বাংলাদেশ এক গভীর সামাজিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে সহিংসতা, বিচারহীনতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের এক নির্মম বাস্তবতা চলছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে এক পরিবারকে পিটিয়ে হত্যা, দেশজুড়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের পরিসংখ্যান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা—সবকিছু মিলিয়ে স্পষ্ট হয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি একটি সুসংহত ও মানবিক সমাজের জন্য অশনিসংকেত। মুরাদনগরের কড়ইবাড়ী গ্রামে মা, ছেলে ও মেয়েকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি কোনো একক অপরাধ নয়, এটি সামাজিক প্রতিশোধ, গণপিটুনির সংস্কৃতি এবং স্থানীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মিলিত রূপ। মাদক, মোবাইল ফোন চুরি এবং পুরনো শত্রুতার জেরে একসঙ্গে তিনজন মানুষকে হত্যা করা—এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যর্থতা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়। ঘটনা-পরবর্তী অবস্থানও কম ভয়াবহ নয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযুক্ত, অথচ তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত ১৭৯ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন, যা এ ধরনের বিচারহীনতার প্রবণতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধিকেই তুলে ধরে। পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতি ‘মহামারির পর্যায়ে’ পৌঁছেছে বলে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ মন্তব্য করেছেন। গত ৯ দিনে ২৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং গত ছয় মাসে এক হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮১ জন ধর্ষণ এবং ১৭ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার। মাদরাসাগুলোতেও শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই সমস্যার গভীরতাকে প্রকাশ করে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ৯ হাজার ১০০টি মামলা হয়েছে, যা গত বছরের মাসিক গড় মামলার সংখ্যা (১,৪৬৪) থেকে যথেষ্ট বেশি। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মানবাধিকারকর্মী ও মহিলা পরিষদের মতো সংগঠনগুলো বলছে, পত্রিকায় সব ঘটনার খবর হয় না, বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। যখন ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য মানবাধিকারকর্মী হয়েও শারমীন মুরশিদ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে মত দেন, তখন বোঝা যায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা কতটুকু। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যথাযথ দায়িত্ব পালনের অভাব এবং রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত এই অপরাধগুলোকে উৎসাহিত করছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ও বিচার দ্রুত নিশ্চিত না হলে সাধারণ মানুষের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হানবে। গণপিটুনি, ধর্ষণ ও নারী-শিশু হত্যা প্রতিরোধে একটি সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। একই সঙ্গে শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা ও মানবিক মূল্যবোধ পুনর্গঠনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।
সহিংস সমাজ, অসহায় নারী ও শিশু
Previous article
Next article
আরো দেখুন
গোপালগঞ্জে ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করুন
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বনির্ধারিত পদযাত্রা ও সমাবেশে হামলার ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে পতিত হলেও স্বৈরাচারের চরিত্র পাল্টায়নি। তাদের হামলায় বুধবার গোপালগঞ্জ শহর...
মাহবুবুর হত্যা মামলায় গ্রেফতার রায়হান এবং আসিফ মোল্লা কারাগারে
খুলনা প্রতিনিধি
খুলনার দৌলতপুরের সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার রায়হান এবং আসিফ মোল্লার ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। কিন্তু শুক্রবার...