরও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এই কর্মহীন জনগোষ্ঠী দেশের জন্য সম্পদের পরিবর্তে বোঝা হিসেবে পরিণত হচ্ছে। শ্রমের এই অপচয় রোধে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো জরুরি।
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিকালীন বয়সের বিষয়টি যে স্থবির হয়ে ছিল তা নয়। যেমন বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়স বৃদ্ধি করে ৬৭ বছর করা হয়েছে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য করা হয়েছে ৬৫ বছর। এই সিদ্ধান্ত যুগের উপযোগী। কিন্তু শুধু অবসরকালীন বয়স নির্ধারণ করে প্রবেশকালীন বয়সসীমা কমিয়ে রাখলে চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চনামুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকছে না। কিন্তু সরকারি চাকরিক্ষেত্রে আগের বয়সসীমাই রয়ে গেছে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের বয়সসীমা বিভিন্ন দেশে পরিবর্তন হয়। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর সঙ্গেও তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হয়নি। নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর থেকে ৪২ বছর। তবে প্রশাসন ক্যাডারে প্রবেশকাল ধরা হয়েছে ২১ বছর থেকে ৩২ বছর। ভারতের এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়-চাকরির প্রকারভেদে প্রবেশকালীন বয়সের ভিন্নতা রয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়-ভারতে গড় আয়ু বাংলাদেশের চেয়েও কম। আমাদের যেখানে প্রায় ৭৩ বছর ভারতে গড় আয়ু সেখানে ৬৯ বছরের কিছু বেশি। ভারতের মতো আমাদের এখানে এতটা বিভাজন নেই। বাংলাদেশেও বিভিন্ন বিশেষায়িত চাকরির ক্ষেত্রে বয়সের ভিন্নতা প্রযোজ্য হতে পারে।
আরেক নিকটবর্তী দেশ নেপালেও চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়স ১৮ বছর থেকে ৩৫ বছর। তাদের গড় আয়ুও আমাদের চেয়ে কম। তাদের গড় আয়ু ৭১ বছরের কিছু বেশি হওয়ার পরও চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়স আমাদের চেয়ে বেশি।
এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার মানুষের গড় আয়ু সর্বাধিক। সেখানে মানুষের গড় আয়ু ৭৫ বছর। তাদের ওখানে একসময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়সের সীমা ছিল ৩৫ বছর। এখন সেটা বাড়িয়ে ৪৫ বছর করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার তুলনায় আমরা গড় আয়ুর ক্ষেত্রে ২ বছর পিছিয়ে আছি। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়সে ১৫ বছর পিছিয়ে। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে এই বয়সসীমাকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়।
চাকরিতে ঢুকতে ও বের হতে বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই এমন দেশও আছে। সেটা অবশ্য আমাদের মতো গরিব দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কোনো কোনো দেশে কর্মচারীর কর্মক্ষমতাই তার অবসরগ্রহণের বয়সসীমা হিসেবে গণ্য হয়। আমাদের দেশে এমন বিধান প্রযোজ্য হবে না সরকারি চাকরিতে চাহিদা অধিক হওয়ার কারণে। বেকারত্ব অধিক হওয়ার কারণেও এটা সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বয়সসীমার জরিপ করলে দেখা যাবে পৃথিবীর ১৬২টি দেশে চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ পর্যন্ত নির্ধারিত। তাই আমাদের দেশেও যদি সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালীন সর্বাধিক বয়স ৩৫ করা হয় সবদিক থেকেই তা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি।
দেশে সরকারি চাকরিরত মানুষের সংখ্যা ২৪ লাখের কাছাকাছি। শূন্যপদের সংখ্যাও খুবই নগণ্য। এমন অবস্থায় স্বল্পসংখ্যক পদের জন্য এভাবে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কেন তা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বেসরকারি চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরিতে জব সিকিউরিটি বেশি, এমনটা সবাই বলবেন। বলবেন, বিনিময় অর্থমূল্যও সরকারি চাকরিতে বেশি। যে কারণে মানুষের স্বপ্ন থাকে একটি সরকারি চাকরি পাওয়া। এই প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে সরকারি চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এই সমস্যা সমাধানে বেসরকারি/ব্যক্তিখাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা তৈরি করতে হবে।
এই মুহূর্তে চাকরিপ্রার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃত। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারার কারণে একটি প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে তাদের দাবি অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশকালীন বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর করা হোক। একইভাবে অবসরকালীন বয়সসীমাও বাড়িয়ে অন্তত ৭০বছর করা যেতে পারে। তবে স্বেচ্ছা অবসরগ্রহণের সময়ও নির্ধারিত হতে পারে।
এই মুহূর্তে সরকারি চাকরি তরুণদের কাছে সোনার হরিণ এর মতো। এই ধারার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এরজন্য দরকার হচ্ছে বেসরকারি খাতে শ্রমমূল্য এবং জব সিকিউরিটি বাড়ানো। বেসরকারি খাতে বেতন কাঠামো নেই। যে যেভাবে পারে শ্রমশোষণ করছে। ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দেয়া যায় এই প্রসঙ্গে।
আমার ছেলে বুয়েট থেকে ভালো ফলসহ বেরিয়ে চাকরির দরখাস্ত করছিলো বিভিন্নস্থানে। দেশের একটি বিখ্যাত ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি কোম্পানিতে দরখাস্ত দিলে তারা তাকে সিলেকসন করে। কিন্তু বেতন অফার করে ২৫ হাজার টাকা। ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কারখানায় চাকরি। সেখানে কোনো ডরমিটরি নেই। আসা যাওয়া কিংবা খাওয়ায় কোনো সহযোগিতা নেই। কয়েকবার তাকে ফোন করে জয়েন করতে অনুরোধ জানায় তারা। এক পর্যায়ে সে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোতে চাকরি পায়। তিনগুণ বেতন এবং অন্যান্য সুবিধাসহ।
বিএটিসি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হওয়ায় তাদের বেতন কাঠামো বেশি হবে এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। দেশি বড় কোম্পানিটি লাভবান ও সুনামধারীও বটে। তারা কেন যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারছে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারি বেতন কমিশনের মতো তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও তেমনি কমিশন গঠন জরুরি বলে মনে করি। বেসরকারি পত্রিকাগুলোর জন্য যেমন ওয়েজ বোর্ড আছে তেমনি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য বেতন কমিশন গঠন করে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তা না হলে সরকারি সীমিতসংখ্যক চাকরির পেছনে তরুণদের দৌড়ঝাঁপ কমবে না।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়