মর্তুজা হাসান সৈকত
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশ হচ্ছে ঠিক তার উল্টোটি। কাঁচাবাজার থেকে মাছের বাজার— নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলে যাদের আয় সীমিত এবং যারা নির্দিষ্ট বেতনের ওপর নির্ভরশীল, তারা ভয়াবহ চাপে পড়েছে। কারণ, সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও তাদের আয় সেভাবে বাড়েনি। গণমাধ্যমে খবর এসেছে এই অবস্থায় অনেকেই সবজি কেনার ক্ষেত্রে কেজি থেকে নেমেছেন গ্রামে। আগে যারা কেজিতে কিনতেন এখন ২৫০ বা ৫০০ গ্রাম ওজনে কিনছেন। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ চাপ সামাল দিতে ইদানীং টিসিবির লাইনে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষকেও দেখা যাচ্ছে।
এ সম্পর্কে জাগো নিউজে ৯ অক্টোবর প্রকাশিত ‘সেই সিন্ডিকেটের কবলেই বাজার, দ্রব্যমূল্যে দিশাহারা’ শিরোনামের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে— ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। পণ্যের দাম মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলের সেই সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো আলামতও মেলেনি এখনো। এরই মধ্যে ডিম-মুরগির সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। সরকারের অগ্রাধিকারে থাকলেও বাজারব্যবস্থায় এখনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি।’
দ্রব্যমূল্যের এই অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির বিষয়ে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের জনগণের ত্যাগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’ এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার।
মহামারি করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত দুই-আড়াই বছর ধরে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন গতিতে বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছায় যে, বাজার ব্যবস্থার যে একটি স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন, সেটা ভেঙে পড়ে। ওই সময়ে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের শেষ মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ বছরে সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়ে ১৪ দশমিক ১ শতাংশে ঠেকে। একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দাম কমানোসহ বাজার মনিটরের ব্যবস্থা নতুন করে করা হয়। তবে এর সুফলও পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জানিয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে এসেছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও দুই অঙ্কের ঘরেই আছে। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে ঠেকেছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে— নিত্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের সামগ্রীর মূল্য বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়ে ক্রয়সীমার বাইরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম কমেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জন জোট (পিপলস অ্যালায়েন্স) নামের একটি সংগঠন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংগঠনটির জাতীয় সম্মেলনে এই দাবি তুলে ধরা হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য কমাতে শুল্ক ও কাস্টম ডিউটি যৌক্তিককরণসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অন্য সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে— বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ও এলসি খোলার ‘অ্যাড কনফার্মেশন’, ফি হ্রাস এবং ব্যবসায়ীদের একক ঋণসীমা বৃদ্ধি। এছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহমুখী শিল্পে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেগুলো কার্যকর করতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আমিষের জোগানের বড় উৎস আসে ডিম, সোনালি ও ব্রয়লার মুরগি থেকে। কিছুদিন আগে পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ে এই তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দামে এই তিন পণ্য কোথাও বিক্রি হয়নি। প্রতি ডজন ডিম নির্ধারিত দামের চাইতে ১৮-২৩ টাকা হয়েছে এতদিন। ভারত থেকে ডিম আমদানির কারণে ডিমের বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও সোনালি ও ব্রয়লার মুরগি এখনও ১৫-২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, এগুলোও এখন নাগালের বাইরে। যেসব পরিবার আগে সপ্তাহে দু-তিনদিন ডিম-মাছ-মাংস খেত, খরচ কমিয়েও কুলিয়ে উঠতে না পেরে তারা এখন আগের চাইতে কম খাচ্ছে। খাবারের মেন্যু থেকে অনেক কিছু বাদও দিতে হচ্ছে অনেকের। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য দু-তিন টেবিল চামচ তেল, ২৭০-৪৫০ গ্রাম চাল ও আটা, ৪০০-৬০০ গ্রাম মিশ্র শাক-সবজি, ২৫০-৩৫০ গ্রাম মাছ, মাংস এবং ডিম খেতে হয়। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ বর্তমানে এ খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষ এখন দুই ধরনের পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে। প্রথমত অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা, দ্বিতীয়ত খাদ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগজনিত পুষ্টিহীনতা।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বেশির ভাগ সময় সিন্ডিকেটের দিকে আঙুল তোলা হয়। বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাব দেশে না পড়ার কারণও এই সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে, অনেক সময় সরকারও কিছু করতে পারে না। আমাদের দেশে তেল, চিনি, গম, পেঁয়াজ, ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্য হাতেগোনা অল্প কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আমদানি করে। এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো অনেক সময়ই আইনের বিধি-বিধান অবজ্ঞা করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এক হয়ে পণ্যের উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা করতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলে। তাছাড়া, অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্যও লাগামহীনভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের উৎপাদন, মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন।
তাছাড়া যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, ভরা মৌসুমে সেসব পণ্যের বাজারেও তৈরি করা হয় অস্থিরতা। যেমন আমাদের দেশে চালের ঘাটতি নেই। চাহিদার চেয়ে ধানের উৎপাদন বেশি। ফলে ইচ্ছে করলে আমরা কিছু চাল রপ্তানিও করতে পারি। অথচ কয়েক বছর ধরে চালের দাম বেড়েই চলছে। সরকার নানা কৌশল অবলম্বন করলেও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা করতে পারেনি। সম্প্রতি তো আরও বেড়েছে। এর কারণ হচ্ছে, মিল মালিকরা বেশি দামে ধান কেনার অজুহাত উপস্থাপন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বেশি দামে চাল বিক্রির পরও তারা কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য দিচ্ছেন না। তাহলে মূল্য বাড়ছে কোন্ জায়গায় এটা তো বোঝাই যায়। এসব কারণে শ্রীলংকার মতো অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হওয়া দেশটিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও, আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।
তাই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া বাগে আনতে আমদানি করা পণ্যের সিন্ডিকেট শুরুতেই ভাঙতে হবে। ভাঙতে হবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের সিন্ডিকেটও। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বাজারে সংকট শুরুর আগেই নিতে হবে ব্যবস্থা। তাছাড়া, রাস্তায় অবৈধ টোল ও চাঁদাবাজি বন্ধে আইনগতভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও শোনা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। তবে তা আবার শুরু হয় কি না,সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না, চাঁদা নেওয়ার হাত বদলায় মাত্র। এই অবৈধ টোল ও চাঁদাবাজির কারণেও পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
এ ছাড়া জ্বালানি খাতে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে দ্রব্যমূল্য কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে সরকার। কারণ, জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এজন্যই জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধিসহ অন্য ক্ষেত্রেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের খরচ বেড়ে যায়। জ্বালানির খরচ বাড়া মানে কৃষকের সেচের খরচও বাড়া। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই অতিরিক্ত খরচ উৎপাদিত শস্যের ওপরই পড়ে। তাই সরকারকে জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। তাছাড়া কম দামে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির মাধ্যমেও দাম কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা আমাদের প্রয়োজনের প্রায় ৮০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিশোধন করে অধিক মূল্যে আমদানি করি।
সর্বোপরি বলতে চাই, এ সর্বগ্রাসী সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, ভোক্তা অধিকারের কার্যক্রম বৃদ্ধিসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারকে জোর দিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী অসৎ ও অনৈতিকভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়াচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার মাধ্যমে শুধু তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় নয়, ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থাও নিতে হবে। এ কাজগুলো করা গেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগামহীন ঘোড়া দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।