১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

ইসলামী রাজনীতি মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা নয়

বিভুরঞ্জন সরকার
কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতি একটি অনন্য ও গভীর রাজনৈতিক অনুরোধ রেখেছেন। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী নামটি বহাল রাখা রাজনৈতিকভাবে অনুচিত এবং তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। তাঁর এই বক্তব্য মূলত মুক্তিযুদ্ধ, ইসলামি রাজনীতি এবং তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চেতনা নিয়ে এক প্রাজ্ঞ বিশ্লেষণ। ফরহাদ মজহার স্পষ্টভাবে বলেন, জামায়াত দলটিকে তিনি পছন্দ করেন, ভালোবাসেন তাদের নেতাদের। কিন্তু তিনি এটাও মনে করেন, ১৯৭১ সালে দলটির অবস্থান যে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী ছিল, তা উপেক্ষা করা যাবে না। যেহেতু বাংলাদেশ একটি যুদ্ধ করে অর্জিত রাষ্ট্র, সেহেতু এর রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে গড়া। আর সেই মূল্যবোধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা একটি দলের নাম, প্রতীক বা অতীত ভূমিকা যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘বাহাত্তরের পরও আপনারা জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করেছেন—এটা অন্যায় হয়েছে।’ এই বাক্যে তিনি মূলত একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সরাসরি পাকিস্তানপন্থী অবস্থান, রাজাকার-আলবদরের সঙ্গে সম্পর্ক এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে গুমরে থাকা এক তিক্ত স্মৃতি। স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম বারবার সেই ইতিহাসের সঙ্গে দলটির নাম, আচরণ এবং ভাবমূর্তিকে জুড়ে দেখে। এই কারণে ফরহাদ মজহার মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী নামটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তিনি আরও বলেন, আপনারা একসময় ডেমোক্রেটিক লীগ করেছিলেন, পরে আবার ফিরে এলেন জামায়াতে ইসলামী নামে—এটা কি আমাদের অপমান করার জন্য? এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। এমন একটি প্রশ্ন যা শুধুই ক্ষোভের প্রকাশ নয়, বরং একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণেরও উত্থান। একটি দল কীভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইতিহাস বহন করে আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়? তারা যদি সত্যিই চায়, তাহলে কেন নিজেদের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন করে এগোয় না? ফরহাদ মজহার বিশ্বাস করেন, ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে শুধু বক্তব্য নয়, বরং প্রতীক, নাম এবং রাজনৈতিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হয়। সেই প্রেক্ষিতে নাম পরিবর্তনের অনুরোধ তিনি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দায়িত্ব হিসেবেই দেখেন।
তিনি মনে করেন, যারা আজো জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করেন, তারা মূলত ১৯৭১ সালের বিরুদ্ধে অবস্থান বজায় রেখেছেন, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবমাননা। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে, বারবার শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হবে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আনুগত্য আজো প্রবল। তিনি এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে—আপনি যদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ক্রমাগত অপমান করেন, তাহলে আপনি আবারো সেই ফ্যাসিস্ট শক্তিকেই প্রতিষ্ঠিত করবেন, যাকে আপনি হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনোই সফল হতে পারে না। বরং তা ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধপন্থী বা রাষ্ট্রবাদী গোষ্ঠীকেই বৈধতা দেয়, কারণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা শক্তির যদি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছাপ থাকে, তবে সাধারণ মানুষ সেই ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করেন, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে যে নতুন গতিধারা তৈরি হয়েছে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সময়টা হলো আত্মসমালোচনা ও পুনর্গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়। দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর উচিত এই সুযোগ কাজে লাগানো। তিনি বলেন, ‘এখনো আপনাদের আমি বিনয়ের সঙ্গে বলি, হাতজোড় করে বলি, এটা খুব ভালো সময়—জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আপনারা আপনাদের নামটা পরিবর্তন করেন।’
এখানে তার কণ্ঠে কোনো অভিমান নেই, আছে গভীর এক দায়বদ্ধতা। ফরহাদ মজহার মনে করেন, দল হিসেবে জামায়াত শুধু নামই নয়, চেতনায়ও পরিবর্তিত হলে তারা ইসলামের প্রতি তরুণদের আগ্রহের পথ খুলে দিতে পারবে। কারণ আজো অনেক তরুণ ইসলাম নিয়ে ভাবছে, ধর্মীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ খোঁজে। কিন্তু তারা যখন জামায়াতের নাম শোনে, তখন ১৯৭১ সালের বিরোধিতার ইতিহাস তাদের মনে ভেসে ওঠে। ফলে ইসলাম নয়, বরং জামায়াত নামটাই তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এতে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, যা কেবল জামায়াত নয়, বরং পুরো ইসলামি রাজনীতির জন্যই বিপজ্জনক।
