২রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ  । ১৬ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

মোংলা বন্দরের দোর্দন্ড প্রভাবশালী সিবিএ-র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফিরোজের সিবিএ ভবন দখল

এনামুল কবির, মোংলা
মোংলা বন্দরের দোর্দন্ড প্রভাবশালী সিবিএ’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান জুনিয়র অফিসার মোঃ ফিরোজের (আইসি নং ২৫৮৮) বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে সিবিএ ভবন দখল করে তালা দেওয়াসহ চাকুরী শৃংখলা পরিপন্থি কর্মকান্ডের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ দীর্ঘ ১ মাসেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। যা নিয়ে ইতিমধ্যে নানা রহস্য ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সিবিএ’র সাবেক নেতা ফিরোজের বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত কোন শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বন্দরের সাধারণ শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। অপরদিকে প্রভাবশালী ফিরোজ নিজেকে বাঁচাতে এখন মুল ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে বন্দর ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে ধর্ণা দিয়ে বিভিন্ন তদ্বির ও দেন দরবার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও ভূক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে মোঃ ফিরোজ চাকরিতে যোগদান করার পরের বছর সিবিএতে কার্যকরী সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ধাপে ধাপে তিনি সহ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, অতিরিক্ত সম্পাদক থেকে সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর মাঝে নির্বাচনে অবশ্য তিনি কয়েকবার হেরেও যান। সর্বশেষ তিনি ২০১৯ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ২০২১ সালের নির্বাচনে একই পদে হেরে যান। এখন আবার নতুন নির্বাচনের ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তিনি অংশ নিয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ফিরোজ চাকরির প্রথম দিকে সিবিএ নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতা ও চাকুরি শৃংখলা পরিপন্থি কর্মকান্ড ক্রমেই বাড়তে থাকে। সিবিএ নেতা নির্বাচিত হওয়ার কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি তার পদের প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলী, অবসরে যাওয়া ব্যক্তিদের ফাইলসহ বিভিন্ন কাজের তদ্বিরের নামে দুহাতে কামিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। সামান্য এলডিএ কাম টাইপিস্ট পদে চাকরিতে যোগদান করে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি এখন নামে বেনামে শত শত কোটি টাকার মালিক। নিজ ভায়রার নামে বন্দরের হিরণ পয়েন্টসহ বিভিন্ন নৌপথে ড্রেজিংয়ের নামে কারচুপি করে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। তৈরী করেছেন নিজ ও স্বজনদের নামে একাধিক আলিশান বাড়ি সম্পদ ও কিনেছেন গাড়ি। ব্যক্তিগত এ গাড়িতে আবার বেআইনীভাবে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের লোগো লাগিয়ে অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে খাটাচ্ছেন নানা প্রভাব প্রতিপত্তি। ক্ষমতার মোহে তিনি প্রথমে করেছেন বিএনপি। এরপর বিএনপি ক্ষমতা হারালে নতুন করে যোগ দেয় আওয়ামী লীগে আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ যোগদান করায় তার প্রভাব প্রতিপত্তি কয়েকগুন বেড়ে যায়। একই সাথে সিবিএ ও রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে নামে বেনামে বন্দরের বিভিন্ন ঠিকাদারী কাজ করতে থাকেন। এ সময় পুরো বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী তার ক্ষণমতার কাছে ভয়ে তটস্থ থাকতেন। নিজে একাই করতেন পুরো বন্দরের নিয়ন্ত্রণ। এ সময়ে তার বিরুদ্ধে অন্তত ৪/৫টি চাকরির আচরন বিধি লংঘন ও শৃংখলা ভঙ্গেও অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত সেসব অভিযোগে থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ আমলেই তিনি কর্মচারী থেকে কর্মচারী থেকে কর্মকর্তায় পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। এর আগে বহুবার ফিরোজের বিরুদ্ধে সিবিএ থেকে শুরু করে বন্দরের ভূক্তভোগী বিভিন্ন ব্যক্তি সরকারের বিভিন্ন মহলে নানা অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পায়নি। উল্টো অভিযোগ দেওয়ার কারণে সংশ্লিষ্টদের ফিরোজের হাতে নানাভাবে হয়রানী ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে