মাগুরা প্রতিনিধি
মাগুরায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি হিটু শেখের যে ‘বীভৎসতার’ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে তার ‘বিকৃত ও পৈশাচিক মানসিকতাই’ প্রকাশ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। ৮ বছরের শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতে গিয়ে প্রধান আসামি ধারালো ব্লেড ব্যবহার করেছেন- অভিযোগপত্রের এমন বিবরণ শুনে একজন নারীনেত্রী মন্তব্য করেছেন, “এটা শুধু একজন বিকৃত, পৈশাচিক আর জানোয়ারের পক্ষেই সম্ভব। একটা নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে এটা কল্পনাতীত পশুত্বের আচরণ করা হয়েছে।’ মাগুরার আলোচিত এই শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ের জন্য আজ শনিবার দিন ধার্য্য করেন আদালত। সারাদেশে সমালোচনার জন্ম দেওয়া এই মামলাটির বিচারকাজও খুব দ্রুত সম্পন্ন হতে চলেছে। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় হতে চলেছে। ৬ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতারে মারা যায়। ১৩ এপ্রিল মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন। মামলা চার আসামি হচ্ছে- শিশুটির বড় বোনের শ্বশুর হিটু শেখ, মেয়ে জামাই সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা রোকেয়া বেগম। তারা কারাগারে আছেন। হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তিনি মামলার সাক্ষ্য চলাকালে একাধিক দিন সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত নন। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে- ঘটনার আগে ১ মার্চ ৮ বছরের শিশুটি তার বড় বোনের সঙ্গে শ্রীপুর উপজেলার গ্রামের বাড়ি থেকে মাগুরা শহরতলীর নিজনান্দুয়ালী গ্রামে হিটু শেখের বাড়িতে আসে। ভগ্নিপতি সজীব শেখ ওরফে ইসমাইল তাদের নিয়ে আসে। পরের পাঁচটি দিন ভালই যায়।
৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় সবার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে শিশুটি তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমায়। পরদিন ৬ মার্চ খুব সকালে বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সকাল ৬টায় হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম (৩৮) বাড়ির পাশের ওলিয়ারের ক্ষেতে মসুরির ডাল তোলার কাজে চলে যান।
হিটু শেখের মা রোকেয়া বেগম রান্নাবান্নার কাজে চলে যান। সকাল ৮টা থেকে সোয়া ৮টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া করে শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব শেখও রাজমিস্ত্রির কাজে বাড়ির বাইরে চলে যান। এরপর রান্নাঘর থেকে ভাত ও তরকারি এনে বড় বোন শিশুটিকে খাওয়ায়। হাতমুখ ধুয়ে শিশুটি আবার বোনের ঘরেই বিছানায় শুয়ে থাকে। হিটু শেখের মা রোকেয়া বেগম এর কিছু সময় পর বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে চলে যান। ফলে ওই সময় বাড়িতে হিটু শেখ, শিশুটি, তার বড় বোন এবং হিটু শেখের বড় ছেলে রাতুল শেখ বাড়িতে ছিল। হিটু শেখ, রাতুল শেখ তাদের নিজেদের ঘরে এবং শিশুটি তার বড় বোনের ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিল। বড় বোন বাড়ির রান্নাঘরে আশপাশে কাজ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে হিটু শেখ ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার পুত্রবধূ অর্থাৎ সজীবের স্ত্রী রান্নাঘরের পাশে বরই গাছের নিচে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। হিটু শেখ তখন সজীবের ঘরের বারান্দায় যায় এবং দেখতে পায়, সেই ঘরের দরজা খোলা। শিশুটি তার বোনের বিছানায় শুয়ে আছে। হিটু শেখ তখন ‘যৌন কামনা চরিতার্থ করতে’ সজীবের ঘরে ঢুকে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং বিছানা থেকে তাকে নামিয়ে ঘরের মেঝেতে রাখে। শিশুটি চিৎকার করলে হিটু শেখ পাশে থাকা একটি ওড়না দিয়ে শিশুটির গলায় চেপে ধরে। এরপরই শিশুটি অচেতন হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই হিটু শেখ শিশুটির বুকের উপর চেপে বসে। একপর্যায়ে বিছানা থেকে বালিশ টেনে এনে শিশুটির মুখ চেপে ধরে এবং শিশুটির উপর যৌন নিপীড়ন চালায়।
অভিযোগপত্রের বর্ণনায় বলা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের একপর্যায়ে সময় হিটু শেখ তার নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার তোষকের নিচ থেকে একটি পুরনো ব্যবহার করা ব্লেড নিয়ে আসে এবং শিশুটির যৌনাঙ্গ ও বুকে ব্লেড ব্যবহার করা হয়। যৌন নিপীড়ন শেষে হিটু শেখ সেই ব্লেডটি আবার নিজের ঘরের বিছানার তোষকের নিচে নিয়ে রেখে দেয়। শিশুটি তখনও তার বোনের ঘরের মেঝেতেই পড়ে ছিল। হিটু শেখও তখন তার ঘরেই অবস্থান করছিল। একপর্যায়ে শিশুটির বড় বোন মোবাইল ফোনে কথা শেষ করে নিজের ঘরের দিকে আসেন। হিটু শেখ তার ঘর থেকেই সেটি দেখতে পারে। তিনি তখন ঘর থেকে বের হয়ে শরীর পরিষ্কার করার জন্য বাইরে চলে যান। সজীবের