উৎপল মণ্ডল, শ্যামনগর
সুন্দরবন তাদের কাছে কেবল একটি বন ছিল না, ছিল সংসার টিকিয়ে রাখার উৎস। কিন্তু সেই বনের গহিনে ঢুকে তাদের প্রিয় মানুষগুলো আর ফিরে আসেনি। এমন এক হাজারের বেশি নারী আছেন, যাদের নাম নেই সরকারি হিসাবের পাতায়। তবে তাদের পরিচয় আজ কেবল একটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা ‘বাঘ-বিধবা’।সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনীসহ উপকূলঘেঁষা গ্রামগুলোতে এমন শত শত নারী আছেন, যারা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হামলায় প্রাণপ্রিয় স্বামীকে হারিয়েছেন। কারও স্বামী মারা গেছেন মাছ ধরতে গিয়ে, কেউ আবার মধু আনতে বনে পাঠানো স্বামীর লাশটিও ফিরে পাননি। কিন্তু প্রিয়জন হারানো এ নারীদের কপালে জুটেছে অপয়া, অলক্ষ্মী, স্বামীখেকো নাড় আর ডাইনির মতো অপবাদ। তাদের জন্য নেই কোনো সহানুভূতি, সান্ত্বনা, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন কাটে একাকী।শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ জেলেপাড়ার আলোচিত নাম সোনামণি দাসী (৬৮)। তার জীবনের গল্পের প্রতিটি পাতা যেন বিষাদে ভরা। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়েন তার প্রথম স্বামী রাধাকান্ত সরদার। সঙ্গীরা তার লাশও খুঁজে পাননি। স্বামী হারানোর শোকে যখন তিনি মুহ্যমান, তখন তার কোলে ছিল এক মাস বয়সী সন্তান। অথচ শাশুড়ি তাকে অপয়া অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবার বাড়িতেও ঠাঁই হয়নি তার। অপমান আর চোখের অশ্রুকে সঙ্গী করে থাকতে হয়েছে দেবরের ঘরে। এরপর দেবর ভূবেন সরদারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরপরই ভুবেনও সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। তার লাশও পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার বিধবা হয়ে সোনামণি অকুল পাথারে পড়েন। পেট চালাতে তিনি নিজেই কাজে নামেন। মাছ ধরেন, মানুষের বাড়িতে কাজ করেন, মাটি কাটেন। মেয়েদের বিয়ে দেন। এখন বয়সের ভারে এসব কাজ আর করতে পারেন না। বলেন, ‘এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী বাঘের পেটে গেল, আমাকেও রেখে গেল মরার মতো।’ এখন তিনি স্থানীয় মুন্সীগঞ্জ বাজারে দোকানিদের ছোটখাটো কাজে সাহায্য করেন। বিনিময়ে মেলে সামান্য চাল-ডাল-পেঁয়াজ। বর্তমানে সংসার কীভাবে চলে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার আর সংসার! একলা জীবন! আগে গাঙে (নদীতে) জাল টেনে মাছ-কাঁকড়া ধরে, ঘেরে মাটি কাটার কাজ করে খেতাম। এখন আর শরীরে পেরে ওঠে না। তাই মুন্সীগঞ্জ বাজারে দোকানদারদের একটু কাজ করে দিই। তাতে তারা একটু ঝাল-পেঁয়াজ দেয়।’ সোনামণির অভিযোগ, সরকার থেকে তাকেসহ তার প্রতিবেশী আরও তিনজনকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের জেলেপাড়ায় বাসিন্দা বলি দাশী। তার অবস্থাও সোনামণির মতো। ২০০২ সালে তার স্বামী অরুণ মণ্ডল বাঘের আক্রমনে মারা যান। তাকেও স্বামীর মৃত্যুর পর ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমাকে শাশুড়ি ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল। ভাইয়ের বাড়িতে জায়গা পেলাম ঠিকই, কিন্তু সে জীবন বড় যন্ত্রণার। পরে নদীতে রেণুপোনা ধরে সন্তানদের বড় করেছি। আজও একই কাজ করে জীবন চালাই।’ তার দেবরও একইভাবে বাঘের শিকার হন। তার স্ত্রী দীপালীরও বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয়নি।শুধু এ দুজনই নয়- শ্যামনগরের প্রতিটি গ্রামে ঘুরলে এমন অনেক সোনামণিদের দেখা মেলে। একেকটি মুখ যেন একেকটি গল্প। তাদের সবার জীবন কাটছে অপবাদ আর দরিদ্রকে সঙ্গী করে। জানা গেছে, সাতক্ষীরা উপকূলের দেড় লক্ষাধিক মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এই বনে বাঘের আক্রমণে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবে কম। শুধু ২০০৯ সালে ১২০ জন বনজীবী মারা গেছেন বলে সরকারি হিসাব বললেও স্থানীয়রা বলছেন, এ সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকে পাস ছাড়াই বা অন্যের নামে বনে যান, ফলে তাদের মৃত্যু সরকারি খাতায় ওঠে না।বেসরকারি সংস্থা লিডার্স জানিয়েছে, উপকূল অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ১৬৩ জন ‘বাঘ-বিধবা’ আছেন। এর মধ্যে গাবুরায় ১০৯ জন, বুড়িগোয়ালিনীতে ৩৯ জন, মুন্সীগঞ্জে ১০৭ জন, রমজাননগরে ৪১ জনসহ সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বাঘ-বিধবারা থাকেন। অন্যদিকে সরকারি হিসাবে স্বীকৃত ‘বাঘ-বিধবা’র সংখ্যা মাত্র সাতজন।পীযুষ বাওয়ালিয়া পিন্টু। তিনি বাঘ-বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তার মতে, ‘আগে আহতদের ৫০ হাজার আর নিহতদের ক্ষতিপুরণ ১ লাখ টাকা ছিল। এখন সেটা ৩ লাখ হয়েছে। আহত হলে ১ লাখ। কিন্তু যারা অন্যের পাসে বা অবৈধভাবে বনে যান, তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পান না।’ শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় যেসব বাঘ-বিধবা আছেন তাদের ভাতার ব্যাপারে আগে অগ্রধিকার দেওয়ার কথা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। ইতিমধ্যে তাদের ১৭ জন বাঘ বিধবাকে সুপেয় পানি নিশ্চিতে ৩ হাজার লিটারের পানির ট্যাংকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসন তাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেবে। তা ছাড়া কিছু এনজিও তাদের নিয়ে কাজ করছে।

