মোস্তফা কামাল
বড় মোক্ষম ও প্রাসঙ্গিক সময়ে ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন। যখন যাবতীয় আলোচনা-পর্যালোচনার মূলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সফরে চীন কী দিয়েছে, আরো কতো কী দেবে বাংলাদেশকে- এ প্রশ্ন নিয়ে। সেই আলোচনায় ছেদ ফেলে বিমসটেক সম্মেলন, সেখানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক। এ বৈঠকে কার জিত হয়েছে, কে ঠকেছে? সেখানে আবার ছেদ-ছন্দপতন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করারোপের ঘটনা।
‘কীসের মধ্যে কী’ এর মতো বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানসহ ১৪টি দেশের নাগরিকদের ওপর সৌদি নিষেধাজ্ঞা। এই ভজঘট বা ঘটনার ঘনঘটার মাঝে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ পুনর্বিবেচনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে। বাংলাদেশে এ নিয়ে এন্তার জিজ্ঞাসা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপের পর জাপান, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার দেশে দেশে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ধসে গেছে ট্রাম্পের দেশের শেয়ারবাজারও। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে তেলের দামও কমেছে। ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের ঘরে এবং ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৩ ডলারে নেমে এসেছে। স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম রাতারাতি বেড়ে গেছে। রাস্তায় হাজারো মানুষ নেমে এসেছে।
সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য বেটার ডেস্টিনেশন হিসেবে বিশ্ব দরবারের বাংলাদেশকে তুলে ধরাই লক্ষ্য। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ, সস্তা শ্রম,পর্যাপ্ত জনশক্তি এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আশা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। বাকিটা অপেক্ষার বিষয়।
চারদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি নিয়ে সমালোচনার মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ওষুধে কাজ দিচ্ছে। এটা চিঠিপত্রের যুগ নয়, এখন টেলিফোন-ইমেইলের যুগ। ৫০টার মতো দেশ ট্রাম্পের সাথে কথা বলতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। ভিয়েতনাম, ইতালী এরইমধ্যে কথা বলে ফেলেছে। বিশ্বময় কঠিন এ সময়েই ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ তহবিল থেকে শুধু স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলোকে মূলধন জোগান দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সোমবার সম্মেলনের প্রথম দিন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট বা বিনিয়োগ সম্মেলনে ‘স্টার্ট-আপ কানেক্ট’ অধিবেশনে প্যানেল আলোচনায় এসব কথা জানান গভর্নর। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানানো হয়।
স্টার্ট-আপ কানেক্ট অধিবেশনে দেশি-বিদেশি তরুণ ও উদ্ভাবনী উদ্যোক্তারা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে রেকর্ড করা বক্তব্য দেন লিংকডইনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যান। প্যানেল আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি–বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, আইসিটি সচিব শীশ হায়দার চৌধুরী।
সেমিনারে মুল প্রবন্ধে বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা তুলে ধরেন কনস্টিলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তানভীর আলী। তিনি বলেন, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে উদ্ভাবনী, স্টার্ট-আপ উদ্যোগের চাহিদা বেশি। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে স্টার্ট-আপ খাতে এখনো বিনিয়োগ কম।
‘এম্পাওয়ারিং ইনোভেশন কানেকটিং অপরচুনিটি’ শিরোনামের এ বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ কী পেয়েছে, কী পাবে সেই হালখাতা এখনই মেলানো সম্ভব নয়। দৃশ্যমান একক প্রাপ্তির মধ্যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।
এ প্রাপ্তির পেছনে কাজ করেছে তার কর্মদক্ষতা। সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আশিক। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ডাকে সাড়া দিয়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেশে এসে এরইমধ্যে কর্মদক্ষতার জ্যোতিতে অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। বিডা তথা বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়েছেন বিশ্বসেরা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। যার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা।
এ বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রাপ্তি দৃশ্যমান হবে ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তা পাল্টানো শুরু হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যে কোনো বিনিয়োগকারী দেশে-বিদেশে যেখানেই বিনিয়োগের চিন্তা করেন তার বিনিয়োগকৃত অর্থের নিশ্চয়তা। তাকে ভাবতে হয় বিনিয়োগ করতে কত সময় লাগবে, বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাবেন কি না? এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এর একটি বার্তা পাবেন। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে সম্ভাব্য বিনিয়োগের আওয়াজ দেওয়ার একটি চর্চা ছিল বাংলাদেশে। শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ বিনিয়োগ করেছে কিনা, কেউ খবর নেয়নি। প্রশ্নও করেনি। অথবা দিব্যি ভুলেই গেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের কাছেও এ সংক্রান্ত তথ্য নেই। তা থাকলে তাদের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিনিয়োগের জন্য অনুরোধ করা সম্ভব হতো। এবারের বিনিয়োগ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিসহ তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। সে তালিকা অনুযায়ী আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ করানো সম্ভব হবে। এবার বল অনেকটাই বাংলাদেশের অনুকূলে। এ দেশেই হচ্ছে বিনিয়োগ সম্মেলনটি। বিদেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা আসছেন।
গত আমলে বিনিয়োগ সম্মেলন হতো বিদেশে। দেশ থেকে দল বেধে ব্যাংকাররা যেতেন, সাথে থাকতেন কিছু ব্যবসায়ী, আমলা ও বিশেষ কোটারির কিছু সাংবাদিকের লটবহর। সবাই মিলে মোজমাস্তিতে সরকারি টাকা খরচ করে আসতেন। কেউ কেউ থেকেও যেতেন বা পরে সুবিধা মতো সময়ে বিদেশে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এই অস্থির সময় বিনিয়োগ আসবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে। এই সময়ে এমন উদ্যোগ সাহসের বিষয়। তাৎক্ষণিক কিছু নমুনা বেশ আশাবাদ জাগিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন ঘিরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখে স্বস্তি জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা।
গণঅভ্যূত্থানের পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ কতটা সম্ভাবনাময় তা পর্যবেক্ষণ করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধি দল। আশার আলো দেখছেন তারা। তা জানিয়েছেন গণমাধ্যমকেও। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কেবল তাত্ত্বিক উপস্থাপন নয় বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সরেজমিনে দেখাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদের নেয়া হয় চট্টগ্রামের আনোয়ারার কোরিয়ান ইপিজেড ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে। সম্মেলনের প্রথম দিন সোমবার দুপুরে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেদারল্যান্ডসহ ৪০টি দেশের ৬০ জন বিনিয়োগকারী ঘুরে দেখেন বিনিয়োগের এসব জায়গা।
জুলাই বিপ্লবের পর বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশে বিনিয়োগ কতটা সম্ভাবনাময় তা তুলে ধরতেই চট্টগ্রামে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ সফর। এসময় কোরিয়ান ইপিজেড ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিভিন্ন কারখানার কর্মপরিবেশ ও কর্মপদ্ধতি ঘুরে দেখেন তারা। আয়োজকরা বলছেন, সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য বেটার ডেস্টিনেশন হিসেবে বিশ্ব দরবারের বাংলাদেশকে তুলে ধরাই লক্ষ্য। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ, সস্তা শ্রম,পর্যাপ্ত জনশক্তি এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আশা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। বাকিটা অপেক্ষার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।