স্ত্রী ঘরে ঢুকে দেখেন তার ছোট বোন মেঝেতে পড়ে আছে এবং গোঙানির শব্দ আসছে। ঘরে তখন পর্যাপ্ত আলো ছিল না। বড় বোন ধরে নেয় যে, তার ছোট বোন হয়ত ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গেছে এবং হয়ত ঠান্ডা লাগার কারণে এরকম শব্দ করছে। বড় বোন তখন ছোট বোনকে কোলে করে বিছানায় তুলে দিয়ে লেপ দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর তিনি আবার রান্নাঘরের দিকে চলে যান। ওদিকে, হিটু শেখ স্বাভাবিকভাবে হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত খায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তিনি বড় ছেলে রাতুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। তাকে মসুর ডাল তুলতে মাঠে যেতে তাগাদা দিয়ে নিজেও মাঠের দিকে চলে যান। মাঠে আগে থেকেই কাজ করছিলেন স্ত্রী জাহেদা। হিটু শেখ গিয়েও মাঠে মসুর তোলা শুরু করেন। মামলায় হিটু শেখের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের ৯ এর ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে- “যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে [ধর্ষণের শিকার] নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত [অনধিক বিশ লক্ষ টাকা] অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, “ধর্ষণের আগে শিশুটি আত্মরক্ষায় জন্য চিৎকার দিলে তার মুখে বালিশ চাপা দেওয় হয়। হিটু শেখ শিশুটির গলা, বুক ও যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলে এং ধর্ষণ করে। ‘প্রধান আসামির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন, ফরেনসিক রিপোর্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, সাক্ষীদের সাক্ষ্য- সবকিছুতে হিটু শেখ যে শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে- তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে। ধর্ষণের ফলেই শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। আমরা আশাবাদী, আদালত ন্যায়বিচার করবে। হিটু শেখের সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে।’ জেলা পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা বলেন, “আলোচিত এই মামলায় রায় ঘোষণা উপলক্ষে আদালত চত্বর ও এর আশপাশে শনিবার সকাল থেকে অতিরিক্ত পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
একনজরে শিশু ধর্ষণ-হত্যা
১ মার্চ: রোজার ছুটিতে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আট বছরের শিশুটি তার বোনের বাড়ি বেড়াতে আসে।
৬ মার্চ: সকালে শিশুটি তার বোনের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়।
ওইদিনই শিশুটিকে মাগুরা সদর হাসপাতাল থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
৭ মার্চ: শিশুটির চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
৮ মার্চ: পরে তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এদিন শিশুটির মা চারজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা করেন। আসামিরা হলেন- শিশুটির বড় বোনের শ্বশুর হিটু শেখ, মেয়ে জামাই সজীব শেখ, তার ভাই রাতুল শেখ ও তাদের মা রোকেয়া বেগম। শুরু থেকেই তারা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন।
৯ মার্চ: শিশুটির ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ছাত্র-জনতার অব্যাহত বিক্ষোভ।
১০ মার্চ: নিরাপত্তার কারণে রাতে শুনানি করে চার আসামিকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
১২ মার্চ: তিন পুরুষ আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ।
১৩ মার্চ: শিশুটি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যায়। আসামিদের গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ওইদিনই বিমান বাহিনীর একটি উড়োজাহাজে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা জানাজা শেষে তাকে রাতে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
১৪ মার্চ: পুলিশ জানায়, শিশুটি মারা যাওয়ায় আগের ধর্ষণ মামলার পাশাপাশি হত্যা মামলাও হয়েছে।
১৫ মার্চ: ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিটু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
৮ এপ্রিল: মাগুরার পুলিশ সুপার জানান, হিটু শেখের ডিএনএ প্রতিবেদনে শিশুটিকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
১৩ এপ্রিল: মাগুরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন।
২০ এপ্রিল: শুনানি শেষে আদালত অভিযোগ গঠনের জন্য ২৩ এপ্রিল দিন রাখেন।
২৩ এপ্রিল: অভিযোগ গঠনে শেষে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।
২৭ এপ্রিল: শিশুটির মা ও মামলার বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
৮ মে: মামলার মোট ২৯ জনের সাক্ষ্যপ্রদান শেষ হয়।
১৩ মে: দুই দিনের যুক্তিতর্ক শেষে মাগুরা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান আলোচিত এই মামলার রায়ের জন্য ১৭ মে দিন রাখেন।