মোস্তফা হোসেইন
রাজনৈতিক দলগুলোর নড়াচড়া দেখে মনে হয় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া বিষয়ে তাদের দ্বিধা-দন্দ্ব কাটতে শুরু করেছে।জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও পিআর পদ্ধতির নির্বাচন বিষয়ে তাদের যোজন যোজন দূরত্ব থাকার পরও তারা যে নির্বাচনে আশাবাদী হয়ে উঠেছে অনুমান করা যায়।মাঠের আন্দোলনগুলোকে মনে হতে পারে নির্বাচনী ওয়ার্ম আপ হিসেবে।যখনই নির্বাচনী রাজনীতি শুরু হয় তখন মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা হয়,তার পছন্দের দলটির অবস্থান কি তা জানার আগ্রহ জন্মায়। সেই জনচাহিদার কথা বিবেচনা করে জরিপও হয়। এটা সবদেশেই হয়। কোথাও কোথাও জরিপের সঙ্গে নির্বাচনের ফল কাছাকাছি মিলে যায়।আবার কোথাও জরিপের ফল চাপা পড়ে নির্বাচনী ফলের নিচে।তারপরও ভোটারদের কাছে জরিপ নিয়ে কৌতূহল থাকে।
সেই কৌতূহলের কথা বিবেচনা করে হয়তো ইনোভিশন কনসাল্টিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনী জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। বিষয়টি যে ভোটার চাহিদার অংশ তাও প্রমাণিত হয়েছে,জরিপের সংবাদ প্রকাশের আধিক্য দেখে।প্রতিটি পত্রিকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গুরুত্বসহ সংবাদটি প্রকাশ করে। এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও তাদের টকশোতে স্থান দেয় জরিপের বিষয়টি।
পর্যালোচনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কারো প্রশ্ন হচ্ছে-দ্বিতীয় বৃহৎ দল বিষয়ে। যেহেতু আওয়ামী লীগের নির্বাচনে আসা এখনও নিশ্চিত নয় তাই মানুষ ধরেই নিয়েছে দ্বিতীয় বৃহৎ দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী এককভাবে কিংবা জোটগতভাবে আগামী সংসদে স্থান করে নিতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বিহীন নির্বাচন হলে এটা অনেকেরই মনে হতে পারে।জরিপের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে।কিন্তু আলোচনায় আসছে জরিপে প্রদর্শিত ভোট পাওয়ার পরিসংখ্যানের বিষয়টি। জরিপে দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেবে ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ।যেখানে বিএনপিকে ভোট দেবে ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
দুটি দলের অতীতের রেকর্ড এবং বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় যদি এই ফলকে মূল্যায়ণ করা হয় তখন জরিপের স্যাম্পল ,স্থানিক প্রশ্ন অবশ্যই করতে হবে।বিএনপির অতীত রেকর্ড ৪৭% পর্যন্ত ভোট প্রাপ্তির কথা বলে।প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে থাকার পরও যেখানে ৩৬%-৩৭% ভোট পাওয়ার রেকর্ড আছে এখন তাদের ভোট ৪১ শতাংশ হয় কী করে। কথা হতে পারে, আওয়ামী লীগের ভোট নিয়ে। যদি আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে না আসতে পারে এবং এমন সম্ভাবনাই বেশি মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভোট কি বিএনপি না পেয়ে জামায়াতের বাক্সে পড়বে?
ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী লীগের ভোটারদের সবাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে ভোট দিয়ে থাকে।তাছাড়া যতই আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হোক না কেন, এই সময় এসে প্রমাণ হয়ে গেছে, আসলে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা দল হিসেবে প্রথম নামটি আওয়ামী লীগ। কথা হচ্ছে-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভোটাররা কি তাহলে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমানের দল বিএনপিকে দ্বিতীয় পছন্দের দল হিসেবে বাছাই করবে না?
