কয়রা সংবাদদাতা॥
বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন সংরক্ষিত নদী-খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরার অভিযোগ উঠেছে। অসাধু বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের নৌকাপ্রতি ‘উৎকোচ’ দিয়ে অভয়ারণ্যে অবাধে মাছ ও কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রেখেছেন এক শ্রেণীর জেলে। অল্প সময়ে বেশি মাছের আশায় ‘বিষ’ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও বন্ধ হচ্ছে না এ অবৈধ উপায়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার। আবার যারা ধরা পড়ছেন তথ্যপ্রমাণের অভাবে তারাও সুন্দরবনের প্রভাবশালী কম্পানি-মহাজনদের সহায়তায় দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে ফিরছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে বলেন, ‘সুন্দরবনের অন্য সব খালের চেয়ে অভয়ারণ্যের খালে বেশি মাছ থাকে। এসব এলাকায় মাছ ধরার সুযোগ করে দিতে প্রতি গোন নৌকাপ্রতি ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় বন বিভাগসংশ্লিষ্ট খালের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের।’ সুন্দরবনের প্রভাবশালী কম্পানি-মহাজন এবং এক শ্রেণীর ডিপো মালিক ও আড়তদাররা জেলেদের অগ্রিম টাকা দাদন দেন।
তারাই বন কর্মকর্তা ও রক্ষীদের উৎকোচের মাধ্যমে ‘ম্যানেজ’ করে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ-কাঁকড়া শিকারের সুযোগ করে দেন। কয়েকজন বনজীবীর অভিযোগ, সুন্দরবনের বন কর্মকর্তা ও রক্ষীদের ঘুষ না দিয়ে বনে ঢুকলে মামলাসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ব্যাপারে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর এলাকার আমজাদ হোসেন নামে এক জেলে বলেন, ‘সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে মাছ ধরতে বন কর্মকর্তা ও রক্ষীদের অনেক বাড়তি টাকা দিতে হয়। তবে সুন্দরবনের অন্য সব খালের চেয়ে অভয়ারণ্যের খালে বেশি মাছ থাকে। এ কারণে জেলেরা এই অসৎ পথ অবলম্বন করেন।’ একই উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশির জেলে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের খুশি করতে না পারলে জঙ্গল করে বেশি লাভ করা যায় না। কারণ, বনে তাদের কথাই আইন।’ জেলেরা জানান, বন কর্মকর্তা ও রক্ষীদের ঘুষ দিয়ে খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন সুন্দরবনের সংরক্ষিত অভয়ারণ্যে এলাকা পাটকোষ্টা টহল ফাঁড়ির আওতাধীন চেরাগখালী খাল, ঝালিয়াখাল, মোরগখালী খাল, কাগাদোবেকী টহল ফাঁড়ির আওয়াতাধীন কালিরচর, শিসখালী, ছদনখালী, কাগানদী, মরাকাগা, কেওড়াতলী খাল, ভোমরখালী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন কুকুমারী, ভোমরখালী খাল, খলিশাবুনিয়া, বড়কুকুমারী খাল, নীল কোমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রে টহল ফাঁড়ির বঙ্গবন্ধুর চর, বন্ধের খাল, কেওড়াসুতি খাল, কলাতলা খালে ঢুকে অবৈধভাবে মাছ শিকার করছে কয়েকদল জেলে।পরিবেশবাদীরা বলছেন, এতে সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়ার প্রজননক্ষেত্রের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের শঙ্কা বাড়ছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক শুভ্র শচীন বলেন, ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণীর জেলে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ-কাঁকড়া শিকার করে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের জলজ জীববৈচিত্র্য। এমনকি উদ্ভিদের ওপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।’ সাংবাদিক শুভ্র শচীন আরো বলেন, ‘উপকূলের প্রান্তিক মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এ সুন্দরবন। এই বনকে ঘিরে কোনো না কোনোভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। নিয়ম মেনে সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ করা না হলে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হবে। এখনই সুন্দরবনের মাছ, গাছ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় প্রান্তিক এই মানুষগুলোও জীবিকা সংকটে। যার কারণে তাদের মধ্যে বন অপরাধও বেড়েছে।’ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান এ অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, ‘সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ। অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সংরক্ষিত এলাকায় মাছ শিকার বন্ধে বনবিভাগ সবসময় তৎপর রয়েছে। বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা ও রক্ষীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

