দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা বা গতি না আসা, ডলারের উচ্চদর, উচ্চ সুদহার, গ্যাসসংকট ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ আরো অনেক কারণে দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব চলছে। আর এসবের প্রভাবে রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নতুন করে যোগ হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভক্তি নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও কর্মবিরতি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৭১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের সম্মিলিত ‘কলমবিরতি’র ফলে দিনে গড়ে অন্তত এক হাজার ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। টানা তিন দিন কর্মকর্তারা কাজ না করলে এই ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।এনবিআর সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
আদায়ে ধীরগতির কারণে পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু এই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু প্রথম ৯ মাসের আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্রমান্বয়ে বাড়ছে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি।
আলোচ্য সময়ে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর—তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের মতে, দাবি মানা না হলে আন্দোলন চলতেই থাকবে। এভাবে অব্যাহত কলমবিরতি কিংবা আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হলে সামনে রাজস্ব আদায় আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে রাজস্ব আয়ের গতি ক্রমেই কমছিল। বড় হচ্ছিল ঘাটতির অঙ্ক। এমন সময়ে আইএমএফের শর্ত মেনে নতুন করে সংস্থাকে দুই ভাগ করা নিয়ে তৈরি হয়েছে বাড়তি বিপত্তি। সরকার এনবিআর বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারির পর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে এখন আন্দোলনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য আলটিমেটাম দিয়েছেন। এই অবস্থা যত দীর্ঘায়িত হবে, রাজস্ব আয়ের নেতিবাচক ধারা তত বেগবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘এনবিআরের নীতি ও আদায়কে আলাদা করার ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই নীতিগতভাবে একমত। এত তড়িঘড়ি করে রাতের বেলায় অধ্যাদেশ জারি করায় একটা সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়।’ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, রাজস্ব আদায় ও বাজেটের কার্যক্রম গতিশীল রাখতে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এ বিষয়ের সমাধান দরকার।
দেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্য আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার বড় প্রভাব রয়েছে। তার ওপর আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অসন্তোষ অব্যাহত থাকলে রাজস্ব আয়ে রীতিমতো ধস নামবে। অথচ আগামী মাসেই বাজেট ঘোষণা হবে। এই অবস্থায় আমরা মনে করি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব এ সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।