মোঃ ফিরোজ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতা ও চাকুরি শৃংখলা পরিপন্থি কর্মকান্ডে নিজের জড়িতের কথা অস্বীকার করে দাবি করেছেন, তিনি বৈধভাবে ধন সম্পদ বানিয়েছেন। প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে এ নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদিকে সর্বশেষ জুনিয়র অফিসার হিসেবে ফিরোজ পদোন্নতি নিলেও তার সিবিএ নেতা হওয়ার খায়েশ কমেনি। সে কর্মচারী থেকে কর্মকর্তায় পদোন্নতি নিয়ে পুনরায় সিবিএ নেতা হওয়ার জন্য জোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। হন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। যদিও শেষ পর্যন্ত ফিরোজের কর্মকর্তা হয়ে সিবিএ নির্বাচনে অংশ নেওয়াসহ কয়েকটি কারণে মামলা হলে সে নির্বাচন আদালতের আদেশে বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ফিরোজ সর্বশেষ এখন বিএনপিতে যোগদানের জন্য জোর লবিং গ্রুপিং চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। যদিও বিএনপি এখনও তাকে পুরোপুরিভাবে তাদের দলে ভেড়ানোর সবুজ সংকেত দেননি। অপরদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিবিএ সূত্র জানায়, এদিকে সিবিএ নির্বাচনের অসন্তোষকে পুঁজি করে সিবিএর এই সাবেক নেতা ও বর্তমান জুনিয়র অফিসার মোঃ ফিরোজ গত ৭ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০ টায় দলবল নিয়ে জোর করে সিবিএ অফিসে অবৈধভাবে একটি সভা করে বর্তমান নেতৃবৃন্দকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে অফিসের কম্পিউটার রুমে তালা মারাসহ মূল্যবান নথি ও প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সরিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে তার নেতৃত্বে সিবিএ ভবন দখলের চেষ্টা চালানো হয়। পরে বন্দরের নিরাপত্তা কর্মী ও আইন শৃংখলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে সে সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরবর্তিতে জুনিয়র অফিসার ফিরোজকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না সে বিষয়ে গত ১৫ অক্টোবর মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ নুরুজ্জামান সাত কার্য দিবসের মধ্যে জবাব চেয়ে শোকজ করেন। পাশাপাশি পুরো বিষয়গুলো নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়কে অবহিত করেন। পরবর্তিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে গত ৩ নভেম্বর মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে উপ সচিব এইচ এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে মোঃ ফিরোজের বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে সিবিএ অফিস দখল করে তালা দেওয়াসহ চাকুরী শৃংখলা পরিপন্থি কর্মকান্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করায় বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৬ নভেম্বর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পৌঁছায়। এদিকে রহস্যের ব্যাপার, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা জারীর প্রায় মাসের কাছাকাছি হতে চললেও এখন পর্যন্ত তা আদেশ কার্যকরী করা হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা রহস্য ও প্রশ্নের সৃষি¦ট হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জুনিয়র অফিসার ফিরোজ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশ যেন বাস্তবায়িত না হয় সে জন্য বন্দরের শীর্ষ মহলে নানা দেনদরবার ও তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মুল ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে যেভাবে হোক নৌ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা ধামাচাপা দিয়ে নিজেকে রেহাই দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। জুনিয়র অফিসার মোঃ ফিরোজ এ ব্যাপারে বলেন, তিনি গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী এডহক কমিটি গঠন করে সিবিএ ভবনে সভা করেছেন। তবে সেখানে কোন বিশৃংখলা পরিবেশ সৃষ্টি করেননি। প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। এ ব্যাপারে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ নুরুজ্জামানের দৃষ্টি আবর্ষণ করা হলে তিনি মোঃ ফিরোজের বিষয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। বিধি অনুযায়ী এ সংক্রান্ত অফিসিয়াল প্রক্রিয়া চলছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহীন রহমান বলেন, এ সংক্রান্ত ফাইলটি তার দপ্তরে রয়েছে। খুব দ্রুত সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়