সাইফুল হোসেন
প্রতি বছর বাংলাদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। তারা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও প্রায়শই দেখা যায়, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রত্যাশিত সফলতা অর্জন করতে পারছেন না। কেন এই ব্যর্থতা? কারণ, তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্কিল ও বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষাজীবন পার করেন, যা চাকরির বাজারে প্রবেশের পরে তাদের বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯৯ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্কিল জানেন না, যা তাদের সফল ক্যারিয়ারের জন্য অপরিহার্য। এই নিবন্ধে সেই ৭টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের অবশ্যই জানতে ও শিখতে হবে।
১. পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট:
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিগত অর্থ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় না। অনেক গ্র্যাজুয়েট ফাইন্যান্সের মতো বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তা মূলত কর্পোরেট অর্থ ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। ফলে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের কোনো ধারণা থাকে না। ‘ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডুকেশন’র (NEFE) এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী সঠিকভাবে পার্সোনাল ফাইন্যান্স পরিচালনা করতে অক্ষম, যা তাদের আর্থিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। তাই গ্র্যাজুয়েটদের অর্থ ব্যবস্থাপনার দিকটি গুরুত্ব সহকারে শেখা দরকার, যাতে তারা ভবিষ্যতে নিজেদের আর্থিক জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে।
গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্কিলের অভাবে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ইন্টারপার্সোনাল স্কিলস, টাইম ম্যানেজমেন্ট থেকে নেটওয়ার্কিং, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের এখনই এ বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারে এবং নিজের জীবন আরও অর্থবহ করতে পারে।
২. ক্যারিয়ার এবং চাকরির বাজারের বাস্তবতা:
বেশিরভাগ গ্র্যাজুয়েট তাদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। তারা জানে না কোন ক্ষেত্র তাদের জন্য উপযুক্ত বা কোন ধরনের স্কিল তাদের উন্নতির পথে সহায়ক হবে। ‘হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ’র একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ তাদের ক্যারিয়ারের পথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না, যা ভবিষ্যতে তাদের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়। এছাড়াও চাকরির বাজারের বাস্তবতা নিয়ে তাদের খুব কম ধারণা থাকে, ফলে তারা চাকরি পেতে প্রচুর সমস্যায় পড়ে। তাই, শিক্ষাজীবনের শেষ দিকে এসে চাকরির বাজার সম্পর্কে গবেষণা করা এবং নিজেদের দক্ষতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
৩. ইন্টারপার্সোনাল স্কিলস:
চাকরির বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় স্কিলগুলোর মধ্যে একটি হলো ইন্টারপার্সোনাল বা আন্তঃব্যক্তিক স্কিল। এর মধ্যে রয়েছে এফেক্টিভ কমিউনিকেশন, টিম ওয়ার্ক, কনফ্লিক্ট রেজোলিউশন ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে এ ধরনের স্কিলের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ এর ২০২০ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্পোরেট জগতে প্রায় ৮৫ শতাংশ সফলতা ইন্টারপার্সোনাল স্কিলের ওপর নির্ভর করে। এর অভাবে গ্র্যাজুয়েটরা কর্মক্ষেত্রে কমিউনিকেশন, টিম ওয়ার্ক, ও চাপ সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তাই, শিক্ষাজীবনের সময় থেকেই এই স্কিলগুলো অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি।
৪. নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করার দক্ষতা:
নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা প্রতিটি পেশাজীবী মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক গ্র্যাজুয়েট চাকরির ইন্টারভিউ বা অন্য আনুষ্ঠানিকতায় সঠিকভাবে নিজেদের স্কিল এবং ক্ষমতাগুলো তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ চাকরিপ্রার্থী ইন্টারভিউতে নিজেদের দক্ষতাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। ফলে তারা চাকরির সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। তাই, শিক্ষাজীবনের সময় থেকেই প্রেজেন্টেশন স্কিল এবং নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করার কৌশল শেখা জরুরি।
৫. সঠিক স্কিল ডেভেলপমেন্টের ঘাটতি:
জীবনে সফল হতে হলে অনেক ধরনের স্কিলের প্রয়োজন হয়। তবে শিক্ষার্থীরা সাধারণত একাডেমিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থেকে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্কিল ডেভেলপ করার দিকে নজর দেয় না। এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), কম্পিউটার লিটারেসি, নেটওয়ার্কিং, নেগোসিয়েশন স্কিল, রাইটিং এবিলিটি ইত্যাদি স্কিল কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে এই স্কিলগুলোর অভাব প্রকট। ‘ম্যাকিনসে অ্যান্ড কোম্পানি’র গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ৮৭ শতাংশ চাকরিদাতা চান তাদের কর্মীরা টেকনোলজিক্যাল স্কিল এবং সফট স্কিলস উভয়ের মধ্যে দক্ষ হোক। তাই গ্র্যাজুয়েটদের এই ধরনের স্কিল অর্জনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
৬. নেটওয়ার্কিংয়ের অভাব:
একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে: “Your network is your net worth”। ভালো নেটওয়ার্ক থাকা মানে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। বেশিরভাগ গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে নেটওয়ার্কিংয়ের ঘাটতি দেখা যায়। ‘ফোর্বস’র ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ চাকরির সুযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আসে। তাই, শিক্ষাজীবন থেকেই নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারলে চাকরি পেতে এবং ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে তা সহায়ক হবে।
৭. টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং প্রোডাক্টিভিটি:
সবার জন্য দিনে ২৪ ঘণ্টা সমান। কিন্তু সময়ের সঠিক ব্যবহারে অনেকেই পিছিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ গ্র্যাজুয়েট সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষ না হওয়ার কারণে তাদের প্রোডাক্টিভিটি কম থাকে। ‘ন্যাশনাল টাইম ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ চাকরিদাতা তাদের কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য সময় ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দিতে চায়। তাই শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতাটি শিখতে হবে এবং নিজেদের সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্কিলের অভাবে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ইন্টারপার্সোনাল স্কিলস, টাইম ম্যানেজমেন্ট থেকে নেটওয়ার্কিং, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের এখনই এ বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারে এবং নিজের জীবনকে আরও অর্থবহ করতে পারে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।