৪ঠা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ১৯শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

আদালতের মর্যাদা রক্ষা ও বিচারপ্রক্রিয়ার গুরুত্ব

গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কর্তৃক আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই পরিচালিত হয়েছে বিচারিক কার্যক্রম। এই প্রথম কোনো অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ ঘোষিত হলো। এই রায় বিচারপ্রক্রিয়া ও আদালতের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্বকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। ঘটনার সূত্রপাত হয় শেখ হাসিনা ও গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাকিল আলম বুলবুলের একটি ফোনালাপকে কেন্দ্র করে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি।’ সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষায় এই ফোনালাপের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর প্রসিকিউশন আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়। ট্রাইব্যুনাল নোটিশ জারি করে ব্যাখ্যা তলব করলেও শেখ হাসিনা ও বুলবুল নির্ধারিত তারিখে আদালতে উপস্থিত হননি। ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রায়ের পর সাংবাদিকদের জানান, এই ফোনালাপের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের হত্যা এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর ১১(৪) ধারা অনুযায়ী বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল। এই হুমকির কারণে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন এবং অনেকে মামলা করতে আসছেন না বলেও তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামানও আদালতে ইতিবাচক মতামত দিয়ে বলেছেন যে এটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিসের (বিচার প্রশাসন) প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল। এই রায় প্রমাণ করে যে বিচারব্যবস্থা সবার জন্য সমান এবং কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নন, তিনি যত বড় প্রভাবশালীই হোন না কেন। এটি বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন এমন একটি রায় আদালতের স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তবে মামলার প্রক্রিয়া চলাকালে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ এবং তাঁর পেশাদারি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পারে। এ ধরনের বিতর্কের সুযোগ যাতে ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পরিশেষে বলা যায়, শেখ হাসিনার এই কারাদণ্ড বিচারব্যবস্থার প্রতি সবার শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি না করার জন্য একটি কঠোর বার্তা প্রদান করবে। এই রায় দেশের বিচারিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে এবং তা ভবিষ্যতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়