১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ২রা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতায় কুষ্টিয়া থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন-মোল্লা মাসুদ গ্রেফতার

প্রতিদিনের ডেস্ক
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর জানিয়েছে, দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে। মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকেলে সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী। তিনি বলেন, আজ ভোর ৫টা থেকে শুরু হওয়া কুষ্টিয়া ও ঢাকার হাতিরঝিলে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ৪৬ স্বতন্ত্র ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের একটি ইউনিট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সফলভাবে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন— দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ এবং দুই শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি এবং ১ টি স্যাটেলাইট ফোন। কুষ্টিয়া সদরের সোনার বাংলা রোডে সকাল সোয়া ৫টায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ। পরে তাদের দেওয়া তথ্য মতে ঢাকার হাতিরঝিল এলাকায় সকাল ৭টায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় শ্যুটার আরাফাত ও গাড়িচালক শরীফ।

আরাফাত ও গাড়িচালক শরীফ সুব্রত বাইনের সহযোগী। কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং নাশকতা চালিয়ে আসছিল। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ হলো তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী দলের অন্যতম নেতা এবং সেভেন স্টার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী। এ অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয় যা আমাদের বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় ও সহায়তা দিয়েছে সেনা সদরের সামরিক অপারেশন পরিদপ্তর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, ৭১ মেকানাইজ ব্রিগেড ও এনএসআই। আইএসপিআর পরিচালক বলেন, এছাড়া আমি আপনাদের মাধ্যমে দেশের জনগণকে জানাতে চাই— যেকোনো ধরনের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড কিংবা সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত তথ্য অনুগ্রহ করে নিকটস্থ সেনাক্যাম্প অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করুন। আমরা আবারও দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই—সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।


প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানান, সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি করা শীর্ষ দুই সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। মঙ্গলবার (২৭ মে) কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা সড়কের একটি ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্রসহ তাদের গ্রেফতার করা হয়। বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরের দিকে সেনাবাহিনীর ৫-৭টি গাড়ি কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা সড়ক ও মসজিদের পাশের একটি তিনতলা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে অবস্থান নেয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা শ্বাসরুদ্ধকর এ অভিযান শেষে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে ওই বাড়ির নিচতলা থেকে দুজনকে গ্রেফতার করে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির বাসিন্দা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন তলাবিশিষ্ট পুরোনো বাড়িটির মালিক আলমডাঙ্গার সাবেক পৌর মেয়র ও বিএনপি নেতা প্রয়াত মীর মহিউদ্দিনের। কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের ঠিক একেবারে পেছনে বাড়িটির অবস্থান। প্রায় ৮-১০ বছর ধরে বাড়িটি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। প্রয়াত মীর মহিউদ্দিনের মেয়ে বাড়িটি দেখাশোনা করলেও তিনি এখানে থাকেন না। ওই বাড়ির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলা ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। বাড়িটির নিচতলা এতদিন খালি পড়ে ছিল।


ওই ছাত্রাবাসের বাসিন্দা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিন আলম। তিনি আজকের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। শাহিন জানান, ছাত্রাবাসের ঠিক পেছনের ০১, হুর আলী শেখ সরণি, কালিশংকরপুর এলাকার তিনতলা বাড়ির মালিক প্রতিবেশী ব্যবসায়ী হাফিজুল। রোজার ঈদের পর তিনি বাড়িটির নিচতলা ভাড়া নিয়ে দুজনকে সেখানে ওঠান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, এতদিন এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। নিচতলায় কতজন থাকতেন, এটিও তারা জানেন না। দু-তিনজনকে থাকতে দেখেছেন। দু-একবার সুন্দরী নারীকেও ওই বাসায় ঢুকতে দেখেছেন। ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে হাতেগোনা দুই থেকে তিনবার ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছে। তবে কোনোদিন কথা-বার্তা হয়নি। মঙ্গলবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শাহিন বলেন, ‌‘ছাত্রাবাসের দুই এবং তিনতলা মিলিয়ে আমরা ১৮-২০ জন ছিলাম।

আমরা সবাই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোরের আজানের পর (আনুমানিক ৫টা ২০ মিনিট) সেনাবাহিনীর ৩০-৪০ জন সদস্য আমাদেরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাড়িতে প্রবেশ করার গ্রিলের তালা খুলতে বলেন। এসময় মোবাইলে দাড়িওয়ালা একজনের ছবি দেখিয়ে জানতে চান, এই ব্যক্তিকে আমরা চিনি কি-না। এসময় সেনাবাহিনীর সশস্ত্র তিনজন আমাদের সবাইকে দুটি কক্ষের মধ্যে আটকে রেখে নিচতলায় অভিযান পরিচালনা করে। আমরা বাড়ির সামনে রাস্তায় সেসময় ৭-৮টি সেনাবাহিনীর গাড়ি অবস্থান করতে দেখেছি। অভিযানের সময় সেনাসদস্যরা নিচতলার ওই বাড়ির দরজা দীর্ঘসময় ধরে ধাক্কা-ধাক্কি করেন। তবে কেউ গেট খুলছিলেন না। একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা দরজার ছিটকিনি ভেঙে ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অভিযান ও তল্লাশি চালানো হয়। সকাল ৮টার কিছু পরে নিচতলার ওই বাড়ি থেকে পেছনে হাতকড়া ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে কালো মাইক্রোবাসে ওঠানো হয় অপরজনকেও কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ওই গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযানের সময় সোবাহিনীর সদস্যরা বলাবলি করছিলেন, গ্রেফতার ব্যক্তি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র গুলি উদ্ধার হওয়ার কথা শুনেছি’,যোগ করেন ছাত্রাবাসের বাসিন্দা শাহিন। ওই ছাত্রাবাসের বাসিন্দা সানজিদুর বলেন, ‘নিচতলা বেশ কিছু দিন ধরেই খালিই পড়ে ছিল। রোজার ঈদের পর পেছনের তিনতলা বাড়ির বাসিন্দা হাফিজুল ও তার ছেলে বাসাটি ভাড়া নিয়ে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ওই দুজনকে বাড়িতে ওঠান। তাদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। সেনাসদস্যরা গ্রেফতারের পর আমরা গুগল এবং অনলাইন ঘেঁটে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে একজন সুব্রত বাইন।’ অভিযানের পর ওই বাড়িতে প্রবেশ করে দেখা যায়, চার কক্ষের বাড়ি। খাট, লোপ, তোশক ছাড়া ফার্নিচার বলতে তেমন বিশেষ কিছু নেই। যে কক্ষে সুব্রত বাইন থাকতেন, সেখানে দুটি টেলিভিশন, ওভেন, পানির ফিল্টার রয়েছে। দুটি কক্ষেই বিছানাপত্র মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অপর একটি কক্ষে ম্যাট্রেস দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দেওয়া। ওই কক্ষের ফ্যান চললেও আলো জ্বলে না। আরেকটি কক্ষ ভেতর থেকে লক করা। বারান্দার গ্রিল দিয়ে ওই কক্ষে প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়