ড. মাহবুব হাসান
নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে যে সহযোগিতার সমিতি গড়ে উঠেছিল সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের গোড়ায়, সেই সমিতির সংক্ষিপ্ত বা এব্রিবিয়েশন হচ্ছে SAARC (সার্ক)। ওই আঞ্চলিক সহযোগিতার সমিতিটির পুনরুজ্জীবন চান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এখন আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য গেছেন। কিন্তু জাতিসংঘের ওই অধিবেশনের বাইরে, যাকে সবাই বলে সাইড লাইনে বেশ কিছু মিটিং হয় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে, পারস্পরিক বিষয়-আশয় নিয়ে। সেই আলোচনায় তারা চান ওইসব নেতার সমর্থন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অন্য বিষয়েও তারা মতবিনিময় করেন।
সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টি কোনো দখলদারকেই তাদের অ্যারেনার বাইরের মানুষ মনে করে না। কেননা, তারা ঘুস দিয়েই তো প্লটের বরাদ্দ বা জমি দখল করেছেন। এই পরিস্থিতির চির অবসান হওয়া জরুরি। সরকারের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা দরকার। কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। দরকার পড়লে সমবায়ী মালিকানা ভিত্তিতে হলেও দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুযোগ দিতে হবে।
এটা একটি প্রচলিত ধারা। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সহযোগিতা চেয়েছেন। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তিনি কিছু চাওয়ার আগেই তারা মানে বিশ্বনেতারা তাকে সহযোগিতা করার কথা জানান। এবং তিনি যেন ওই সম্মেলনের প্রধান একজন, এরকম একটি সম্মান পাচ্ছেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে উষ্ণ ও আন্তরিক মিটিং বিশ্ববাসী দেখেছে এবং আমরা তার অংশীজন হিসেবে যে গৌরবের ভাগ পেলাম, তা সত্যিকার অর্থেই জাতির কাছে অভাবনীয় ছিল। একটি ছোট দেশের সরকারের উপদেষ্টামাত্র তিনি, কিন্তু বিশ্ব দরবারে তার গ্রহণযোগ্যতা যে উচ্চতায় তা আমাদের বিস্মিত করেছে।
এটা যে আমাদের ধ্বংসপ্রায় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা টেনে তোলার একটি বিপুল চেষ্টা, তাই যেন অনুভব করলাম। বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন ও কন্যা চেলসি ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে উঠেছেন সেই কবে। সেই পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে ক্লিনটন ও ইউনূস লুকোচুরি খেলার মতো করে পরস্পরকে জড়িয়ে নিয়ে যে উষ্ণতার বান আনলেন, তাও বিরল। বিশ্বনেতারা তাকে বাংলাদেশের মতো একটি সংগ্রামশীল জনঅধ্যুষিত দেশের নেতা বলে মনে করেননি শুধু, তিনি যে ওই নেতাদেরই পরম বন্ধু, সেটাই তারা প্রমাণ করেছেন।
সাইড টেবিলে বসে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফ নেওয়াজ। তারা দুজনই সার্কের পুনর্জন্ম চান। কিন্তু যে সাতটি দেশ এর মূল সদস্য, তাদের মধ্যে ভারত হচ্ছে সব থেকে বড় স্টেকহোল্ডার। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ম্যাপের দিকে তাকালে মনে হবে ভারতের চারপাশের ওই দেশগুলো যেন উপমহাদেশেরই গলার মালা।
