সুন্দর সাহা
বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে মহাঅষ্টমী। আজ মহানবমী পূজা। মহাষ্টমীর মূল আকর্ষণ ছিল কুমারী পূজা। যশোরসহ দেশের সকল রামকৃষ্ণ মিশনসহ বিভিন্ন মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছে কুমারী পূজা। সকল নারীর মধ্যে মাতৃরূপ এই উপলব্ধি সবার মধ্যে জাগ্রত করার জন্যই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সকালে ঢাক-ঢোল বাদ্যসহকারে নানা আচারের মধ্য দিয়ে একজন শিশু কন্যাকে দেবী দুর্গার সামনে বসিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। কুমারী পূজা উপলক্ষে যশোর রামকৃষ্ণ মিশনে ভক্তদের ঢল নামে। ঢাক-ঢোলের বাদ্য নানা আনুষ্ঠানিকতায় ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। মহাঅষ্টমীর দিন পূজা শেষে প্রতি পূজামণ্ডপে ভক্তরা অঞ্জলী দেন। এ সময় তাদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। যশোরে শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাষ্টমীতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যশোরসহ আশপাশের ৯টি জেলা থেকে আগত ভক্তরা এ পূজার আরাধনায় অংশগ্রহণ করেছেন। হিন্দু ধর্ম মতে, কুমারী হচ্ছে শুদ্ধতার প্রতীক। দেবী দুর্গার আরেক নাম কুমারী। এ পূজার মাধ্যমে স্বয়ং মা দুর্গা মানুষের ভেতরে বিকশিত হন। তাই শঙ্খ, ঘণ্টা আর উলু ধ্বনির মধ্য দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গা দেবীকে কুমারী রূপে অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। কুমারীর মধ্যে মাতৃরূপ দর্শন, এ এক প্রাচীন রীতি। কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যেকোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যেকোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়। এদিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। হাতে দেয়া হয় ফুল, কপালে সিঁদুরের তিলক ও পায়ে আলতা। ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের সূত্র মতে, আমরা যে জগতমাতার (দেবী দুর্গা) আরাধনা করি তিনি সকল নারীর মধ্যে মাতৃরূপে আছেন। এ উপলব্ধি সকলের মধ্যে জাগ্রত করার জন্যই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দুর্গা মাতৃভাবের প্রতীক আর কুমারী নারীর প্রতীক। কুমারীর মধ্যে মাতৃভাব প্রতিষ্ঠা এ পূজার মূল লক্ষ্য। কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে, দেবী দুর্গার সামনে বসিয়ে ঠিক যেভাবে তাঁর (দুর্গার) আরাধনা করা হয়, একইভাবে কুমারীকে সে সম্মান প্রদান করা হয়। শুধু মাটির প্রতিমা নয়, নারীর মধ্যেও মাতৃভাব আনা হয়। বিশুদ্ধ স্বভাবের গুণাবলী দেখে একজন নারীকে কুমারী হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। পূজার আগ পর্যন্ত কুমারীর পরিচয় গোপন রাখা হয়।
যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১০টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় কুমারী পূজা। এ বছর শহরের বেজপাড়ার বাসিন্দা ব্যাংকার অতনু চক্রবর্তী ও মা ডেন্টিস্ট ডাক্তার সুদীপা বিশ্বাসের তিন বছরের কন্যা অনাত্রিকা চক্রবর্তীকে শাস্ত্রমতে ‘ত্রিধামূর্তি’ নামে এবার মাতৃদেবী জ্ঞানে পূজিত হয়। কুমারী অনাত্রিকার মাধ্যমে দেবীকে আরাধনা করতে পেরে খুশি রামকৃষ্ণ আশ্রমে আসা ভক্তরা। একই সঙ্গে বিশ্বশান্তি কামনা করেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের মধ্যে বাগেরহাট এবং যশোরে এ কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। ফলে যশোরের পার্শ্ববর্তী ও দূরদূরান্তের জেলাগুলো থেকে অনেক ভক্তরা এসেছেন কুমারী পূজার আরাধনায় অংশগ্রহণ করতে। এসময় ভক্তরা আরাধনা করে বলেন, ত্রিলোক শ্রেষ্ঠা সুন্দরী, উৎকৃষ্ট বর্ণ ধারিণী হে বালিকা তুমি কল্যাণকর, তুমি প্রকাশকারিণী, মনোহর হাস্যযুক্ত, মহানন্দময়ী, মঙ্গলময়ী, পরমানন্দ স্বরূপিণী জগৎ জননী- তোমাকে প্রণাম জানাই। কুমারী পূজা শেষে মাতৃবন্দনায় ভক্তবৃন্দ পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তাদের অর্ঘ্য দেন দুর্গতিনাশিনী শ্রীশ্রী দেবী দুর্গার কমল চরণে। শুদ্ধ দেহে শুদ্ধ মনে ত্রিনয়নী মহাদেবী