চিররঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকাল এক অদ্ভুত ধারা চোখে পড়ছে, যেন ইতিহাসের পাতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে এক অভিনব অধ্যায়—প্রতিবাদের নাম ডিম। যে ডিম ভোরবেলা রুটি-পরোটার পাশে ভাজা হয়ে আসে, দুপুরে ভাতের সাথে ঝোল বানিয়ে খাওয়া হয়, আর রাতের ক্ষুধায় ওমলেটে আশ্রয় দেয়—সেই ডিম আজ পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক প্রতীকে, এক ক্ষুদ্র অথচ প্রবল বোমায়।একসময় রাজনৈতিক প্রতিবাদ মানেই ছিল মিছিল-মিটিং, স্লোগানের ঝড়, মাইকে আওয়াজ তুলে ‘ভোটাধিকার চাই’ বা ‘সরকার হটাও’। ক্ষোভে কোথাও জুতা ছোড়া হলে তারও আলাদা হৈচৈ হতো। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন প্রতিপক্ষকে বিব্রত করার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হয়ে উঠেছে এই নরম, গোলগাল আর ভঙ্গুর জিনিসটি—ডিম। এটি ছুড়তে বন্দুক লাগে না, বারুদ লাগে না, লাগে কেবল ক্ষোভ আর সামান্য সাহস।
লন্ডনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের গায়ে যখন ডিম আছড়ে পড়েছিল, তখন সেটি নিছক খাবার নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ঘোষণাই ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তা এক ঝটকায় ইতিহাসে পরিণত হয়। নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতা আখতারের গায়ে ডিম পড়ল, মানুষ হাসল, কেউ ক্ষেপে উঠল, কেউ বলল—এটাই ন্যায্য প্রতিবাদ। কেউ কেউ আবার ডিমের বদলে ইট মারার হুমকিও উচ্চারণ করল। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে যখন আওয়ামী লীগ নেতাদের আদালতে আনা-নেওয়া হচ্ছিল, তখনও উড়ে এসেছিল সেই একই ডিম। ইতিহাস সাক্ষী, রাস্তায় যেমন রক্ত ঝরেছে, তেমনি কম ঝরেনি ডিমের কুসুমও।
অনেকেই এটিকে নিছক হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে চান। বলেন, ‘ডিম ছোড়া কীসের রাজনীতি?’ অথচ বিষয়টি এত সহজ নয়। ডিম আসলে বহুমাত্রিক প্রতীক। এটি ভঙ্গুর—যেন রাজনীতির অস্থিরতার রূপক। আবার এটি দামিও—ডজনের দাম যদি সপ্তাহে দুবার বাড়ে, তবে প্রতিটি নিক্ষিপ্ত ডিম দাঁড়িয়ে যায় একপ্রকার অর্থনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র হয়ে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ডিম গায়ে পড়লে তা সহজে যায় না। কুসুম লেগে থাকে, সাদা অংশ জামায় লেপ্টে যায়। জুতায় পড়লে ধুয়ে ফেলা যায়, কিন্তু ডিমের গন্ধ থাকে অনেকক্ষণ, যেন রাজনৈতিক অপমানের এক অদৃশ্য ছাপ।এর প্রভাব শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও বটে। একজন নেতার মাথায় বা গায়ে ডিম ফেটে গেলে তা শরীরের চেয়ে বেশি লাগে আত্মসম্মানে। তিনি মাইকের সামনে যতই চেঁচান না কেন, ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই মুহূর্ত—কুসুম মাখা মুখ—চিরস্থায়ী হয়ে যায়। টিভি দর্শকরা রাতের খাবারের টেবিলে আলোচনা করে, ‘ডিমটা তো একেবারে সোজা গায়ে লেগেছে!’ নেতার দীর্ঘ বক্তৃতার চেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকে সেই এক সেকেন্ড।