সার্ক যে আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি, তার পুরো দায় ভারতের। কারণ ভারত সব সময় সব বিষয়ে যেমন চাইছে, তেমনি সার্কের ওপরও সে দাদাগিরি চাপাতে চেষ্টা করেছে। পরিণামে তা খারাপ ফল দিয়েছে। এই সূত্রে ওই অনন্য চেতনার সার্ক টুটে গেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি পরস্পর থেকে সহযোগিতার যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, একটি ঐক্য ও বিশ্বাসের ভিত সৃষ্টি হয়েছিল, তা নস্যাৎ হয়ে গিছে। পরস্পরের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ও সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন ও কল্যাণকে কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছিল, সেই প্রবাহটি ধূলিসাৎ করেছে ভারত, একাই।
মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটাই শীতল যেটা অনেকটাই ঘৃণার স্তরে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগে কাশ্মিরকে নিয়ে, কারগিল নিয়ে তার একটি। আমাদের ওপর নানারকম অন্যায় করে ভারত প্রমাণ করেছে দেশটি বাংলাদেশের বন্ধু নয়। তাদের কূটনৈতিক ভাষা যতই পোলাইট হোক না কেন, সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর গুলি করে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। নিরস্ত্র এবং ক্ষেতের চাষা বা তাদেরই সন্তান কাজ করতে গেলেও ওপার থেকে বিএসএফ গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এবং হত্যাই বিএসএফের প্রধান নেশা। এ কারণে এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভারতবিরোধী। শুধু আওয়ামী লীগ ভারতের প্রেমে হাবুডুবু খায়। উৎখাত হওয়ার পর হাসিনা প্রমাণ করেছেন যে তাকে পালাতে হবে ভারতেই। শেখ হাসিনা পালায় না- বলে যে দম্ভ করেছিলেন, সেই তিনিই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দিল্লিতে।
ফলে সার্কের উত্থান সহজ হবে না বলেই মনে করি আমি। ভারত ছাড়া আর দেশগুলো চাইলেও নরেন্দ্র মোদীর অনুমোদন পাবে না সার্ক। তবে, ভারতের আক্কেল দাঁত উঠলেই কেবল সে জিয়ার স্বপ্ন ও এরশাদের সার্বিক সহযোগিতায় সার্কের প্রথম অধিবেশনটি ঢাকায় হয়েছিল, ভারতের মনন-চেতনায় এরকম কোনো উদ্ভাবনী সহযোগিতার দৃষ্টান্ত নেই বলে তারা সার্ককে আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারেনি।
দুই.
এখনই লেখা উচিত আমাদের পর্যটন শিল্প নিয়ে। সামনেই মৌসুম আসছে, মানে শীতকাল। শীত পড়ুক আর নাই পড়ুক, ঋতুর বৈচিত্র্য তো আছে। আর সেই বৈচিত্র্যের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে বেড়ানো। বাংলাদেশিরা আগে বেড়ানোর বিষয়ে তেমন সজাগ-উৎসাহী ছিল না। দেশের ভেতরেও যে দেখার উপভোগ করার অনেক প্রাকৃতিক প্রতিবেশ আছে, এটাই আমরা বুঝতাম না। পাহাড়ি ঝরনা আবার দেখার বিষয় হলো নাকি! এরকম ভাবনার জালে বন্দি ছিল মানুষের চিত্তবিনোদনের সাম্রাজ্যটি। কিন্তু সেই একই লোক সিঙ্গাপুরে গিয়ে আন্ডারওয়াটার অ্যাকুরিয়ামে ঢোকার নেশায় পাগলপ্রায়। আমাকে একজন বলেছিলেন তিনি আমেরিকার গ্রান্ড কানালে যেতে চান। নিউ ইয়র্ক থেকে সেখানে যাওয়া অনেক দূরের পথ। আর একা একা ভ্রমণ করাও আনন্দদায়ক নয় সেখানে। তাই তিনি আর যাননি।
পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার কোনো শিল্পকেই প্রণোদনা দিতে চায়নি। পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে বিপুল প্রচার প্রচারণা করেছে ১৫ বছর ধরে, কিন্তু ঢাকা থেকে রেলের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেনি। কিন্তু প্রচারণার কমতি ছিল না। চট্টগ্রাম থেকেও কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হয়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে দুটি কারণে। এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সার্ক সদস্য মালদ্বীপের পর্যটন হচ্ছে এক নম্বর শিল্প সেক্টর। নেপালে তো হিমালয়ই সৌন্দর্যের আকর। পৃথিবীর অনেক মানুষ মালদ্বীপে বেড়াতে যায় আনন্দ বিনোদনের জন্য। গোটা ব্যবস্থাপনায় তারা এতেটাই প্রাগ্রসর হয়েছে যে মনে হয়, তাদের চিন্তার দরজা খুলে গেছে।
