সাইফুল হোসেন
কোনো কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য—ব্যক্তিগত, পেশাগত বা সৃজনশীল। আমরা প্রতিদিন নানান কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকি, এবং প্রতিটি কাজ সফলভাবে করতে হলে মনের একাগ্রতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে মনের বিচ্যুতি দূর করে মনকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রস্তুত করবো?
একাগ্রতা এবং মনোযোগই যদি সফলতার মূলমন্ত্র হয়, তাহলে তা অর্জন করতে গেলে কী কী বিষয় বিবেচনা করতে হবে? প্রথমে, লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। যে কোনো কাজ শুরু করার আগে আপনার লক্ষ্য কী, কেন করছেন, এবং এর মাধ্যমে আপনি কী অর্জন করতে চান—এটি স্পষ্টভাবে জানা জরুরি।
উদ্দেশ্য পরিষ্কার না হলে, কোনো কাজেই মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব নয়। আমরা অনেক সময় ছোট কাজকে তুচ্ছ ভাবি এবং মনোযোগ ছাড়াই তা শেষ করতে চাই। কিন্তু সেই কাজটি হয়তো একটি বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনি একটি রিপোর্ট তৈরি করছেন। যদি আপনার মনে থাকে যে এই রিপোর্টটি আপনার পেশাগত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে মন অন্য দিকে বিভ্রান্ত হবে না।মনোযোগ ধরে রাখার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ, মনের শান্তি, ইতিবাচক মানসিকতা এবং শারীরিক সুস্থতা জরুরি। যখন আমরা আমাদের মনকে প্রস্তুত করতে পারি এবং কাজের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ থাকতে পারি, তখনই সেই কাজের ফলাফল সফলভাবে আসবে।
লক্ষ্য যদি পরিষ্কার থাকে, তাহলে সেই কাজের প্রতি আপনার নিবেদনও বেশি থাকবে। তবে শুধু লক্ষ্য জানা থাকলেই হবে না, মনের শান্তি ও স্থিতিশীলতাও জরুরি। আমরা প্রায়ই নানান চিন্তা, উদ্বেগ বা মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাজ শুরু করি। কিন্তু এ ধরনের মানসিক অবস্থা থেকে ভালো ফলাফল আশা করা যায় না। কাজ শুরুর আগে কয়েক মিনিটের জন্য মনকে শান্ত করার চেষ্টা করা উচিত। এটি হতে পারে ধ্যানের মাধ্যমে বা কিছু সময় নীরবতা ধরে রেখে। মনকে স্থিতিশীল রাখলে কাজের প্রতি একাগ্রতা ধরে রাখা সহজ হয়। যখন মন শান্ত থাকে, তখন আমরা জটিল কাজগুলোও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারি।
কাজের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, কাজটি ছোট ছোট ধাপে ভাগ করা। অনেক বড় কাজ শুরু করার সময় আমরা প্রায়ই মনে করি এটি কীভাবে শেষ করবো। এই ধরনের উদ্বেগ এড়ানোর জন্য কাজটি বিভিন্ন ধাপে ভাগ করা অত্যন্ত কার্যকর। প্রতিটি ছোট অংশ সফলভাবে শেষ করলে, কাজটি সহজ ও সাশ্রয়ী মনে হয়। যেমন, একটি বড় প্রজেক্টের কাজ যখন নানা ধাপে ভাগ করা হয়—প্রথমে গবেষণা, তারপর পরিকল্পনা এবং শেষে বাস্তবায়ন—তখন কাজটি আমাদের কাছে সহজ মনে হয়। প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হলে আমাদের মধ্যে সাফল্যের একটি অনুভূতি কাজ করে, যা পরবর্তী ধাপের জন্য প্রেরণা জোগায়।
এছাড়া, যে কোনো কাজ করার সময় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা অপরিহার্য। আমাদের জীবনে প্রায়ই অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে করতে হয়, তবে সব কাজের গুরুত্ব সমান নয়। তাই কোন কাজটি আগে করতে হবে, সেটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। একসঙ্গে অনেক কাজ করার চেষ্টায় আমরা প্রায়ই কোনোটিই সঠিকভাবে শেষ করতে পারি না। অগ্রাধিকার অনুযায়ী কাজ করলে আমরা সময় বাঁচাতে পারি এবং মনোযোগও সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি। তাই একটি কাজ সম্পন্ন করার পরই অন্য কাজের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তবে মনোযোগ নষ্ট হওয়ার একটি বড় কারণ হলো বাহ্যিক বিঘ্ন। বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং নানান ধরনের প্রযুক্তি আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজের সময় মোবাইল নোটিফিকেশন বা কল আসা এবং এসব কারণে আমাদের মন বিচ্যুত হয়। তাই কাজের সময় বাইরের জগৎ থেকে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা খুবই কার্যকর হতে পারে। যেমন, কাজের সময় ফোন সাইলেন্টে রাখা বা নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা যেতে পারে।অনেক সময় কাজ শুরুর আগেই আমরা ধরে নিই এটি অনেক কঠিন বা অসম্ভব। সেই নেতিবাচক চিন্তা আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এবং সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
শেষ পর্যন্ত, শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক বিশ্রামও মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যদি শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকি, তাহলে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত ঘুম এবং সঠিক খাদ্য গ্রহণ আমাদের মানসিক এবং শারীরিক শক্তি বজায় রাখে, যা কাজে ফলপ্রসূতা এনে দেয়। কাজের আগের রাতে ভালো ঘুমানো এবং সময়মতো বিরতি নেওয়া সঠিকভাবে কাজ শেষ করার পথে সহায়ক হতে পারে। কোনো কাজ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য মনোযোগ একান্ত প্রয়োজনীয়।
মনোযোগ ধরে রাখার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ, মনের শান্তি, ইতিবাচক মানসিকতা এবং শারীরিক সুস্থতা জরুরি। যখন আমরা আমাদের মনকে প্রস্তুত করতে পারি এবং কাজের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ থাকতে পারি, তখনই সেই কাজের ফলাফল সফলভাবে আসবে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।