সুন্দর সাহা
সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। আজ মহাসপ্তমী পূজা। আজ প্রভাতে মহাসপ্তমীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও ঢাক-ঢোলক-কাঁসর বাজিয়ে কলাবউ স্নান ও আদরিণী উমার স্বপরিবারে তিথি বিহিত পূজা শেষে সপ্তমী বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত মঙ্গলবার বোধন শেষে ষষ্ঠী তিথির সূচনা হয়েছে। গতকাল কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা-অর্চনা হয়েছে। সায়ংকালে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস পর্বও শেষ হয়েছে। আজ মহাসপ্তমী পূজা। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে পূজারম্ভ। পুস্পাঞ্জলি বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে। মধ্যহ্ন প্রসাদ বেলা ১২টায়। এ উপলক্ষে মন্দিরে মন্দিরে আর পূজামণ্ডপে ঢাকের বোল, মন্ত্র ও চন্ডীপাঠ, কাঁসর ঘণ্টা, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে প্রতিটি পূজামণ্ডপ। ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের বন্যা। শুরু হয়েছে অতিথি আপ্যায়ন। উৎসব-আনন্দে মেতে উঠেছে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও তারুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষ। বাহারি পোশাক আর অঙ্গসজ্জায় নিজেদের সাজিয়ে রাঙিয়ে তারা মন্দিরে-মণ্ডপে ভিড় করতে শুরু করেছে। দেবীর আরাধনা উপলক্ষে সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলোকে সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে। উৎসবকে রঙিন করতে আয়োজন করা হয়েছে ভক্তিমূলক গান, আরতিসহ নানা বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানমালার। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অবধি পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ। এ পক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিনে মহালয়ার মাধ্যমেই দেবী দুর্গার আরাধনার সূচনা হয়। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন পূর্ণিমায়। এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরি লক্ষ্মীপূজায় এর সমাপ্তি। দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি চিরায়ত সাংস্কৃতিক উৎসব। শরৎকালে বাংলার প্রতিটি ঘরে, পাড়ায়, মহল¬ায় দুর্গাপূজার আমেজ পরিলক্ষিত হয়। সার্বজনীন এই উৎসবে সকল ধর্ম ও বর্ণের শিশু, যুবা, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ সবাই মেতে উঠেন পরমানন্দে। এই মহান উৎসবটি ধর্মানুরাগী ভক্তদের হৃদয়ে যেমন আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়, তেমনি বাঙালি সর্বসাধারণের মনে-প্রাণে আনন্দ-উল্লাসের অনুভূতি যোগায়। বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও জমজমাট পূজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যশোর জেলার পূজারিরা। সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব পালনে যশোর জেলার ঐতিহ্য সেই বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে। আর তা যদি হয় দুর্গাপূজার মতো সার্বজনীন উৎসব তাহলে তো কথাই নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থানখ্যাত বাংলাদেশ। এখানে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ঈদ-পূজা হয় একই দিনে। তারপরও মনে সংশয় দূরীভূত করতে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ইতিমধ্যে সারা দেশের মত যশোর জেলার মণ্ডপগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার সদস্যের পাশাপাশি পূজা কমিটির নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক টিমও নিরাপত্তার বিষয়ে সক্রিয় রয়েছেন।
এশিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ক্ষেত্র এই বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক মন্দাক্রান্ত জীবনের ছন্দে উৎসবের দুর্লভ সুরের আমেজ ছড়িয়ে সনাতন হিন্দুদের আনন্দময়ী মা শ্রীশ্রী দুর্গা আসছেন বাংলার ঘরে ঘরে। শারদ প্রাকৃতিক মৃন্ময় অঙ্গণে তারই উদাত্ত বাশির সুর। কুমুদ কলহার আর শিউলীর মনোহর হাসিতে ঝরে পড়ছে এক অপূর্ব দীপ্তি। আমাদের দারিদ্র লাঞ্ছিত জীবনে তাই পুলকের জোয়ার। মায়ের আগমনী সুরে সর্বত্র উল্লাসের কলরোল। বৃক্ষশাখে, পুষ্প শোভায়, আকাশে বিক্ষিপ্ত মেঘের আনা-গোনায়, পাখির কলতানে আনন্দ উচ্ছ্বাস। দেশের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক অবস্থাই উৎসবের গতি প্রকৃতি নির্ণয় করে দেয়। বর্তমান বছরেও এ অবস্থা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। রাক্ষসী পানির আগ্রাসী ছোবলের মন্দা হাওয়া আছড়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। গৃহহারা, নিরন্ন ও পানিবন্দি মানুষের পুূজার আনন্দ দৃশত ধুয়ে গেছে বন্যার পানিতে। তারপরও থেমে থাকেনি দেবী দুর্গার আরাধনা প্রস্তুতিতে কোন বিশাদের ছায়া নেই। দুঃখে দৈন্যে হতাশায় অপরাজিত বাংলাদেশীদের হৃদয় এখনও শক্তি দায়িনী মহামায়ার আগমনে আনন্দ উচ্ছ্বাসে নতুন স্বপ্ন দেখে। বাঁচার আনন্দে বিহ্বল হয়ে ওঠে, প্রেরণা পায় নতুন সংগ্রামের প্রতি পদে-পদে, প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলায় ফিরে পায় সাহস। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ এদেশের হিন্দু-মুসলমান একাত্মা হয়ে পূজা এবং ঈদ পালন করে একই সাথে হাজার বছরের সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে। শরৎ হেমন্তের সোনা ঝরা সন্ধিক্ষণে শারদীয় উৎসব সনাতন হিন্দুদের সকল প্রকার ক্ষুদ্রতাকে বিসর্জন দিতে পারে। মনুষ্যত্বে জ্যোতির্ময় শিখা যেন তাদের আলোকিত করে এবং প্রত্যেকের জীবনে সুখ ও সাচ্ছান্দ বয়ে আনে। তাই দেশ ও জাতির মঙ্গল এবং কল্যাণ কামনায় জগৎমাতা শ্রীশ্রী দুর্গা দেবীর আরাধনার আয়োজন করেছে।