ফরহাদ মজহারের মতে, জামায়াত যদি ইসলামি রাজনীতিকে তরুণদের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে চায়, তাহলে তাদের একাত্তরের দায় এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। সে দায় শুধু স্বীকার করলেই হবে না, প্রয়োজনে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়ই পুনর্গঠন করতে হবে। একাত্তরের ভূমিকার জন্য অনেকেই ইসলামকেই দায়ী করে বসে, যা ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষোভ তৈরি করে। অথচ ইসলাম একটি বিশুদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়, একে রাজনৈতিক চক্রান্তের হাতিয়ার বানানো ঠিক নয়। এই ক্ষতির দায় দলটি এড়াতে পারে না। ফলে, ইসলামী রাজনীতিকে গ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন করতে হলে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামটি একটি বড় অন্তরায়। ফরহাদ মজহার এই বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
তিনি মনে করেন, এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছাপ সরিয়ে দিয়ে এক নতুন ইসলামি রাজনৈতিক ধারার জন্ম দেওয়ার। নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে দলের মধ্যে যে প্রতীকী এবং বাস্তব রূপান্তর ঘটে, তা সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে। নাম পরিবর্তন মানে শুধু একটি ট্যাগ বদলানো নয়, বরং এটি হলো রাজনৈতিক বার্তা, মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্যপথে নতুন করে যাত্রা শুরু করা। উদাহরণ হিসেবে তিনি অবশ্য নতুন কোনো নামের পরামর্শ দিয়েছেন কি না, তা খবরে বলা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ও ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয় দুটির সমন্বয় না হলে শুধু নাম বদলে কতটা কী লাভ হবে – সে প্রশ্নও আছে।জামায়াতের নাম বদল তরুণদের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে পারে। তবে তাদের কাছে এটা স্পষ্ট করতে হবে যে, ইসলামি রাজনীতি মানেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা নয়। বরং এক নতুন ইসলামি রাজনীতি গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র—এই তিনটি বিষয় সমান্তরালভাবে অবস্থান করতে পারে। নাম পরিবর্তন দলটির জন্য কৌশলগতভাবেও লাভজনক হতে পারে। কারণ এতদিন ধরে জামায়াত একটি বিতর্কিত নাম হিসেবে সমাজে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের নেতাদের চেহারায় যতই পরিবর্তন আসুক, নতুন প্রজন্মের মন থেকে সেই নামের প্রতি সংশয় ঘোচানো সম্ভব হয়নি। তাই এই সংশয় কাটাতে হলে শুধু আচরণ নয়, নাম ও চেতনারও রূপান্তর প্রয়োজন।
তবে এই পথে প্রতিবন্ধকতাও কম নয়। দলটির ভেতরে অনেকেই ঐতিহ্যের কথা বলে নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করবেন। অনেক প্রবীণ নেতা হয়তো বলবেন, এই নামেই আমাদের ইতিহাস, এই নামেই আমরা গড়ে উঠেছি। কিন্তু এ প্রশ্নেরও একটি উত্তর আছে। ফরহাদ মজহারের মতে, যদি সেই ঐতিহ্য একাত্তরের ইতিহাসকে অস্বীকার করে, তবে সেটি আর গৌরব নয়, বরং দায়। ইতিহাসকে সম্মান করতে হলে পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে হয়। তাই প্রয়োজন ঐতিহ্য নয়, বিবেক ও দায়বদ্ধতা দিয়ে পথ চলা।
আরেকটি বাস্তব বিপত্তি হলো, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এ ধরনের নাম পরিবর্তনকে ভণ্ডামি বলে আক্রমণ করতে পারে। তারা বলবে, জামায়াত শুধু মুখোশ পাল্টাচ্ছে, চেতনা পাল্টায়নি। এই সমালোচনার মোকাবিলায় দলটির উচিত হবে শুধু নাম নয়, প্রকাশ্যভাবে একাত্তরের ভূমিকার ব্যাখ্যা দেওয়া, ভুল স্বীকার করা এবং একটি নতুন রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করা, যাতে নাম পরিবর্তনের অর্থ সত্যিকারের রূপান্তর হিসেবে দেখা যায়।
ফরহাদ মজহার শুধু জামায়াত নয়, সমস্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিকে এ কথাও মনে করিয়ে দেন যে, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ যেমন বিপজ্জনক, তেমনি সেক্যুলার ফ্যাসিবাদও ভয়ংকর। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা—এই তিনের বিরুদ্ধেই জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছিল। সেই সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। এই লড়াইকে ফলপ্রসূ করতে হলে, সবাইকে নিজের জায়গা থেকে আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর জন্য সেটি শুরু হতে পারে নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে।ফরহাদ মজহার কোন বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা মতলব সামনে রেখে জামায়াতের নাম বদলের পরামর্শ দিয়েছেন তা খুব পরিষ্কার না হলেও আমি তাঁর এই বক্তব্যকে নতুন একটি দিকনির্দেশনা হিসেবেই দেখতে চাই। তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক পক্ষের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন না কি জাতীয় চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ইসলামের ভাবমর্যাদা এবং তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক জিজ্ঞাসার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ করেছেন তা অবশ্যই পরীক্ষা করার বিষয়।
তাঁর এই সত্য উচ্চারণ অনেকের কাছে অস্বস্তিকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একটি সৎ ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই বক্তব্যকে কেবল এক ব্যক্তির অনুরোধ হিসেবে না দেখে একটি সম্ভাব্য নবজাগরণের ডাক হিসেবে কি বিবেচনা করা যায় না? আমাদের সংকীর্ণতা ও অনুদারতার তো শেষ নেই। ফরহাদ মজহাব খুব স্বচ্ছ পথে রাজনীতির আঙ্গিনায় বিচরণ করেন, তা-ও নয়। তারপরও তাঁর এই আহ্বানকে আমি অন্তত ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই।
জামায়াতে ইসলামীর সামনে এখন দুটি পথ—একটি হলো পুরোনো নাম ও ইতিহাস আঁকড়ে ধরে চলা, অন্যটি হলো সাহস করে নতুন পথ বেছে নেওয়া। দ্বিতীয় পথটি কণ্টকাকীর্ণ হলেও সেখানে ভবিষ্যৎ আছে। প্রথম পথটি তুলনামূলক সহজ, কিন্তু সেখানে সম্মান নেই, গ্রহণযোগ্যতা নেই, ভবিষ্যৎও নেই। ফরহাদ মজহারের বক্তব্য একটি আয়নার মতো—যেখানে দলটি নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখতে পারে। এখন সিদ্ধান্ত তাদের।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়