সাইফুল হোসেন
সকালের সময়টিকে প্রায়ই দিন শুরুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে ধরা হয়। কারণ, দিনের শুরুটাই ঠিক করে দিতে পারে বাকিটা সময় কীভাবে কাটবে। কথায় বলে, “মর্নিং শো দ্য ডে” — অর্থাৎ, সকাল যেমন কাটবে, দিনটিও তেমনই যাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অতি ধনী ও সফল ব্যক্তিদের সকালের রুটিন গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষার উৎস। কারণ তাদের প্রতিদিনের সকালটি ইফেক্টিভভাবে ব্যবহার করার অভ্যাসই তাদের সাফল্যের একটি বড় কারণ। আমরা সকালের মূল্য বুঝি না বলে অনেক সময় আমাদের প্রোডাক্টিভিটি কমে যায় এবং দিনটি সফলতার পথে পরিচালিত হয় না। অন্যদিকে, অতি ধনী ব্যক্তিরা দিনের প্রথম কয়েক ঘন্টা কীভাবে কাটাবেন, তা নিয়ে বেশ সতর্ক থাকেন।আজকের নিবন্ধে আমরা দেখব, বিশ্বব্যাপী সফল ব্যক্তিরা কীভাবে তাদের সকালকে পরিকল্পনা করেন এবং কীভাবে এই পরিকল্পনাগুলো আমাদের জীবনেও প্রযোজ্য হতে পারে।
ইলন মাস্কের সকালের রুটিন: কাজই প্রধান লক্ষ্য
ইলন মাস্ক, বিশ্বের অন্যতম ধনী এবং পরিশ্রমী ব্যক্তি, যার নাম প্রযুক্তির জগতে সবচেয়ে উচ্চারিত। তিনি সপ্তাহে প্রায় ১২০ ঘণ্টা কাজ করেন। ইলন মাস্কের সকাল শুরু হয় খুব তাড়াতাড়ি। তিনি প্রায় সকাল ৭টায় ঘুম থেকে ওঠেন এবং কাজ শুরু করেন। তার প্রাত্যহিক রুটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ইমেইল চেক করা। ইলন সকালে নাস্তা করতে পছন্দ করেন না, কারণ তার কাছে কাজই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। তবে, কাজের ফাঁকে এক কাপ কফি খেয়ে ইমেইলগুলোর উত্তর দেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলো সেরে নেন।
অতি ধনী ব্যক্তিরা তাদের সকালের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে কাজে লাগান। সকালে তাড়াতাড়ি উঠা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া, এবং কাজের জন্য মনোযোগী হওয়া তাদের সাফল্যের অন্যতম মূল কারণ। আপনি যদি আপনার সকালের সময়কে আরও ইফেক্টিভভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তবে আপনার কর্মক্ষমতা এবং সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।
বেশিরভাগ ধনী ব্যক্তির মতোই ইলন মাস্কও তার সকালের একটি নির্দিষ্ট সময় পরিবারের জন্য রাখেন। তিনি তার পাঁচ ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেন এবং এরপরই নিজের কর্মস্থলে চলে যান। তার সকালের এই নির্দিষ্ট রুটিন তাকে দিনের বাকি সময় আরো বেশি মনোযোগী ও কার্যকর করে তোলে।
ওয়ারেন বাফেটের সকালের রুটিন: ঘুম এবং পড়াশোনার সঠিক মিশ্রণ
অর্থনীতির বিশ্বে একক শক্তি হিসেবে পরিচিত ওয়ারেন বাফেট তার দিনে ঘুমকে প্রায়োরিটি দেন। প্রতি রাতে প্রায় আট ঘণ্টা ঘুমানোর পরও তিনি সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন, প্রায় ৬:৪৫টায়। তার দিন শুরু হয় পড়াশোনা দিয়ে, যা তার জীবনের একটি প্রধান অভ্যাস। তিনি প্রতিদিন কয়েকটি পত্রিকা, যেমন Wall Street Journal, USA Today পড়েন।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পড়াশোনার অভ্যাস ধনী ব্যক্তিদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ এর মতে, ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৮% নিয়মিতভাবে পড়াশোনা করেন। ওয়ারেন বাফেটের সকাল এমনভাবে সাজানো যে তার দিনটি যেমন জ্ঞানের আলোতে ভরে ওঠে, তেমনই কাজের জন্য মনোযোগী হয়।
জেফ বেজোসের সকালের রুটিন: ঘুম এবং পরিবারকে গুরুত্ব
আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, ঘুম এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানোর দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তার দিন শুরু হয় প্রায় ৬:৩০টায় এবং তিনি কোনো অ্যালার্ম ছাড়া স্বাভাবিকভাবে ঘুম থেকে ওঠেন। তার সকালের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে থাকে উচ্চমানসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করা। বেজোস বিশ্বাস করেন যে সকালের সময় তার মস্তিষ্ক সবচেয়ে কার্যকর থাকে, তাই তিনি এই সময়টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বরাদ্দ করেন।