সর্বজয়া ব্রহ্মচারী, বিশ্বমাতা, সর্বব্যাপিনী সর্ব ঐশ্বর্যময়ী ও সমগ্র জগতের দুঃখহারিণী দশভুজা দেবী দুর্গার আরাধনা করে মহাষ্টমীতে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন তারা। জানা গেছে, খুলনা বিভাগের মধ্যে বাগেরহাটে এবং যশোরে এ কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। ফলে যশোরের পার্শবর্তী ও দূর-দূরান্তের জেলাগুলো থেকে অনেক ভক্তরা এসেছেন কুমারী পূজার আরাধনায় অংশগ্রহণ করতে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগতরা বলেন, ‘কুমারী দেবীর আরাধনা করতে আমরা কয়েকজন ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে যশোরে এসেছি। বিশ্ব জগতের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেছি। আমরা সপরিবারে প্রতিবছর যশোরে কুমারী পূজা করতে আসি। এবছরও এসেছি। যেহেতু অনেক জেলা থেকে প্রতিবছর ভক্তরা আসেন সেহেতু আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা হয় অনেক ভালো লাগছে।’ প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। আজ চামুন্ডা রূপে পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে নবমীপূজা। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয় তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালিন পূজা। দুর্গাপূজায় এই সন্ধিক্ষণের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। সন্ধিক্ষণের পিছনের পৌরাণিক কাহিনীটি অনেকটা এইরকম। দেবী দুর্গা এক অপরূপা সুন্দরী রূপে দুর্দমনীয় মহিষাসুরের সামনে আবির্ভূতা হন। সেই সময় দেবীর গাত্রবর্ণ বা গায়ের রঙ ছিল স্বর্ণাভ বা সোনালী এবং তিনি হলুদ শাড়ি পরে অবতীর্ণ হন। তাঁর দশ হাত সজ্জিত ছিল দশ ধরণের অস্ত্রে। যখন মহিষাসুরের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধে তিনি ব্যস্ত, সেইসময় মহিষাসুরের দুই বন্ধু চন্ড এবং মুন্ড পিছন থেকে দেবীকে আক্রমণ করে। রণনীতির চুক্তি ভঙ্গ হওয়ায় দেবী অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং রাগে তাঁর মুখ নীল হয়ে যায়। দেবী তাঁর ত্রিনয়ন উন্মীলিত করেন এবং চামুন্ডা রূপ ধারণ করেন। ঘনীভূত রক্ত মাখা কালীরও অন্য রূপ হল চামুন্ডা। চামুন্ডা রূপে দেবী দুর্গা চন্ড এবং মুন্ডের মাথা কেটে নেন তাঁর হাতের খড়গ দিয়ে। দেবীর এই চামুন্ডা রূপেরই আরাধনা করা হয় সন্ধিপূজার মাধ্যমে। এই ঘটনাটি মনে রাখার জন্যই প্রতি বছর অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা করা হয়। এই পূজা দূর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এইসময় দেবী দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়। এরপর মহা অষ্টমীর শেষ দণ্ড (২৪ মিনিট) আর মহানবমীর শুরুর প্রথম দণ্ডে (২৪ মিনিট) ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে অসুর শক্তি বিনাশে খড়্গ দিয়ে চালকুমড়ো, পাকা কলা ও আখ গাছকে ‘প্রতীকী বলি’ কার্যকর করা হয়। যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনে এ বলি কার্যক্রমে অংশ নেয় বিদ্যার্থী ভবনের শিক্ষার্থীবৃন্দ। পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেন প্রণয় চক্রবর্তী। তন্ত্রধারী পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন শক্তিপদ গাঙ্গুলি। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ মহারাজ ও সহ অধ্যক্ষ আত্মবিভানন্দ মহারাজ। আজ নবমী পূজা আরম্ভ সকাল ৬টা ১০ মিনিটে। পুস্পাঞ্জলি বেলা সাড়ে ১১টায়। নবমী তিথিতে দুর্গা দেবীর কেবল মহানবমী কল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্তা। মূলত মহানবমীই পূজার শেষ দিন। তাই মণ্ডপে মণ্ডপে বাজছে ঢাক, সঙ্গে কাঁসর ঘণ্টা। এ পূজা মহিষাসুর নিধনের সময় দেবী দুর্গা প্রচন্ড ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ ধারন করেছিলেন। তাই পূজার এই আচারের সময় দেবী চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়। অর্থাৎ যিনি চন্ড মুন্ডের বিনাশিনী। পূজার এ মুহুর্তটি আরও একটি কারনে স্মরনীয় কারন দেবী দূর্গার আশির্বাদ নিয়ে শ্রী রামচন্দ্র এই মুহুর্তটিতেই রাবনকে বধ করেছিলেন।