প্রতিদিনের ডেস্ক:
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মিফতা জান্নাত। গত বছর সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করেছে সে। যেখানে মুখস্থ করার বিষয় ছিল না, যা করেছে সবই হাতে-কলমে। এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্তও নতুন শিক্ষাক্রমে হাতে-কলমে শিখেছে সে। অন্তর্বর্তী সরকার এসে বাতিল করেছে নতুন শিক্ষাক্রম। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে আগের নিয়মে বার্ষিক পরীক্ষা। হঠাৎ পুরোদমে পড়া মুখস্থ করতে হচ্ছে মিফতার। এতে হিমশিম অবস্থা তার। প্রায় দুই বছরে অভ্যাসগত বড় পরিবর্তন আসায় মুখস্থবিদ্যায় রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে মিফতা।কথা হয় মিফতার মা আঞ্জুমান আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেয়েকে পড়তে বসালেই কান্না করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে পড়লেও পাঁচটা লাইনও মুখস্থ করতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। মেয়েটা আমার মেন্টালি প্রেসারে (মানসিক চাপে) আছে। বছর বছর পড়ালেখায় এমন পরিবর্তন হলে তো আসলেই মুশকিল।’ দুইমাস পরই বার্ষিক পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য যে সিলেবাস নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, তা শিক্ষার্থীদের জন্য শেষ করা কঠিন। পাশাপাশি মুখস্থ করে লেখার অভ্যাসও ভুলে গেছে শিক্ষার্থীরা। ফলে বার্ষিক পরীক্ষা ঘিরে চাপে পড়েছে তারা।শুধু মিফতা নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এমন সমস্যায় পড়েছে। তারা গত দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণ পরীক্ষাবিহীন যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছে, তাতে হঠাৎ পরিবর্তন আসায় মানসিক অবসাদে ভুগছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরাও। তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হওয়ায় অধিকাংশ অভিভাবক একদিকে খুশি। ফলে সাময়িক এ সমস্যা তারা ‘খুব বড়’ করে দেখতে চাইছেন না।
যদিও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সমস্যা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পড়ালেখায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। হঠাৎ বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। তাদের সাবলীলভাবে ধীরে ধীরে আবারও পড়া মুখস্থে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। আমরা একটা সিলেবাস দিয়েছি ঠিক। তবে পরে কিন্তু আবার যারা যেটুকু শেষ করতে পারবে, তার ওপর তুলনামূলক সহজ উপায়ে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছি। তাই বড় কোনো সমস্যা হবে বা শিক্ষার্থীদের ওপর খুব বেশি চাপ পড়বে বলে মনে করছি না।- এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানসন্তানদের এমন মানসিক বিষণ্নতার কারণে চলতি বছর যে বার্ষিক পরীক্ষা হবে, তা তুলনামূলক সহজ করা এবং খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের নমনীয় হওয়ার দাবি তুলেছেন অভিভাবকরা। তাদের দাবি, এবারের পরীক্ষাটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা সেরে পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হোক। বার্ষিক পরীক্ষা ঘিরে ‘চাপে’ শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করায় ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে হবে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। চলতি বছর যে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীরা পেয়েছে, তার একটি অংশ সিলেবাস আকারে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন বের করে পরীক্ষা নেবেন।শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, দুইমাস পরই বার্ষিক পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য যে সিলেবাস নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), তা শিক্ষার্থীদের জন্য শেষ করা কঠিন। পাশাপাশি মুখস্থ করে লেখার অভ্যাসও ভুলে গেছে শিক্ষার্থীরা। ফলে বার্ষিক পরীক্ষা ঘিরে চাপে পড়েছে তারা।এমন একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা উচিত, যা অন্তত ৫-১০ বছরের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারও মাথায় রাখতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এমন দৃষ্টিভঙ্গিমূলক কাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, ফলে বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছি।- অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তাহেরা আক্তার রূপা বলেন, ‘হাতে খুব অল্প সময়। অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। এ সময়ের জন্য যে সিলেবাস দিয়েছে, তা একটু বেশি হয়ে গেছে। কারণ, বাচ্চারা এখন মুখস্থ করতে পারছে না।’
