প্রতিদিনের ডেস্ক:
২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে চেয়েছিল সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামকে শহরে রূপান্তর করা, ২০৪১ সালে মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার করার লক্ষ্য ছিল। এজন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এর মধ্যে ১৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকাই খরচ হবে পরামর্শক খাতে।প্রকল্পের মূল কাজ বাদ দিয়ে পরামর্শকসহ সম্মানি, আপ্যায়ন, হায়ারিং চার্জ, সেমিনার ও কর্মশালা কাজে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। এসব কাজ দেখিয়ে খরচ করা হয়েছে ৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরেও ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচের ছক তৈরি করার পরিকল্পনা চলছে। অথচ রূপকল্প-২০৪১ এর জন্য দৃশ্যমান কোনো কাজ প্রকল্পে দেখা যায়নি।‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নে মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা (অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা) প্রণয়ন ও পরিবীক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ঘটেছে এমনটি। জুলাই ২০১৯ সালে শুরু হয়ে প্রকল্পটি জুন ২০২৪ মেয়াদে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়। মে-২০২৪ নাগাদ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অথচ বাস্তব অগ্রগতি ৯০ শতাংশ।প্রকল্পের বাকি অর্থ খরচের জন্যই মূলত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ও আন্তঃব্যয় সংযোজনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক বিভাগে প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে জিইডি। একটি সভাও হয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে নয় আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। প্রকল্পে কিছু কোয়ারি দিয়েছি। তবে এ ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে আমরা নই। তারপরও দেখি আমরা সব সময় উপদেষ্টা মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো।- প্রকল্পের আওতায় প্রথমে পরামর্শক ব্যয় ছিল ৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সংশোধিত প্রকল্পে এক লাফে ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা পরামর্শক ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিলাসী এ প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা পরামর্শক ব্যয় রাখা যেতে পারে বলে মত কমিশনের।আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পে কিছু কোয়ারি দিয়েছি। তবে এ ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে আমরা নই। তারপরও দেখি আমরা সব সময় উপদেষ্টা মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো।’ব্যয়ের অন্য যত খাত পর্যায়ক্রমে ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচের একটা ছক তৈরি করেছে জিইডি। প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাখা হলেও পরে এ খাতে বাজেট কমানো হচ্ছে। সম্মানি খাতে ৬২ লাখ, আপ্যায়ন ভাতা ৮৩ লাখ, সেমিনার ও কর্মশালা খাতে ৪ কোটি ৭২ লাখ, ডাকে ১৩ লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপনে ৩২ লাখ, বইপত্র ও সাময়িকী খাতে ১৩ লাখ টাকা খরচের ছক তৈরি করা হয়েছে।এছাড়া আউটসোর্সিংয়ে ১ কোটি ৫২ লাখ, কমিশনের মিটিং খাতে ১ কোটি ৪১, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে ২ কোটি ৮০ লাখ, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণব্যয় ২৭ লাখ, কম্পিউটার সামগ্রীতে ২৬ লাখ, মুদ্রণ ও বাঁধাই খাতে ৩ কোটি ৬০ লাখ, সিল ও স্ট্যাম্পে ৩ লাখ, মনোহারিতে ৭৭ লাখ, জরিপ কাজে ৬ কোটি ৮০ লাখ, কম্পিউটার মেরামতে ১৭ লাখ, যন্ত্রপাতি খাতে ১৬ লাখ ও কম্পিউটার খাতে ৯ লাখ টাকা খরচের ছক কষা হয়। এছাড়া দায়িত্ব ভাতা খাতে ২৪ লাখ, অপ্রত্যাশিত ব্যয় খাতে ২ লাখ অফিস যন্ত্রপাতি কেনা খাতেও ১২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।রূপকল্প-২০৪১ অবাস্তব আখ্যায়িত করে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রূপকল্প ২০৪১-এর স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত হবে- এ স্বপ্ন বিভ্রান্তিমূলক ছিল। ২০৪১ সালে দেশ উন্নত হবে, মাথাপিছু আয় সাড়ে ১২ হাজার ডলার হবে- সবই দুঃস্বপ্ন। এ ধরনের প্রকল্প চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে এসব প্রকল্প শিকলবন্দি করার।’ রূপকল্প ২০৪১-এর স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত হবে- এ স্বপ্ন বিভ্রান্তিমূলক ছিল। ২০৪১ সালে দেশ উন্নত হবে, মাথাপিছু আয় সাড়ে ১২ হাজার ডলার হবে- সবই দুঃস্বপ্ন। এ ধরনের প্রকল্প চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে এসব প্রকল্প শিকলবন্দি করার।- অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন৪৭ কোটি টাকা ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘৪৭ কোটি অংকে ছোট হলেও দেশীয় টাকা। এখন এক টাকাও অপচয় করার সময় নেই। আকার বড় না ছোট এটা দেখার সময় নেই। ছোট প্রকল্পে দুর্নীতিও বেশি হয়। দুর্নীতি আয়োজনের সব জায়গা বন্ধ হওয়া দরকার।’৪৭ কোটি টাকার প্রকল্পে ১৭ কোটি পরামর্শক ব্যয় রাখা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে রেগে যান প্রকল্পের পরিচালক ড. মুনিরা বেগম। পরে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রকল্পের মূল কাজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি (অষ্টম ও নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা) পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পরিবীক্ষণ। প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) দলিল প্রণয়ন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে ব্যাকগ্রাউন্ড স্ট্যাডি, স্বল্পমেয়াদি গবেষণা, জরিপ পরিচালনা, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ।প্রকল্প সংশোধনের কারণ চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ জুন ২০২৫ এ শেষ হবে। এর আগেই শেষ করতে হবে নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। এছাড়া নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে বেশকিছু নতুন ব্যাকগ্রাউন্ড স্ট্যাডি সমীক্ষা দ্রুততম সময়ে পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ কারণে সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে স্ট্যাডি সমীক্ষা যথাসময়ে সম্পন্ন করা কঠিন হবে বিধায় প্রকল্পের ষষ্ঠ ও সপ্তম স্টিয়ারিং কমিটির সভায় নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দ্রুত প্রণয়নের স্বার্থে নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করে চলমান প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।বিভিন্ন খাতে আন্তঃঅঙ্গব্যয় সমন্বয় প্রয়োজনীয়তার নিরিখে প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অব্যয়িত অর্থ চাহিদার আলোকে অন্য খাতে সমন্বয় করা হয়েছে। ১৪ খাতে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনের আলোকে বাস্তবায়ন অগ্রগতি অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা রোধে ৯ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের অব্যবহিত পরেই সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের নেতৃত্বে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ লক্ষ্যে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের সম্ভাব্য কাঠামো প্রণয়ন, কোর কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটির সম্ভাব্য গঠন এবং আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সব সেক্টর/ ডিভিশনের মতামতের আলোকে আরডিপিপিতে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৪টি খাতে সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়নের জন্য পরামর্শক বাবদ বরাদ্দ ৯ কোটি ১০ লাখ টাকা।