এখানে কেউ হয়তো ২৪ অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রশ্নটি আনতে পারেন।আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে তার দুই তৃতীয়াংশই যে বিএনপির নেতাকর্মীরা বাদির তালিকায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।ফলে আওয়ামী লীগের ভোট বিএনপি সেই হারে পাবে না। এই বিশ্লেষণটি আমলে নিলে প্রশ্ন আসবে তাহলে আওয়ামী লীগের ভোটাররা কি জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেবে? যারা হ্যাঁ জবাব দেবেন,তাদের যুক্তি হতে পারে,বিভিন্ন থানায় বন্দী হওয়া অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে জামায়াতের লোকজন গিয়ে তদবির করে ছাড়িয়ে এনেছে। তাই তারা বিএনপির চেয়ে জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দের মনে করতে পারে। কিন্তু সংখ্যা বিবেচনা করলে এরা খুব একটা বেশি হওয়ার কথা নয়।যাতে ভোটের হিসাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
তারপরও জামায়াতে ইসলামী এত বেশি ভোটে এগিয়ে যাওয়ার কারণ কি হতে পারে? এই প্রশ্নের জবাবে যারা হ্যাঁ বলবেন তাদের যুক্তি হতে পারে,জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক আচরণ পরিবর্তন করেছে।তারা আগের মতো গোঁড়া নয় এখন।একসময় তারা যেখানে নির্বাচনী পোস্টারে প্রার্থীর ছবি ব্যবহার করতো না ছবি তোলা কিংবা ছাপানো নাজায়েজ ভেবে, সেই জামায়াত এখন এটাকে কোনো বিষয়ই মনে করে না। শুধু চোখ ছাড়া পুরো দেহ ঢেকে রাখা বোরখা পরা যেখানে জামায়াতের কড়া নির্দেশনা ছিলো এবং তাদের মহিলা কর্মীরা এটাকে কঠিনভাবে পালনও করতো, আজকে তাদের ছাত্র সংগঠনে হিজাবছাড়া নারীরা ডাকসুতে নির্বাচিতও হয়ে এসেছে। আবার অমুসলিমদের প্রতি তাদের চিরবিদ্বেষও যেন কমে আসছে। বিদ্বেষ দূর করার প্রমাণ দিতে গিয়ে তাদের নেতাদের কাউকে কাউকে দূর্গা পূজার মন্ডপে যেতেও দেখা গেছে।শুধু তাই নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতি নেতাকে মন্ডপে গিয়ে মন্ত্র পড়তেও দেখা গেছে।
কিন্তু তাদের এই পরিবর্তন কি ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম?বরং তাদের এই পরিবর্তনটা মানুষের মনে সন্দেহেরও জন্ম দিয়েছে। ভোটাররা দেখেছেন ছাত্রলীগের ছায়াতলে থেকে হেলমেট বাহিনীর সদস্য হিসেবে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতনও করেছে। পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারা শিবিরে ফেরৎ গিয়েছেন। যে কারণে ভোটাররা জামায়াতে ইসলামীর এই পরিবর্তনকে সহজভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা যদি তাদের এই পরিবর্তনকে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে মনে করে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাদের এমন ভাবনার পেছনে যুক্তিও আছে। এই জামায়াত কিন্তু দলীয় আদর্শে কোনো পরিবর্তন আজ পর্যন্ত আনেনি। যে কারণে আধুনিকতার পেছনে তাদের হেলমেট বাহিনীর প্রতিচ্ছবিই দেখতে পান তারা।বিশ্লেষণের সুবিধার্থে জামায়াতে ইসলামীর বিগত সময়ে প্রাপ্ত আসনের পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে। ১৯৮৬ সালে- ১০ আসন,১৯৯১ সালে – ১৮ আসন, ১৯৯৬ সালে – ৩ আসন,২০০১ সালে – ১৭ আসন। ২০০৮ সালে – ২ আসন পেয়েছে তারা। পরিসংখ্যান বলে ২ অংকের আসন সংখ্যা পাওয়ার পেছনে তাদের অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন হয়েছে। যখনই বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের ছায়ার বাইরে গিয়ে তারা নির্বাচন করেছে তখন তাদের আসন সংখ্যা ১ অংকে নেমে এসেছে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না,তাদের সমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে বৃদ্ধির হার যেভাবে জরিপে দেখানো হয়েছে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন করতে না পারে তাহলে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো থেকে কিছু প্রার্থী পাস করবে এমন সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক কিছু দলের কিছু প্রার্থী বেরিয়ে আসতে পারে। সেখানেও জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জোটের যে চেষ্টা চলছে,তা আদৌ সম্ভব কি না এটাও বলা যাচ্ছে না। যদি সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল একাট্টা হতে পারে তখন তাদের ভোটের সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে আসনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হবে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তাও কি বলা যাবে? ড.মুহাম্মদ ইউনূস যদি মনে করেন তাঁর পূর্বঘোষণা থেকে তিনি সরে আসবেন না, তাহলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কর্মকাণ্ড পরিচালনার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করতে পারেন। কারণ ইনক্লুসিভ নির্বাচন প্রমাণ করতে হলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে।
সেক্ষেত্রে হয়তো বিচারাধীন নেতাদের দূরে রাখার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস এর সামনে প্রধান বাধা হতে পারে ছোট দলগুলো। যারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য লড়াই করছে, তারা সহজে এটা মেনে নেবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে ড.ইউনূস হয়তো বুঝে গেছেন বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলই তার জন্য বড় প্রতিবন্ধক নয়। যেহেতু বিএনপি এখনও এমন কথা বলছে না যে, আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই নির্বাচন করতে পারবে না। বরং তারা প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষেই কথা-বার্তা বলছে। অন্যদিকে এটা তাদের জন্য ইতিবাচকও হবে। কারণ আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সুযোগ পায় তাহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এবং তাদের সরকার গঠনেও প্রতিবন্ধক হবে না।
নির্বাচনী আলোচনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়টি কেন যে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না জানি না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসুক আর নাই বা আসুক আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বড় ভূমিকা রাখবে তা বলতে হবে। কারণ ভোটাররা এবার মার্কা দেখে ভোট যেমন দেবে,ব্যক্তির বিবেচনাও করবে।বরং কোথাও কোথাও ব্যক্তির বিবেচনা বেশিই হবে।নির্বাচনে নানামুখী আলোচনা পর্যালোচনা আছে সেটাই হচ্ছে এখন। জরিপের ফল হয়তো তেমনি একটি উদাহরণ। কিন্তু মানুষ এবার ভোট দিতে যাবে মন খুলে এটা সত্য। অশুভ কিছু না ঘটলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ারও সম্ভাবনা আছে।তবে সবকিছু্ নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার ওপর। এক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে এই দ্বিধাও কেটে গেছে বিশ্বাস করা যায়। সবমিলে আশা করা যায়-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার গঠন হোক।যারা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করবে।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।