ইয়াহিয়া নয়ন
বিশ্বের ১১০ কোটিরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থায় জীবনযাপন করছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু। গত বছর (২০২৪) জাতিসংঘে উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে। অক্সফোর্ড পোভারটি অ্যান্ড হিউম্যাস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (ওপিএইচআই) সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত ইউএনডিপির এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির পাশাপাশি যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত হয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যুদ্ধে জড়িত দেশগুলোতে দারিদ্র্যের এই মাত্রা তিনগুণেরও বেশি। ২০১০ সাল থেকে ইউএনডিপি এবং ওপিএইচআই এই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক প্রকাশ করে আসছে। এই সূচকে বিশ্বের ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি জনসংখ্যার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশের হিসাব অনুসারে ভারতে সবচেয়ে বেশি চরম দরিদ্র মানুষ বাস করছে। দেশটির ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে। এর পরে অবস্থান করছে পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো। এই পাঁচটি দেশেই বিশ্বের ১১০ কোটি চরম দারিদ্র্য পীড়িত জনসংখ্যার অর্ধেক লোকের বসবাস।
২০২০ সালে কভিড মহামারির আগে তিন দশক ধরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমছিল, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই নির্দেশ করে। কিন্তু গত তিন বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে গেছে। সরকারি হিসাবে, ২০২২ সালে এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা চলতি বছরে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। তিন বছরে অতি বা চরম দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। ২০২২ সালের অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। এছাড়া দরিদ্রের বাইরে এখন দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার হঠাৎ দুর্যোগে যেকোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। দেশে দারিদ্র্যের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া কেবল একটি পরিসংখ্যানগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় সতর্কবার্তা। এমনকি এটি দেশের আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রা পিছিয়ে যাওয়ার লক্ষণও। একটি দেশের দারিদ্র্য যখন বাড়তে থাকে, তা শুধু অর্থনৈতিক দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরে না, বরং সে দেশের অর্থনীতির ভিত কতটা দুর্বল, বৈষম্যমূলক ও অনিরাপদ তাও স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। অর্থনীতির মূল ধারায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণ মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়—দেশে প্রবৃদ্ধি হলেও তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। খাবার, চিকিৎসা, বাসাভাড়া ও শিক্ষা—এমন প্রতিটি খাতেই ব্যয় বেড়েছে। ফলে দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সবাই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে পারছেন না। পিপিআরসি বলছে, দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে কভিড মহামারি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। মহামারির অভিঘাত থেকে অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
দেশে টানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে দেশে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্তর ঊর্ধ্বমুখী। চলতি বছরের মার্চ থেকে টানা চার মাস মূল্যস্ফীতির হার কমছিল। কিন্তু চার মাস পর জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। গত জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত জুনে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জুনে দেশের যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল, তা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য হারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আমরা সবাই জানি, ব্যয়ের সঙ্গে আয় সেভাবে বাড়ে না।
যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন চাল, ডাল, তেল, ওষুধ, পোশাক ইত্যাদির দাম বেড়ে যায়, তখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয় দিয়ে এসব প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তারা কম খান, কম খরচ করেন, এমনকি অনেক সময় চিকিৎসা বা শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাও পূরণ করতে পারেন না। অনেক পরিবার তখন বাধ্য হয়ে ধার করে, সঞ্চয় ভেঙে ফেলে বা সম্পদ বিক্রি করে। একপর্যায়ে এ পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে পড়ে। অন্যদিকে যারা আগে থেকেই দরিদ্র ছিল, তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়। এভাবে মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান নেমে যায় এবং দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্য হার বেড়ে যায়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু আমরা দেখলাম বিনিয়োগ স্থবিরতায় এক অঙ্কের এ লক্ষ্যও অর্জন হয়নি। অর্থবছর শেষে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। নিকট অতীতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিতে এতটা ভাটা দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে আর ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণ প্রবৃদ্ধির ভাটা। সুদের হার বেশি হওয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ গ্রহণের হার কমে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ খাতে স্থবিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা সরাসরি কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণপ্রবাহ কমে গেলে উদ্যোক্তারা নতুন শিল্প বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারান। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মসংস্থানের ওপর ঝুঁকিও তৈরি হয়।
দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে, যা বেকারত্বের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বিনিয়োগে একধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিনিয়োগ কম হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। পর্যাপ্ত ঋণের অভাবে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং অনেক সময় ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন ব্যবসাবান্ধব আর্থিক নীতি, সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে রাখা এবং ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করা। অন্যথায় বিনিয়োগের নিম্নগতি ও কর্মসংস্থানের সংকট দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্যের হার আরো বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩-২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ হারে (১.৫)। যদিও একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ (০.২)। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের বেশি। যদিও প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরো বেশি। কারো কর্মজীবী হওয়া মানেই যে তার পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান হয়েছে তা নয়। বরং কাজের ধরন, সময়, আয় ও সামাজিক সুরক্ষা, এ সব বিষয় বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, দেশের অনেক মানুষ এখনো নিরাপদ ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের বাইরে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের মানোন্নয়ন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনা একান্ত জরুরি। কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের ভাবনা ও জরুরি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে এখনই আলোচনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে শহরাঞ্চলের পরিবারগুলোর মাসিক আয় কমেছে, কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারের গড় আয় আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। অবশ্য গড় আয় দিয়ে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় না। সমাজের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য প্রকট। দারিদ্র্যের চেয়ে আরো ভয়াবহ হচ্ছে আয়বৈষম্য। অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধু সামাজিক অস্থিরতাই বাড়ায় না, দীর্ঘমেয়াদে তা উন্নয়নকে অব্যাহত রাখার পথেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক নিরাপত্তা খাত অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। তবে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
এখন দারিদ্র্য নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানসম্মত শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দেয়া আবশ্যক। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্ব দেয়া দরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করলেই দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক।