অনেকে মজা করে বলেন, ডিম নিক্ষেপ এখন যেন ক্রীড়া হয়ে উঠছে। হয়তো একদিন অলিম্পিকে নতুন খেলা চালু হবে—‘এগ থ্রো ফর জাস্টিস’—আর বাংলাদেশ সেখানেই জিতবে স্বর্ণপদক। আমাদের প্রতিবাদীরা ইতিমধ্যে শিখে গেছে: কোন মোক্ষম কোণ থেকে ছুড়লে সরাসরি মাথায় লাগবে, কোন দূরত্বে দাঁড়ালে ক্যামেরায় নিখুঁতভাবে ধরা পড়বে, আর কোন সময়ে ছুড়লে মিডিয়া হাইলাইট করবে। ক্রিকেটে আমরা হয়তো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি, কিন্তু ডিম নিক্ষেপে আমরা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের।কিছু বিশেষজ্ঞ তো রসিকতা করে বলতেই শুরু করেছেন, ‘ডিম হলো গণতন্ত্রের থার্মোমিটার।’ রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়লেই বাজার থেকে ডিম উধাও, আর রাস্তায় বাড়তে থাকে নিক্ষেপ। অবাক করার মতো বিষয় হলো, দামের কারণে গরিব মানুষ খাওয়ার জন্য ডিম কিনতে পারে না, অথচ একশ্রেণির মানুষ ডিম ছুড়ে মারে ক্ষোভে-উল্লাসে! তখন প্রতিটি ডিম হয়ে ওঠে ব্যঙ্গ—‘কেউ খেতে পায় না, আর কেউ বেহুদা ডিম ছুড়ে মারে প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে।’
এক সময় অপমান অপদস্থের জন্য জুতা দেখানো বা প্রতীকী জুতা মারার রীতি ছিল। এখন বিধির বিধান বদলে গেছে। জুতার স্থান নিয়েছে ডিম। জুতার সঙ্গে তুলনায় ডিম এগিয়ে থাকে বেশ কয়েক ধাপ। জুতা পুনঃব্যবহারযোগ্য—ছুড়ে দেওয়ার পরও আবার পায়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ডিম একবার ছুড়লেই শেষ। এই একবারের এক্সক্লুসিভিটিই ডিমকে বানিয়েছে প্রতিবাদের অনন্য হাতিয়ার। তার সঙ্গে আছে বিশেষ বোনাস—অপ্রিয় গন্ধ।ভাবুন তো, ভবিষ্যতে সরকার যদি গঠন করে ‘ডিম প্রতিরক্ষা বাহিনী’। রাজনীতিবিদরা যাবেন বডিগার্ড নিয়ে নয়, বরং হাতে ট্রে নিয়ে। ছোড়া ডিম ধরা হবে, সাথে সাথে ভাজা হয়ে অতিথিদের সামনে পরিবেশিত হবে। কে জানে, বাজেটে হয়তো আলাদা খাতও যুক্ত হবে: ‘ডিম নিক্ষেপ প্রতিরোধ ব্যয়—৫০ কোটি টাকা।’ আদালতে মামলা হবে—‘অমুক তারিখে অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি লাল ডিম দ্বারা মাননীয় নেতাকে আঘাত করেছেন, যার বাজারমূল্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা।’
সবকিছু মিলিয়ে আজ ডিম আর কেবল খাদ্য নয়। এটি শিল্প, প্রতিবাদ, ব্যঙ্গ, মিডিয়া-শো। ফোটে মুরগির শরীরে, বিস্ফোরিত হয় রাজনীতিবিদের পিঠে, পেটে, কপালে। শুধু শরীর নয়, ভিজিয়ে দেয় বক্তৃতার মর্যাদাও।