আমাদের দেশে রয়েছে ১০০ মাইলের টানা সি-বিচ, যা আর কোনো দেশে নেই। এছাড়া রয়েছে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। আছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অববাহিকায় অনেক দর্শনপ্রিয় প্রাকৃতিক দৃশ্য, যা উপভোগের স্পট হিসেবে আজ মানুষ চেনে। গোটা দেশের নৈসর্গিক এলাকার পর্যটনিক রোডম্যাপ করে পরিকল্পনা করার পর, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে কেন্দ্রে রেখে এমন এক ভূনিসর্গ গড়ে তোলা যায়, যা দিয়ে লাখ লাখ ডলার আয়-রোজগার করা যাবে একদিনেই। কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনকে আনন্দবিনোদনের স্বর্গে পরিণত করা যায়। সেখানকার বসতিদের একটি জায়গায় কনসেনট্রেট করে উচ্চতর শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নতি করে এ পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সুন্দরবনকে দর্শনের এক প্রাকৃতিক খনি করে তোলা যায় যদি স্কাইলাইনের আয়োজন করে রাখা হয়।
সুন্দরবনের বাঘ আর হরিণের দর্শন পেতে লাখ লাখ পর্যটন বাংলাদেশে আসবে, এতে কোনো ভুল নেই। একটি ছোট এয়ার পোর্ট ও হেলি-প্যাড নির্মাণ করে যোগাযোগ খাতেরও উন্নতি সম্ভব। এসব সুযোগে কেবল বাংলাদেশিরাই বেড়াতে যাবে না, ভিনদেশিরাও আসবেন বাঘ-হরিণের সুবাস নিতে। স্কাইরূপ ওয়ে নির্মিত হলে পর্যটনের নতুন দরজা খুলে যেতে বাধ্য। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে এই সুতো ধরে।
আমরা কথা বেশি বলি, কাজে লবডঙ্ক। পরিকল্পনাও মন্দ করতে পারি না, তবে তা বাস্তবায়নে ডবল টাকা ব্যয় করি। অসততা যদি মননে-মানসে লেপ্টে থাকে তাহলে সেই প্রকল্প নেওয়া না নেওয়া সমান কথা। মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি কক্সবাজারের সি-বিচের কাছের সব জমি লিজ নিয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সরকারের রাজনৈতিক সেনাপতিরা। কেউ কেউ দখল করে নিয়ে বসে আছেন, কখন সরকার পরিকল্পনা দেন এবং সেই মোতাবেক তারা স্টারবেইজড হোটেল মোটেল নির্মাণ করবেন। এবং তারা কোনো আইনের তোয়াক্কা করবেন না। কেননা, আইনের শাসন ছিল না তাদের ওপরে।
সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টি কোনো দখলদারকেই তাদের অ্যারেনার বাইরের মানুষ মনে করে না। কেননা, তারা ঘুস দিয়েই তো প্লটের বরাদ্দ বা জমি দখল করেছেন। এই পরিস্থিতির চির অবসান হওয়া জরুরি। সরকারের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা দরকার। কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। দরকার পড়লে সমবায়ী মালিকানা ভিত্তিতে হলেও দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সুযোগ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতার আওতায় নেওয়া যাবে না কোনো ভালো ও উন্নয়ন পরিকল্পনা। আমলাতান্ত্রিক মনোভাবও পরিত্যাগ করতে হবে। তারা ভালোকেও সহজভাবে নিতে শেখেনি।
আমরা কি এত সব ছাড় দিতে পারবো ভূমি গ্রাসকারীদের?
লেখক: কবি, সিনিয়র সাংবাদিক।