কয়রা সংবাদদাতা॥
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হরিণের। সোনালি থেকে লালচে বাদামি দেহের ওপর ছোপ ছোপ গোলাকার সাদা ফোঁটা থাকে। যার কারণে এ হরিণের নাম দেওয়া হয়েছে চিত্রা হরিণ। সুন্দরবনে পর্যটন স্পটে এখন হরহামেশাই হরিণ দেখতে পান পর্যটকেরা। মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকানোর চেষ্টা করে লাজুক এ প্রাণী। তবে দিন দিন সুন্দরবনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিকারি চক্রের সদস্যরা। একের পর এক নিধন করা হচ্ছে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী। ফাঁদ পেতে, বিষটোপ দিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে এসব বন্যপ্রাণী। ,এসব বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে তাৎক্ষণিক শাস্তিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় হরিণের প্রতি কেজি মাংস ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা দাম নেওয়া হয়। গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এ বন্য প্রাণীর মাংসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। স্থান ভেদে চড়া দামেও হরিণের মাংস বিক্রি করছে চোরা শিকারিরা। পার্শ্ববর্তী উপজেলা, জেলা ও ঢাকাতে রয়েছে হরিণের মাংসের বিশেষ কদর। এ সুযোগে সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রায় শিকারি চক্রের দৌরাত্ম্য উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এদিকে, হরিণ শিকার বন্ধে তথ্য প্রদানকারীকে বনের ভেতরের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং বনের বাইরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছে বন বিভাগ। বনে শিকার বন্ধ এবং শিকারিদের ধরতে ১১ পরিকল্পনা নিয়ে বন বিভাগ অভিযান শুরু করেছে। বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের অভিযোগ, শিকারিদের গডফাদার রয়েছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে। শিকারিরা অনেক সময় জেলের বেশ ধারণ করে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে। তাদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্রেট্রোল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না। তারা জানান, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনো তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। শিকারি চক্রের কাছ থেকে অর্থ, হরিণের মাংসসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, অসাধু পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরাও। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড এবং সুন্দরবন বিভাগ,গত বছরের জানুয়ারি মাস হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে শিকার করা ৬টি হরিণের মাথা, একটি গুঁইসাপ, ৮টি হরিণের চামড়া, ৪৮০ কেজি মাংস, ৩৮০টি হরিণ মারার ফাঁদ জব্দ করা হয়। আটক করা হয় ১৫ জন চোরা শিকারিকে। বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা এ বন্যপ্রাণী শিকারিদের আটক করা হয়। গত বছর বন্যপ্রাণী আইনে কয়রায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ১২টি মামলা হরিণ শিকার ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে, যা বর্তমানে চলমান আছে। সর্বশেষ গত বুধবার (২২ জানুয়ারি) রাতে সুন্দরবনের সত্যপীরের খাল এলাকা থেকে ৮০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে বন বিভাগ। এর আগে গত ৩ জানুয়ারি ৩৪ কেজি হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কয়রা থানা পুলিশ। এসব বিষয়ে পৃথক দুইটি মামলা হয়েছে। আটক করা হয় ১ জনকে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে।