মো. রহমত উল্লাহ্
বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমে বা কারিকুলামে শিক্ষামূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ কারিকুলাম অনুসারে নির্ধারিত শ্রেণির নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের বিষয়/অধ্যায় পাঠদান চলাকালে বা সমাপ্তিতে শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিক্ষা মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত পাঠের অধ্যয়ন ও অনুশীলন দ্বারা শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কতটুকু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা যাচাই করার উপায় হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন।
পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করেই জানা যায় শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি আছে কিনা, ঘাটতির পরিমাণ কতটুকু, কোন ক্লাসে কে পড়ার উপযোগী। ঘাটতি চিহ্নিত করা গেলেই সে ঘাটতি পূরণের জন্য নেওয়া যায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এটি অনেকটা রোগ নির্ণয়ের মতই। রোগ নির্ণয় ভুল হলে, ত্রুটিপূর্ণ হলে, অসম্পন্ন হলে যেমন সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, রোগী সুস্থ-সবল করা সম্ভব নয়; তেমনি শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেটি কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথভাবে শিক্ষা মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত দ্রুত শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করা যায় তত দ্রুত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেওয়া যায় এবং অধিক সফলতা অর্জন করা যায়। পাঠদানের ও মূল্যায়নের দুর্বলতার কারণে শিখন ঘাটতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা উপরের ক্লাসে উঠতে থাকলে পরবর্তীতে এ ঘাটতি আর পূর্ণ করা সম্ভব হয় না অনেকের ক্ষেত্রেই।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ওপর ভরসা করে একজন শিক্ষার্থীকে টানা ১০ বছর পর্যন্ত উপরের ক্লাসে উঠতে দেওয়া হলে অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে দেওয়া হলে সেটি কতটা যৌক্তিক হবে, মঙ্গলজনক হবে তা গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা উচিত। যেখানে আমাদের দেশের গ্রামে, শহরে, উপশহরে অবস্থিত কেজি স্কুল, প্রাইভেট স্কুল, সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম স্কুল, ইংলিশ ভার্সন স্কুল ইত্যাদির পরিবেশ, অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষার মান, সহশিক্ষার মান, মূল্যায়নের মান, সব ক্ষেত্রেই আকাশ-পাতাল ব্যবধান এবং যেখানে হাজার হাজার অনুমোদনহীন স্কুল-মাদ্রাসা অন্য স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করায়, সরকারি পরীক্ষা দেওয়ায়; সেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণিতে অর্জিত ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জাতীয় মান নির্ধারণ শুধু প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের মাধ্যমে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বর্তমানে সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করে না, ঠিকভাবে লেখাপড়া করে না, শিক্ষকদের মান্য করে না, সকল পরীক্ষা দেয় না, দিলেও পাস করে না; তথাপি প্রমোশন চায়, পায়!! অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকগণ প্রমোশন দিতে বা গ্রেট বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন। অপরদিকে শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা ও প্রতিষ্ঠানের অনুমতি/ স্বীকৃতি বজায় রাখার জন্য কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ধরে রাখতে হয়। অথচ এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের কড়াকড়ি করা হলে, পরীক্ষায় প্রশ্ন কঠিন করা হলে, নম্বর বেশি দেওয়া না হলে, উপরের ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া না হলে, অন্য স্কুলে বা মাদ্রাসায় চলে যায়। তখন শিক্ষকগণের বেতন বন্ধ হওয়ার ও চাকরি চলে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই ওই সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দেওয়ার জন্য, ভালো ফলাফল দেখানোর জন্য, শিক্ষা মূল্যায়নে ব্যাপক অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করেন! আমাদের দেশে এমন অভিভাবকের সংখ্যাও কম নয় যারা সন্তানদের ক্লাসে ভালো শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিলেই খুশি হন, ভালো মনে করেন।এমন কঠিন বাস্তবতায় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ১০টি শ্রেণি অতিক্রম করার পরে এসএসসি ও সমমানের সরকারি পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যাপক দুর্বলতা বা শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করা হলে সে ঘাটতি পূর্ণ করার কোন উপায় থাকবে বলে আমি মনে করি না। শিক্ষা গবেষণায় সম্পৃক্ত প্রায় সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তদুপরি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের মাধ্যমে একদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে শিক্ষার্থীর, শিক্ষকের ও পাঠদানের মূল্যায়ন হয়ে থাকে; অপরদিকে বৃহৎ পরিসরে পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন হয়ে থাকে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাক্রমের মান বৃদ্ধির জন্যও যৌক্তিক সময়ের পরপর জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন আবশ্যক হয়। এ সকল বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে আমাদের দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতে জাতীয়ভাবে শিক্ষামূল্যায়নের যৌক্তিক স্তর নির্ধারণ করা উচিত।
সার্বিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করতে হবে জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্রথম ও পরবর্তী বিভিন্ন স্তর। অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যদি ষষ্ঠ/সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে নির্ভয়ে প্রথম অংশ নিতে পারে জাতীয় মূল্যায়নে তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পারবে না কেন? আমাদের শিক্ষার্থীদের চাপমুক্ত রাখার কথা বলে বলে জাতীয় মান নির্ধারণী পরীক্ষামুক্ত রাখতে গিয়ে কম/বেশি শিক্ষামুক্ত রাখছি কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে গভীরভাবে!
শিক্ষায় প্রভাব বিস্তারকারী ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, বৈশ্বিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে SATs পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারিভাবে মূল্যায়ন করা হয়। তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়াতে শিক্ষার্থীদের সপ্তম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা হয়। আমাদের নিকটবর্তী চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপালে শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণিতে প্রাদেশিক বা জাতীয়ভাবে পাবলিক পরীক্ষা হয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের উন্নত পরিবেশ অর্জিত হওয়ায় পাবলিক পরীক্ষা আরো পরে হয়ে থাকে।
লক্ষনীয় যে, বিভিন্ন দেশের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক পরীক্ষার যৌক্তিক স্তর নির্ধারিত হয়ে থাকে। সবদিক বিবেচনা করে আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীদের সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে মূল্যায়নের একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা আবশ্যক। শুধু বাছাইকৃত স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করে তা সম্ভব নয়। সারাদেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই মানদণ্ডে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। সে মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে মেধাবৃত্তিও দেওয়া যাবে। মেধাবৃত্তির পাশাপাশি দরিদ্রবৃত্তি চালু করার কথাও ভাবতে হবে।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নকে কেউই নির্ভরযোগ্য মনে করেন না; সেহেতু পরোক্ষভাবে প্রায় সবাই জাতীয় বা সরকারি মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তাই আবারও বলছি, আমাদের দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের ও মানের প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া মোটেও মঙ্গলজনক নয়। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিক্ষার মান জাতীয়ভাবে মূল্যায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেক বিস্তৃত। প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন অসম্ভব। তাই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে জাতীয়ভাবে বা সরকারিভাবে শিক্ষামূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। জাতীয় মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে জাতীয়ভাবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।আমাদেরও তাই করতে হবে। সার্বিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করতে হবে জাতীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্রথম ও পরবর্তী বিভিন্ন স্তর। অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যদি ষষ্ঠ/সপ্তম/অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে নির্ভয়ে প্রথম অংশ নিতে পারে জাতীয় মূল্যায়নে তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পারবে না কেন? আমাদের শিক্ষার্থীদের চাপমুক্ত রাখার কথা বলে বলে জাতীয় মান নির্ধারণী পরীক্ষামুক্ত রাখতে গিয়ে কম/বেশি শিক্ষামুক্ত রাখছি কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে গভীরভাবে!
লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাগবেষক ও শিশুসাহিত্যিক।