দেশে গণপিটুনি ও মব সহিংসতা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এটি শুধু মানবাধিকার নয়, আইনের শাসনের জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে করা কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে সেই ভয়ংকর চিত্রই উঠে এসেছে।মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে যেখানে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৬-এ।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সাত মাসেই নিহত হয়েছেন অন্তত ১১১ জন। গত চার বছরে গণপিটুনির কারণে মৃত্যুহার প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে।
মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও। সমাজে এখন যেকোনো ব্যক্তিকে, যেকোনো তুচ্ছ কারণে কিংবা শুধু সন্দেহের বশে টার্গেট করা হচ্ছে।
আরো উদ্বেগের বিষয়, অনেক সময় মব সহিংসতা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়—রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা সামাজিক বিরোধের হাতিয়ার হিসেবে। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের শাসন দুর্বল থাকা, বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার অভাব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতাই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। সানেমের একটি জরিপেও দেখা গেছে, ৭১.৫ শতাংশ তরুণ মনে করে, এ ধরনের মব জাস্টিস আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা প্রকাশ করছে।এটি খুবই বিপজ্জনক। কারণ বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারালে কোনো সমাজই স্থিতিশীল থাকতে পারে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের গণপিটুনির সংস্কৃতিকে আইনের শাসনের জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের জীবন ও আইনগত সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে, যা গণপিটুনির ঘটনায় গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।এ অবস্থায় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্ব আরো বাড়ছে।
প্রথমত, যেকোনো গণপিটুনি বা মব সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত অভিযুক্তদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তা দিতে হবে। তৃতীয়ত, সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচারণা চালানো জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করতে হবে। অবশ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলছে, কিছু সময় নানা কারণে অপরাধ দমনে শিথিলতা ছিল, কিন্তু এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।
গণপিটুনি এবং মব সন্ত্রাস শুধু ব্যক্তিকে হত্যা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে। এই ভয়াবহ প্রবণতা রুখতে হলে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে।

