১১ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  । ২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ 

বিআরটিসিকে কার্যকর ও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে

ইয়াহিয়া নয়ন
গণপরিবহন নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। কিন্তু আমাদের দুশ্চিন্তা-দুর্ভোগ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সাশ্রয়ী ভাড়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সময় মেনে চলাচল, নিরাপদ যাতায়াত, সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) কাছে মোটাদাগে এ সেবাগুলোই প্রত্যাশা করেন যাত্রীরা। বাস্তবতা হলো বছরের পর বছর সংস্থাটি যাত্রীদের এসব কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিপুল সরকারি বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিআরটিসির পরিবহন সেবা অত্যন্ত নিম্নমানের। অথচ বিশ্বে বহু দেশে সরকারি পরিবহনের মাধ্যমে উত্তম যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা হয়। সেখানে সরকারি পরিবহন খাত নিয়ে স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও তেমন পাওয়া যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টো। দুর্নীতি, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে উত্তম যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে পারছে না বিআরটিসি। যদিও নির্দিষ্ট রুট পারমিট সুবিধা, করমুক্ত বাস আমদানির সুযোগ, পর্যাপ্ত জনবল ও স্থাপনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে সংস্থাটি। এত সব সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও বিআরটিসি এখনো একটি মানসম্পন্ন গণপরিবহন সেবা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং বাস কেনার প্রকল্পে কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকায় এতে জনগণের উপকারের তুলনায় এক শ্রেণীর কর্মকর্তার ব্যক্তিগত লাভই বেশি হয়ে থাকে।
দেশে গণপরিবহনে নিরাপদ, ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী সেবা নিশ্চিত করতে বিআরটিসির ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল পথপ্রদর্শকের মতো। অথচ বাস্তবতা হলো রাষ্ট্রীয় এ সংস্থা অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। বিআরটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের প্রধান সমস্যা বাসের সংকট। তাই দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৩৪০টি বাস কেনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কোস্টার জাতীয় ছোট বাস কেনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সমস্যার সমাধান হিসেবে তারা আরো বাস কেনার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিগত দেড় দশকে ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা হয় ১ হাজার ৫৫৮টি বাস। বিআরটিসির বহরে বর্তমানে ১ হাজার ১৬৮টি বাস সচল রয়েছে। এর অর্থ শত শত বাস যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে নতুন বাস কেনা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। বিআরটিসির মূল সমস্যা ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও দুর্নীতি। এছাড়া পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস, ভাঙাচোরা আসন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, পথে বিকল হওয়ার ঝুঁকিসহ নানা সমস্যার কারণে বিআরটিসির সেবা যাত্রীদের কাছে আস্থা অর্জন করতে পারছে না।
প্রয়োজন নতুন বাস কেনার আগে জরুরি হচ্ছে বিদ্যমান বাসগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা। এখন যেভাবে বাস কেনা হয়, তাতে বড় বাজেটের প্রকল্পে স্বার্থান্বেষী মহলের লাভ থাকলেও জনগণের হাতে পৌঁছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। সেবামূলক সংস্থা নয়, একটি কেনাকাটাভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিণত হয়েছে বিআরটিসি। যে দেশে সড়কে নিরাপত্তা নেই ও বেসরকারি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা অনুপস্থিত, সেখানে বিআরটিসির মতো রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিতে পারত। অথচ সংস্থাটিই যাত্রীদের কাছে আস্থা হারিয়েছে। নতুন বাস কিংবা কোস্টার এনে বিআরটিসি কত দিন চলবে? এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত বহরে নতুন বাস বা কোস্টার যুক্ত করার আগে বিআরটিসিতে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয় তা খতিয়ে দেখা দরকার। যারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা জরুরি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া দেশের জন্য ক্ষতিকর। বিআরটিসিকে অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত করে জনগণের টাকায় বিআরটিসিতে নতুন নতুন বাস যুক্ত করায় কোনো অন্যায় হবে না। যদি বিআরটিসির দুর্নীতিবাজদের পকেট আরো ভারি করার জন্য নতুন নতুন বাস কেনা হয়, তাহলে জনগণের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করা হবে। জনস্বার্থে দুর্নীতিবাজদের এখনই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
সারাদেশের ২১৩টি রুটে বর্তমানে বাস পরিচালনা করছে বিআরটিসি। বিশ্বজুড়ে গণপরিবহনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার নেতৃত্ব থাকলেও বিআরটিসি নিয়মিত পিছিয়ে পড়ছে। সরকার সংস্থাটির বহরে চাহিদামাফিক বাস-ট্রাক সংযোজন করলেও দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কেনা এসব বাস ঘোষিত লাইফটাইমের আগেই বিকল হয়ে পড়ছে। অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোনো বাস অচল হয়ে ডিপোতে গেলে সেটি আর রাস্তায় ফিরে আসছে না। বিআরটিসির অধিকাংশ ডিপো নষ্ট গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সংস্থাটির ২১টি ডিপোর অধিকাংশই মেরামতের অযোগ্য পরিত্যক্ত গাড়ির কারণে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে বিআরটিসিকে কার্যকর ও জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে এখনই কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। প্রথমত, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ডিজিটাল এবং জবাবদিহিমূলক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, টিকিট ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন করা উচিত। তৃতীয়ত, দুর্নীতির প্রমাণ মিললে কেবল বাসচালক বা টেকনিশিয়ান নয়, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও যেন শাস্তির আওতায় আসে—তা নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীসেবা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এটি একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার। বিআরটিসিকে যদি জনসেবামুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তবে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তি ও সুশাসনের সমন্বয়ে কার্যকর সংস্কার চালুর এখনই সময়। এটা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক।

আরো দেখুন

Advertisment

জনপ্রিয়