তবু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নির্মম সত্য। ডিম নিক্ষেপ যতই মজার মনে হোক, তা আসলে প্রমাণ করে রাজনীতি কতটা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। আলোচনা, সংলাপ, নীতি-আদর্শ—সব বাদ দিয়ে আমরা এখন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজছি ওভাল আকৃতির প্রোটিনে। কেউ ক্ষুধার্ত বলে, কেউ ক্ষুব্ধ বলে, কেউ নিছক আমোদে ছোড়ে।হয়তো একদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে—’বাংলাদেশের মানুষ ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছে, আর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়েছে হাতে ডিম নিয়ে।’ তখন নতুন প্রজন্ম গর্ব আর হাসির মাঝামাঝি কোথাও বলবে—’আমাদের দাদারা অমলেট বানাননি, তারা বানিয়েছিলেন আন্দোলন।’ শেষে আসুক একটু হালকা কৌতুক।
এক কৃপণ গৃহস্থ একদিন ক্ষেপে গিয়ে মুরগিদের বলল, ‘আগামীকাল থেকে প্রতিদিন দুইটা করে ডিম না দিলে জবাই করে ফেলব!’ এরপর থেকে সব মুরগিই প্রতিদিন দুইটা করে ডিম দিতে লাগল, শুধু একটা ছাড়া। সেটি প্রতিদিন একটি করেই ডিম পাড়ত। গৃহস্থ রেগে গিয়ে বলল, ‘তোর সাহস তো কম না! হুমকি দিলাম, তারপরও একটা করে দিচ্ছিস?’ মুরগির উত্তর, ‘জনাব, আপনার ভয়ে কষ্টে একটা দিয়েই বাঁচছি। আমি আসলে মোরগ!’ডিমের বদনামও কিন্তু কম নয়। সন্তান পরীক্ষা দিতে যাবে, মা কিছুতেই ডিম খেতে দিতে চান না। তার ধারণা, ডিম খেলেই পরীক্ষায় ডিম পাবে! যদিও এর কোনো ভিত্তি নেই। পৃথিবীর সব পণ্ডিতই ডিম খেয়েই পরীক্ষা দিয়েছেন, ফলাফলেও হেরফের হয়নি।আপনার হাতে যদি দুটো ডিম থাকে, কী করবেন? ভেজে খাবেন? তা দেবেন? না অন্যকে দিয়ে দেবেন? এটা একান্তই আপনার ব্যাপার। কিন্তু অন্যদের হাতে দুটো ডিম থাকলে কী হবে, সেটি নিয়েও গল্প প্রচলিত আছে।একজন আমেরিকান রাজনীতিবিদ একটি বিক্রি করবেন, আরেকটি সামরিক হুমকি দেখিয়ে চার কুসুমওয়ালা বানাবেন।একজন চীনা অর্থনীতিবিদ ডিম দুটোকে দশভাগের একভাগ ছোট করবেন, কিন্তু ভাঙলেই ফুটবলের মতো বিশাল কুসুম বের হবে, আর সারা বিশ্বে বাজারজাত করবেন।আর একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ? তিনি ডিম দুটো যেমন আছে তেমনই রাখবেন। বিদেশ থেকে আরও দুটো ডিম উচ্চমূল্যে কিনে আনবেন ‘অভিজ্ঞতা অর্জন’র কথা বলে। এজন্য বিশাল বাজেট হবে। বিদেশি ডিম নষ্ট হয়ে যাবে, সেগুলো রক্ষার জন্য বিদেশি পরামর্শক ও কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হবে, আবার বাজেট ফুলে উঠবে। আর নিজের ডিম? যত্নের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে!
আজকের একটি ডিম, কালকের একটি মুরগির চেয়ে অধিক উত্তম—বলেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন। সত্যিই, ডিম শুধু পুষ্টিই দেয় না, মানুষকে প্রতিবাদের ভাষাও দেয়। খারাপ নাটক, খারাপ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খারাপ বক্তৃতা—সবকিছুই ব্যর্থ করার জন্য ব্যবহার হয় ডিম, বিশেষত পচা ডিম। পচা শিল্পীর জন্য যেমন পচা ডিম লাগে, তেমনি পচা রাজনীতিবিদের জন্যও। দর্শক গ্যালারি থেকে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দিতে হয়, যাতে সবাই বুঝতে পারে—এখানে গন্ধ আছে। আর রাজনীতিতে সেই গন্ধ ছড়ানো এখন নিউ-নরমাল!