অতিরিক্ত ধনীদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সকালে মস্তিষ্ক ঠান্ডা থাকা অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারেন। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর গবেষণা অনুযায়ী, সকালের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বিকেলের তুলনায় প্রায় ২০% বেশি থাকে, যা কাজের মান বাড়াতে সহায়ক।
মার্ক জাকারবার্গের সকালের রুটিন: প্রযুক্তি এবং ফিটনেসের মিশ্রণ
মার্ক জাকারবার্গ, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা, প্রায় সকাল ৮টায় ঘুম থেকে ওঠেন এবং তার দিন শুরু করেন ফেসবুক এবং মেসেঞ্জার চেক করার মাধ্যমে। তিনি প্রথমেই সারা বিশ্বের ঘটনাগুলো সম্পর্কে আপডেট হন, যা তার কোম্পানির দিকনির্দেশনায় সহায়ক হয়। তবে, জাকারবার্গের সকালের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে ফিটনেস। তিনি প্রতিদিন সকালে ব্যায়াম করেন, যা তার শরীর এবং মনকে দিনের জন্য প্রস্তুত করে।
ব্যায়াম এবং শারীরিক সক্রিয়তা ধনী ব্যক্তিদের একটি সাধারণ অভ্যাস। ‘মায়ো ক্লিনিক’ এর গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, যা মনকে সতেজ রাখে এবং স্ট্রেস কমায়।
বিল গেটসের দিনের শুরু হয় প্রায় এক ঘণ্টা শরীরচর্চার মাধ্যমে। তিনি তার ট্রেডমিলে সময় কাটান এবং একই সময়ে শিক্ষামূলক ভিডিও দেখেন, যা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্রিয় রাখে। এরপর তার সকালের নাস্তা হয় সাধারণ, তবে তিনি অনেক সময় সকালে নাস্তা করেন না।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ধনী ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের শরীরের যত্ন নেন এবং প্রতিদিন কিছুটা সময় শারীরিক ফিটনেসের জন্য রাখেন। ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি’ এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়মিত শরীরচর্চা মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ কমায়।
সকালের সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার: ধনী ব্যক্তিদের থেকে শিক্ষা
উপরোক্ত ব্যক্তিদের সকালের রুটিন থেকে কিছু সাধারণ বিষয় উঠে আসে যা আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে:
তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা: বেশিরভাগ ধনী ব্যক্তি খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, কারণ তারা জানেন সকালের প্রথম কয়েক ঘণ্টা অত্যন্ত প্রোডাক্টিভ হতে পারে। শারীরিক এবং মানসিক ফিটনেসের গুরুত্ব: সকালের সময় শরীরচর্চা এবং মানসিক ফিটনেসের দিকে মনোযোগ দিলে পুরো দিনটি অনেক বেশি সফল হয়। পরিবারের জন্য সময় রাখা: ধনী ব্যক্তিরা সকালে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর গুরুত্ব বোঝেন এবং প্রায়শই এই সময়টাকে পরিবারের জন্য বরাদ্দ রাখেন।
কাজের আগেই নিজেকে প্রস্তুত করা: ধনী ব্যক্তিরা সকালে উঠে প্রথমেই পেশাগত কাজে মন দেন না, বরং তারা নিজেদের প্রস্তুত করেন — তা পড়াশোনা হোক, মেডিটেশন হোক, বা শরীরচর্চা।
অতি ধনী ব্যক্তিরা তাদের সকালের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে কাজে লাগান। সকালে তাড়াতাড়ি উঠা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া, এবং কাজের জন্য মনোযোগী হওয়া তাদের সাফল্যের অন্যতম মূল কারণ। আপনি যদি আপনার সকালের সময়কে আরও ইফেক্টিভভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তবে আপনার কর্মক্ষমতা এবং সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।
সকালের শুরুটা সুন্দর হলে দিনটা আরও সফল হতে বাধ্য।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।