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আওরঙ্গজেব সেলিম বলেন, ‘ওরা (শিক্ষার্থীরা) তো পড়াই ভুলে গেছে। এত সিলেবাস দিলে পড়বে কীভাবে? আর বই এক শিক্ষাক্রমের, প্রশ্ন হবে আরেক শিক্ষাক্রমের। এটাই তো হাস্যকর। আমরা দাবি জানাচ্ছি, কোনো রকমে নামমাত্র পরীক্ষা নিয়ে যাতে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠিয়ে দেওয়া হয়। সামনের বছরের শুরু থেকে ভালো করে পড়াশোনাটা যাতে ওরা করতে পারে।’মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের সহকারী শিক্ষক শামসুজ্জামান মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভিভাবকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই কিন্তু এ বছর শিক্ষাক্রমটা বাতিল করা হয়েছে। এখন সবকিছুই গোঁজামিল হয়ে যাবে। এনসিটিবি ও মাউশির নির্দেশনা মেনে আমরা খুব সহজভাবে শিক্ষার্থীদের একটা টেস্ট (পরীক্ষা) নেবো। আশা করি সমস্যা হবে না।’জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘আমরা একটা সিলেবাস দিয়েছি ঠিক। তবে পরে কিন্তু আবার যারা যেটুকু শেষ করতে পারবে, তার ওপর তুলনামূলক সহজ উপায়ে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছি। তাই আমরা বড় কোনো সমস্যা হবে বা শিক্ষার্থীদের ওপর খুব বেশি চাপ পড়বে বলে মনে করছি না।’স্বাধীনতার পর ৭ দফা শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন ম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাতবার শিক্ষাক্রম বা শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম পাঁচবার ৫-১০ শতাংশ পরিবর্তন বা পরিমার্জন করে মূল থিম ঠিক রাখা হয়েছিল। সবশেষ ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে বড় পরিবর্তন আনা হয়। সেবারের শিক্ষাক্রমটি সৃজনশীল পদ্ধতি নামে পরিচিতি পায়।যদিও ৯ বছরের মাথায় তাতে আবারও পরিবর্তন আনে সরকার। বলা হয়, সৃজনশীল পদ্ধতি আধুনিক ও যুগোপযোগী হলেও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনে আওয়ামী লীগ সরকার। সবশেষ প্রণীত এ শিক্ষাক্রম নিয়ে আগের যে কোনো শিক্ষাপদ্ধতির চেয়েও বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে। এর মূল কারণ ছিল- পরীক্ষা পদ্ধতি বিলোপ করা। শুধু শিখনকালীন ও হাতে-কলমে করা কাজের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন পদ্ধতি করায় শিক্ষাক্রমটি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। একপর্যায়ে তা বাতিলের দাবিতে তুমুল আন্দোলনও করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে কিছুদিনের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়’। এর মধ্যদিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’-এর অবসান ঘটে। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই আবারও ফিরছে সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষা, যাতে কিছুটা হলেও খুশি অভিভাবকরা।সন্তানদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সাময়িক এ স্বস্তি এলেও লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম চান অভিভাবকরা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মারজান আক্তার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছেন দীর্ঘদিন। নিজে একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। আন্দোলনে নামায় তাকে হারাতে হয় চাকরি।মারজান আক্তার বলেন, ‘বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদি এবং লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করাটা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শিক্ষাখাতে যে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা ভালো এবং টেকসই একটি শিক্ষাপদ্ধতি পাবো বলে আশা করছি।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমানও লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা উচিত, যা অন্তত ৫-১০ বছরের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারও মাথায় রাখতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এমন দৃষ্টিভঙ্গিমূলক কাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, ফলে বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছি।’বারবার এমন ব্যর্থতার কারণ কী বলে মনে করেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা উচ্চপ্রত্যাশা নিয়ে শুরু করি। কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হই। প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং উপকরণের অভাব একটি বড় কারণ। তাছাড়া শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবেও শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রত্যাশা ও ফলাফলের মধ্যে ব্যবধান কমাতে পারলে তা সফল হবে।’